দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে চলছে ধীরগতি। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের এমন দৈনদশা যেন কাটছেই না। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এই ধীরগতির সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ফলে বিগত আটটি অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর)। যার প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড়ে।
Advertisement
২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় কমেছে ১৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অর্থছাড় কমলেও বেড়েছে সুদ-আসলসহ ঋণ পরিশোধের চাপ। এসময় ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩৪ শতাংশ বেশি। তবে বেড়েছে দাতা সংস্থাগুলোর ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। চলতি অর্থবছর ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে আগের অর্থবছরের তুলনায় ৯২ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) বৈদেশিক ঋণছাড়ের তথ্য প্রকাশ করেছে ইআরডি।
আরও পড়ুন: বছরজুড়ে ডলার সংকট, খেলাপি ঋণে রেকর্ড
Advertisement
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের পাঁচ মাসে বৈদেশিক অর্থছাড় হয়েছে ২১১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্থছাড় এসেছিল ২৪৬ কোটি ২৪ লাখ ডলার। অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৩৫ কোটি ১৪ লাখ ডলার কম অর্থছাড় করেছে দাতা সংস্থাগুলো।
অর্থছাড় কম হলেও বেড়েছে ঋণ পরিশোধের চাপ। সরকার চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে সুদ আসলসহ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে এক হাজার ৪৬৪ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। যেখানে সুদের পরিমাণ ২৩ কোটি ৭৬ লাখ এবং আসল ৬৪ কোটি ২৭ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল ৮৪৩ কোটি ৭ লাখ ডলার। অর্থাৎ, বছরের ব্যবধানে ৬২১ কোটি ৪০ ডলার বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে।
তবে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি। গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম পাঁচ মাসে সরকার বৈদেশিক বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল মাত্র ৪৬ কোটি ১৩ লাখ ডলার। সেখানে চলতি অর্থবছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ৫৮৫ কোটি ৯১ লাখ ডলার। অর্থাৎ, বছরের ব্যবধানে ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ৫৩৯ কোটি ৭৮ লাখ ডলার।
চলতি অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি অর্থছাড় করেছে জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম পাঁচ মাসে দেশ দুটি অর্থছাড় করেছে ৬১ কোটি ৯ লাখ ডলার। যদিও দেশ দুটি থেকে গত অর্থবছরে এসেছিল ৭৪ কোটি ২৭ লাখ ডলার। এসময়ে বিশ্বব্যাংক অর্থছাড় করেছে ৩৮ কোটি ৭৯ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৩ কোটি ৭৪ লাখ ডলার কম। ইউরোপ থেকে অর্থ এসেছে ৪৫ কোটি ২৩ লাখ ডলার। এডিবি অর্থছাড় করেছে ৪৪ কোটি ৪২ লাখ ডলার। সংস্থাটি আগের অর্থবছর অর্থছাড় করেছিল ৩১ কোটি ৯৪ লাখ ডলার।
Advertisement
আরও পড়ুন: খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি
সবচেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে এডিবি থেকে। সংস্থাটি ২০৬ কোটি ২ লাখ ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জাপানের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ১৫০ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। বিশ্বব্যাংক দিয়েছে ১৪১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের প্রতিশ্রুতি। তবে অর্থবছরের পাঁচ মাসেও চীন, ভারত ও রাশিয়া থেকে কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। যদিও রাশিয়া থেকে ৪৩ কোটি ৯৯ লাখ, ভারত থেকে ৯ কোটি ২৪ লাখ এবং চীন থেকে ৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার অর্থছাড় হয়েছে।
অর্থছাড় কম হওয়ার বিষয়ে ইআরডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা ছাড়া অর্থছাড় কমার অন্যতম কারণ হলো বাজেট সহায়তা। এর আগের বছরে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পেয়েছিল সরকার, যার মধ্যে কিছু বাজেট সহায়তার অর্থছাড় হয়েছিল অর্থবছরের শুরুর দিকে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে এখনো কোনো বাজেট সহায়তা আসেনি।
যদিও সরকার এডিবি, বিশ্বব্যাংক, এআইআইবির কাছ থেকে বাজেট সহায়তা নেওয়ার প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু করেছে বলেও ইআরডি সূত্রে জানা গেছে।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, সরকারি সংস্থাগুলোর ব্যয় করার সীমিত সক্ষমতা এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলমান হরতাল-অবরোধ পরিস্থিতির কারণে দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অর্থছাড় কম হচ্ছে। এতে করে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি বাড়াতে পারলে অর্থছাড় বাড়বে।
আরও পড়ুন: এডিবির ঋণের ৪০ কোটি ডলারও যুক্ত হয়েছে রিজার্ভে
অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থবছরের শুরুর প্রস্তুতিগত কাজের কারণে অর্থছাড় এমনিতে কম থাকে। এরমধ্যে অর্থনৈতিক সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ সংকট এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি– সবকিছু মিলিয়ে অনেক প্রক্রিয়াগত কাজ এগোচ্ছে না। এ অবস্থায় অর্থছাড় কমেছে এবং আগামীতে আরও কমতে পারে। তবে অর্থনৈতিক সংকট থাকলেও আমাদের ঋণ পরিশোধ করতেই হবে। কারণ, মেগা প্রকল্পের জন্য অতীতে যেসব ঋণ নেওয়া হয়েছে সেগুলো পরিশোধের সময় চলে এসেছে।
এমওএস/এমকেআর/জেআইএম