ফিচার

মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুভপুর ব্রিজ

শুভপুর ব্রিজ। মুক্তিযুদ্ধের অনন্য সাক্ষী। ৭০ বছরের পুরোনো এই ব্রিজে ঢালাই লোহার কয়েক ইঞ্চি পুরু গার্ডার দেওয়া। সেই গার্ডারও যে ছিদ্র হতে পারে, নিজ চোখে না দেখলে যে কারও কাছে তা অবিশ্বাস্য মনে হবে। ব্রিজের গার্ডারের কোনো কোনো অংশের ঝাঁঝরির মতো ফুটো। এসবই মেশিনগানের বুলেটের দাগ। লোহার পুরু পাত ভেদ করে যাওয়া মেশিনগানের গুলি আজও জানান দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে কতটা গুরুত্ববহ ছিল পাক হানাদারদের অত্যাচার।

Advertisement

ব্রিজটির দক্ষিণাংশে চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়ন এবং উত্তরাংশে ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুর ইউনিয়ন। ব্রিজের নিচ দিয়ে প্রবাহমান খরস্রোতা ফেনী নদী বিভক্ত করেছে ২ জেলাকে।

১৯৫২ সালে স্থাপিত হওয়া ১২শ ফুট দৈঘ্যের্র শুভপুর ব্রিজটি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গোলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেকখানি। ঢালাইয়ের কার্পেটিংয়ের রড নিচের দিকে ধসে যাওয়া ও কাঠামো দুর্বল হয়ে যাওয়ায় যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। ব্রিজের পাশে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কারণে ব্রিজের নিচে পিলারের পাশের মাটি সরে যাচ্ছে। পিলারগুলো নড়বড়ে হয়ে গেছে। যে কোনো সময় ব্রিজ ধসে পড়তে পারে। ১৯৫২ সালের দিকে ইস্পাত দিয়ে ১২৯ মিটার দৈর্ঘ্যের ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়। পরে নদীর প্রশস্থতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৬৮ সালে ব্রিজটিতে ২৪৯ মিটার সম্প্রসারণ করা হয়। এতে করে ব্রিজের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৩৭৪ মিটার। এটি ছিল দক্ষিণাঞ্চলের মহাসড়কে তৎকালীন দীর্ঘতম ব্রিজ।

আরও পড়ুন: ২০০ বছরের পুরোনো গফুর শাহ গায়েবি মসজিদ 

Advertisement

এক সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে চলাচলের অন্যতম মাধ্যম ছিল এই শুভপুর ব্রিজ। ঢাকা-কুমিল্লা বা ফেনী থেকে চট্টগ্রামে যেতে হলে এই ব্রিজ দিয়েই যেতে হতো। ফলে ব্রিজটি যাতায়াতের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানি বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী দুই পক্ষই শুভপুর ব্রিজের দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৪ বার যুদ্ধ হয়েছিল শুভপুর ব্রিজে। প্রতিটি যুদ্ধই ছিল ভয়াবহ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের নবম খন্ড এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ১ এ শুভপুর ব্রিজে ৪ বার সরাসরি যুদ্ধের কথা বর্ণিত আছে। এছাড়া এই ব্রিজের দখল নিয়ে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে হয়েছে অসংখ্য খন্ড যুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধের ২৫ মার্চ কালরাতে শুভপুর ব্রিজে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে স্থানীয় মুক্তিকামী জনতা। এর একমাত্র কারণ ছিল পাকিস্তানি বাহিনী যেন চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে না পারে। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি অফিসার ও সেনারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে অবাঙালি সেনা অফিসারদের বন্দি করে ফেললে বাঙালি সেনাদের হাতে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে চট্টগ্রাম নগরী। ধারণা করা হচ্ছিল কুমিল্লায় থাকা চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের পাকিস্তানি সেনারা সড়ক পথে চট্টগ্রামে গিয়ে আক্রমণ চালাতে পারে। সেক্ষেত্রে যদি কোনোভাবে শুভপুর ব্রিজ ধ্বংস করা যায় তাহলে হানাদারদের চট্টগ্রামের দিকে যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। ব্রিজ মেরামত করে চট্টগ্রামে পৌঁছাতে হানাদারদের বেশি সময় লাগবে। ফলে সেদিন রাতেই তাৎক্ষনিকভাবে সিদ্ধান্ত হয় শুভপুর ব্রিজ ধ্বংসের।

শুভপুর ব্রিজ ধ্বংসের দায়িত্ব নেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর-১ এর সাব সেক্টর কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। ২৫ মার্চ রাতে করেরহাট বাজারে এক জরুরি সভায় তিনি ব্রিজ ধ্বংসের আহ্বান জানান। এরপর স্থানীয় জনতা ড্রাম ভর্তি কেরোসিন তেল ও বিটুমিন ব্রিজে ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। কিন্তু কুমিল্লা থেকে আসা পাকিস্তানি সেনারা ব্রিজের পাটাতনে মোটা তারের নেট বিছিয়ে পার হয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা শুভপুর ব্রিজ নিজেদের দখলে রাখার জন্য এক সেকশন সেনা মোতায়েন করে যায়।

শুভপুর ব্রিজে প্রথম যুদ্ধশুভপুর ব্রিজে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর প্রথম যুদ্ধ হয় ২৯ মার্চ। এদিন করেরহাট হাই স্কুলে একটি আলোচনা সভায় শুভপুর ব্রিজ দখলের আহ্বান জানান ওবায়দুল হক খন্দকার। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্থানীয় যুবক ও পশ্চিম অলিনগর বিওপি ক্যাম্পের ইপিআর সেনারা ব্রিজ দখলের জন্য ছুটে যান। প্রথমে তারা অতর্কিত আক্রমণ চালালেও একপর্যায়ে হানাদাররা এলএমজি, মেশিনগানের মাধ্যমে গুলিবর্ষণ শুরু করলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।

Advertisement

শুভপুর ব্রিজে দ্বিতীয় যুদ্ধহাবিলদার মইন উদ্দিন ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও স্থানীয় তরুণদের সংগঠিত করেন। সিদ্ধান্ত হয় যেভাবেই হোক শুভপুর ব্রিজ দখল নিতেই হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাবিলদার আবুল হাশেমসহ কয়েকজন ইপিআর সেনা অবস্থান নেন ব্রিজের পূর্ব পাশের একটি পুকুরপাড়ে। তখন পাকিস্তানি সেনারা ব্রিজের উভয় পাশে বাঙ্কার করে সুরক্ষিত অবস্থায় ছিল। ৩১ মার্চ ভোরে হাবিলদার মইন উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কারে অবস্থানরত হানাদারদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। একইসঙ্গে আবুল হাশেমের নির্দেশে ব্রিজের পূর্ব দিক থেকে চালানো হয় ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলাবর্ষণ। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সেনারাও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরু হয় ২ পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ। যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা বিক্ষিপ্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তখন তারা প্রাণ বাঁচাতে পালাতে শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ৭ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। এসময় গ্রামবাসীও ধাওয়া করে এক হানাদার সেনাকে ধরে গণধোলাই দিয়ে হত্যা করে। বাকিরা সেতুর পূর্ব দিক দিয়ে পাহাড়ে আত্মগোপন করে। হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন ইপিআর হাবিলদার আবুল হাশেমসহ ৩ জন ইপিআর সেনা। এরপর শুভপুর ব্রিজ চলে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে।

আরও পড়ুন: প্রাচীন বাংলাসহ ১৩০ দেশের মুদ্রা সংগ্রহে তার 

শুভপুর ব্রিজের তৃতীয় যুদ্ধ২৩ এপ্রিল ফেনী ও ২৫ এপ্রিল করেরহাটে মুক্তিবাহিনীর পতন হওয়ার পর শুভপুর ব্রিজে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজের দক্ষিণপ্রান্ত থেকে উত্তরপ্রান্তে গিয়ে বাঙ্কার খনন করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। এর পরপরই হানাদাররা করেরহাট থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান বরাবর কামান ও ফেনী নদীর তীর পর্যন্ত ট্যাংক বহর এনে গোলাবর্ষণ শুরু করে। এসময় মুক্তিযোদ্ধাদের সব বাঙ্কারই উড়ে যায় এবং বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন। কিছু পাকিস্তানি সেনা তখন নদী পার হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান বরাবর আসার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু তারা নদীর মাঝামাঝি এসে ২ পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যায়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা অপ্রত্যাশিত সুযোগ পেয়ে গুলিবর্ষণ চালালে শতাধিক হানাদার সেনা নিহত হয়। বাধ্য হয়ে হানাদার সেনারা পিছু হটে।

শুভপুর ব্রিজের চতুর্থ যুদ্ধ১১ মে শুভপুর ব্রিজের কাছাকাছি চলে আসে হানাদাররা। তখন ব্রিজ প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন সুবেদার ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে থাকা ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা। শুভপুর ব্রিজ দখলের লক্ষ্যে উত্তর ও পশ্চিম দিকে এক ব্যাটালিয়ন সেনা সমাবেশ ঘটায় হানাদার বাহিনী। তখন মুক্তিযোদ্ধারা ভারত সীমান্তকে পিছনে রেখে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। ১২ মে সকাল ১১ টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের শুভপুর ব্রিজের অবস্থানের ওপর অতর্কিত আর্টিলারি ফায়ার শুরু করে হানাদার বাহিনী। দিনব্যাপী চলা যুদ্ধে শহীদ হন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তীব্র গোলাবর্ষণের কারণে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সরিয়ে আনা, তাদের সাহায্যের জন্য নতুন সেনা পাঠানো এবং খাবার সরবরাহ তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে। একটানা যুদ্ধ ও তীব্র ক্ষুধায় পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধারা। এরমধ্যে সামান্য ৩০৩ গাদা বন্দুক, ১ টি পুরোনো ভারি মেশিনগান ও ২টি হালকা মেশিনগান দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে তাদের পক্ষে। বিকেল ৫ টার দিকে ট্যাংকের গোলাবর্ষণে নষ্ট হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগানগুলোও। তখন হানাদাররা ৪০০ গজের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। শেষমেশ বাধ্য হয়ে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযোদ্ধারা। তখন সীমান্তবর্তী এলাকায় যারা ছিলেন তারা নিরাপদে পিছু হটতে পারলেও বাকি মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রের অভাবে একপর্যায়ে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত অসীম বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে শহীদ হন।

এই যুদ্ধগুলো ছাড়াও শুভপুর ব্রিজ দখল নিয়ে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর এবং নভেম্বর মাসে অসংখ্য খন্ড যুদ্ধ হয়েছে। ৬ ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক ধরে ৯ ডিসেম্বর শুভপুর ব্রিজ দখল করেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর-১ এর সাব সেক্টর কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন আগে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে শুভপুর ব্রিজ ধ্বংস করে পাকসেনাদের চট্টগ্রামে ঢুকতে বাঁধা দেওয়ার পরিকল্পনার কথা বলি। তখন তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলে -‘সাবাস’। বঙ্গবন্ধুর এ অনুপ্রেরণায় আমি পরবর্তীতে সফলভাবেই এই কাজটি করতে পেরেছিলাম এবং এই যে শুভপুর ব্রিজ ধ্বংস করে পাকসেনাদের চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশে ২ দিন দেরী করা হয় এতে একটি বড় গণহত্যা থেকে রক্ষা পেয়েছিল চট্টগ্রামবাসী।

শুভপুর ব্রিজ ধ্বংসের কথা কেন ভাবলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ বলেন, ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে আমার এটাই মনে হয়েছিল সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া বাংলাদেশকে স্বাধীন করা সম্ভব নয়। মুক্তিসংগ্রাম অবশ্যাম্ভাবী ভেবে চট্টগ্রাম ও ঢাকার সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগের একমাত্র ভরসা শুভপুর ব্রিজকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা আসে আমার মাথায়। আমি মনে করলাম যদি শুভপুর ব্রিজকে ধ্বংস করা যায়, তাহলে চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হবে। এতে করে চট্টগ্রামকে কয়েকদিনের জন্য হলেও মুক্ত রেখে চট্টগ্রাম থেকে যুদ্ধ পরিচালনা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ বলেন, ২৫ মার্চ সকাল থেকেই থমথমে ভাব। সবার চোখেমুখে বিদ্রোহের ছাপ। ওইদিন ২৬ টি ট্রাকবোঝাই পাকিস্তানি সৈন্য কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে চট্টগ্রামের দিকে রওনা দেয়। পূর্বের পরিকল্পনা মত আমি বিকাল ৫ টার দিকে অন্য সঙ্গীদের নিয়ে শুভপুর ব্রিজ ধ্বংস করার প্রস্তুতি নিতে থাকি। আমরা শুভপুর ব্রিজে গিয়ে দেখি দু’দিকে সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে তাদেরকে নিরস্ত্র করলাম। মুহূর্তেই আমরা পরিকল্পনা মত কাজ শুরু করে দিলাম। ব্রিজের লোহার ফ্রেমের উপর বসানো কাঠের পাটাতনে বিটুমিন ঢেলে দিয়ে তাতে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিলাম। কাঠের পাটাতনগুলো বিকট শব্দ করে জ্বলতে শুরু করলো। তবে বিস্ফোরক না থাকায় ব্রিজটি পুরোপুরি ধ্বংস করা যায়নি। তারপরও ব্রিজটি অকেজো করে দেওয়া সম্ভব হয়।

গুপ্তচর মারফৎ আমরা খবর পেলাম, অনেক দূর থেকে পাকবাহিনীর অগ্রবর্তী দল আগুনের লেলিহান শিখা দেখে ভয় পেয়ে যায়। দুর্ঘটনার আশঙ্কায় তারা সাময়িক যাত্রা বিরতি করে। শুভপুর ব্রিজে এই বাধা না পেলে এবং মিরসরাই-সীতাকুন্ডের জনগণ সড়কে ব্যারিকেড না দিলে এই পাক সৈন্যরা ২৫ মার্চ রাতেই চট্টগ্রাম পৌঁছে যেত। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট এবং বন্দরের পাক সেনাদের সঙ্গে যৌথভাবে শক্তি বৃদ্ধি করে শহর দখল করতে পারত। চট্টগ্রামে সংগঠিত হত আরেকটি গণহত্যা। শুধু তাই নয়, ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করাও হয়ত সম্ভব হত না।

মিরসরাই থানার তৎকালীন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মীর্জা ফিরোজ বলেন, ‘শুভপুর ব্রিজ নিয়ে এত যুদ্ধ হওয়ার একটাই কারণ। তা হলো আমরা মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানিরা ২ পক্ষই চাইতাম যে করেই হোক শুভপুর ব্রিজের দখল নিজেদের হাতে রাখতে হবে। তাহলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডও আমাদের দখলেই থাকবে।’

শুভপুর সেতুর যুদ্ধগুলো কতটা ভয়াবহ ছিল সেবিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা আলী আহমদ বলেন, ‘এপ্রিল-মে মাসের দিকে রাতে আমরা বাড়িতে ঘুমানো তো দূরের কথা, বাড়ির ধারেকাছেও থাকতে পারতাম না। গোলাগুলির শব্দে যেন কানের পর্দা ফেটে যাবে। পায়ের তলার মাটি থরথর করে কাঁপতো। ব্রিজের ধারেকাছেও আসার উপায় ছিল না। দিন নাই, রাত নাই খালি গোলাগুলির শব্দ।’

আরও পড়ুন: ঝিনাইদহের ১১ শহীদ বুদ্ধিজীবীর আত্মত্যাগ 

বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন জানান, শুভপুর ব্রিজের যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ বলে স্বীকৃত। কারণ চট্টগ্রামের যত মুক্তিযোদ্ধা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং আশ্রয় নেন তারা এ শুভপুর ব্রিজ অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। ব্রিজের ১০ নম্বর পিলারে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিলে এই অংশ হানাদারমুক্ত। ১৯৮০’র দশকে সরকারি অর্থায়নে শুভপুর ব্রিজের যুদ্ধ নিয়ে ‘কলমি লতা’ নামে একটি ছায়াছবিও নির্মিত হয়েছিল। এছাড়া ১৯৯৬ সালে বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উদ্যোগে ও অংশগ্রহণে শুভপুর ব্রিজ নিয়ে যুদ্ধভিত্তিক একটি প্রামাণ্য চিত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। ব্রিজের খুব কাছাকাছি গেলে এখনো দেখা যায় অসংখ্য বুলেট ও কামানের আঘাতের চিহ্ন। যা স্মরণ করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের কথা।

মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘শুভপুর ব্রিজ মুক্তিযুদ্ধের বহু স্মৃতি বহন করছে। ১৯৭১ সালে এ ব্রিজের উপর পাকহানাদার বাহিনী অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। কিন্তু শঙ্কার বিষয় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় ধ্বংসের মুখে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী ব্রিজটি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আহম্মদুর রহমান বলেন, ‘২৫ মার্চ রাতে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের নির্দেশ পেয়ে দেরি না করে চারদিকে মুক্তিকামী জনতাকে খবর দেওয়া হয়। করেরহাট বাজারের মজুমদারের পেট্রোল পাম্প থেকে পেট্রোল, কেরোসিন, ডিজেল; আশপাশের বাড়ি থেকে লাকড়ি এবং করেরহাট সিএমবি অফিস (বর্তমানে সওজ অফিস) থেকে বিটুমিন ভর্তি ড্রাম সংগ্রহ করা হলো। রাত একটা-দেড়টার দিকে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে আমরা ২০-৩০ জন ব্রিজে প্রতিরোধের চেষ্টা চালাই। পরে মানুষের সমাগম বাড়ে। মোশাররফ ভাই ব্রিজের পাশের খড়ের ঘর ভেঙে ব্রিজের পাটাতনে আগুন দেন। পরে জনতার উদ্দেশে ভাষণে সবাইকে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন এবং শুভপুর ব্রিজ ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

মিরসরাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা কবির আহম্মেদ বলেন, ‘২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের আটকাতে মিরসরাইয়ের বেশকিছু স্থানে প্রধান প্রধান সড়কে ব্যারিকেড দেয় মুক্তিকামী জনতা। ২৭ মার্চ বড়তাকিয়া ও মিরসরাই সদরে জনতার ব্যারিকেড ভাঙতে পাকিস্তানি সেনারা হেলিকপ্টার থেকে মর্টার শেল ছোড়ে। এতে চার-পাঁচজন শহীদ হন। রক্তাক্ত হন অসংখ্য লোক।

অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই শুভপুর ব্রিজের এক কিলোমিটার দক্ষিণে করেরহাট এলাকায় গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। করেরহাট ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম ইসমাঈল মিন্টু মিয়া ছিলেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। ২৫ মার্চ রাতে মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর-১ এর সাব সেক্টর কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিতেন্দ্র প্রসাদ নাথ মন্টু, শাহ্ আলম চৌধুরী ও আওয়ামী লীগ নেতা মিহির চৌধুরী আসেন করেরহাটে। তারা স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির নেতাদের ডেকে বলেন, ‘কুমিল্লা সেনা ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি আর্মি যেন চট্টগ্রাম অভিমুখে না যেতে পারে সেজন্য শুভপুর ব্রিজে অবরোধ সৃষ্টি করে ধ্বংস করতে হবে’।

কেএসকে/জিকেএস