মতামত

বিএনপির আন্দোলন কী বার্তা দেয়

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। দেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপিসহ আরো কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। বিএনপির নির্বাচন বর্জন এবার নতুন নয়, ২০১৪ সালেও তারা নির্বাচন বর্জন করে। বিএনপির দাবি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।

Advertisement

অন্যদিকে বর্তমান সরকারের দাবি সংবিধানের মধ্যে থেকে নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে এ বিতর্ক অনেকদিনের। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পূর্বে বিএনপি অসহযোগ (non-cooperation) আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান লন্ডন থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তারেক রহমানকে অনুসরণ করে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহল কবির রিজভী তার দলের নেতা কর্মীদের বর্তমান সরকার ও দেশের সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দেন।

এ অসহযোগ আন্দোলনের আওতায় তাদের নেতা কর্মীরা পরিষেবার বিল, খাজনা, ট্যাক্স, ইত্যাদি প্রদান করবে না। ট্যাক্স, পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের বিল পরিশোধ স্থগিত করে সরকারকে সহযোগিতা না করার আহŸান জানান রিজভী। এখন প্রশ্ন হলো এ কোন ধরণের অসহযোগ আন্দোলন? দেশের নাগরিক হিসেবে সেবা গ্রহণ করলে সেবার বিল পরিশোধ করতে হবে। বিএনপি কি তাদের নেতা কর্মীদের আইন অমান্য করার দীক্ষায় দীক্ষিত করতে চাচ্ছে?

একটু পেছন ফিরে দেখে আশা যাক। অসহযোগ আন্দোলন সব যুগে একটি রাজনৈতিক প্রচারাভিযান হিসেবে ডাকা হয়েছে। ১৯২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মহাত্মা গান্ধী ভারতীয়দের ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। তিনি স্ব-শাসন আদায় করার জন্য এ ডাক দিয়েছিলনে।

Advertisement

এই আন্দোলনটি ছিল গান্ধীর প্রথম সংগঠিত বৃহৎ আকারের সত্যাগ্রহের একটি। গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ছিল ব্রিটিশ শিল্প ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ‘ব্রিটিশ সরকার এবং ভারতে অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য’ যেকোনো কার্যকলাপ থেকে তাদের শ্রম প্রত্যাহার করার জন্য সব ভারতীয়কে প্ররোচিত করা। অহিংস উপায়ে বা অহিংসের মাধ্যমে, প্রতিবাদকারীরা ব্রিটিশ পণ্য কিনতে, স্থানীয় হস্তশিল্পের ব্যবহার গ্রহণ করতে এবং মদের দোকানে কাজ করতে অস্বীকার করবে।

দ্বিতীয় অসহযোগ আন্দোলন ছিল পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের সেই বছরের মার্চ মাসে একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন। ১ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শুরু হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আহŸানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় ২ মার্চ এবং ২৫ মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। মোট ২৫ দিন ধরে চলা এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। এ আন্দোলন ছিল বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আবারো অসহযোগ আন্দোলনের ডাক এসেছে একটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে। সাধারণ জনগণের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, কী কারণে বিএনপি এ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলো? এই সময়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়ার কোনো কারণ, উপলক্ষ্য, কিংবা যৌক্তিকতা দেখি না। তাহলে দলটি কি রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেল?

বর্তমান সরকার নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক সব পন্থা অনুসরণ করে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। নির্বাচন কমিশন স্বাভাবিকভাবে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তফসিল ঘোষণা করে। রাজনৈতিক দলের কাজ হলো তফসিল অনুসররণ করে নির্বাচনে অংশ নেওয়া। প্রত্যেক গণতান্ত্রিক দেশে এমনই হয়ে থাকে। কিন্তু, বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলো নির্বাচনে আসার পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করে।

Advertisement

বিএনপি ও তাদের মিত্রদের অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেশের বিরুদ্ধে, দেশের তরুণদের বিরুদ্ধে, ও সুন্দর একটি ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে। তাদের উচিত হবে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি পরিহার করে, জনগণের কাছে যাওয়া। নির্বাচনে অংশ নেওয়া। গণতান্ত্রিক পন্থা যেকোনো সহায়ক ধ্বংসাত্মক পন্থার চেয়ে উত্তম।

প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকার আছে দাবি করা, দাবি আদায় করার জন্য রাজপথে আন্দোলন করা। কিন্তু, সে আন্দোলন করতে হবে নিয়মতান্ত্রিক এবং সংবিধানের মধ্যে থেকে। অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলাফল কখনো কোনো ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে না। বিএনপির আন্দোলন নিয়মতান্ত্রিক নয়। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে দেশবিরোধী ও জনবিরোধী মানসিকতার পরিচয় ফুটে উঠেছে।

নির্বাচন প্রতিহত করার নামে ২৮ নভেম্বর বিএনপি ও তাদের মিত্ররা দেশব্যাপি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপর হামলাসহ একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। প্রধান বিচারপতির বাশভবনে হামলা চালায়। জনগণের জানমাল ও গাড়ি ভাঙচুর করে। এসবের উদ্দেশ্য নির্বাচকে প্রতিহত করা। দেশপ্রেমিক ও গণমুখী কোন রাজনৈতিক দল এসব ধংসাত্মক কাজ করতে পারে না। রাজনীতি বিজ্ঞানে একটি কথা আছে, ‘ব্যাক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ’। বিএনপি ও তার মিত্রদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে তারা দেশ নয়, বরং ব্যক্তির স্বার্থকে বড় করে দেখছে। কে সে ব্যক্তি? বিদেশ থেকে হুকুম দিয়ে কি কোনো অসহযোগ আন্দোলন করা যায়?

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, নতুন করে যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে তার কোনো প্রেক্ষাপট বাংলাদেশে বর্তমান নেই। দেশে উন্নয়নে মহাসড়কে। মানুষের জীবনমমান আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক ভালো। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে বাংলদেশের সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ মানব উন্নয়নের সব সূচকে অনেক দূর এগিয়ে।

বিএনপি ও তাদের মিত্ররা যদি অসহযোগ আন্দোলনের নামে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে, ধ্বংসাত্মক কাজ শুরু করে এবং দেশের সম্পদ নষ্ট করে সেটা অগ্রসরমান অর্থনীতির জন্যে বড় ক্ষতির কারণ হবে। সম্প্রতি কিছু কাজের নমুনা দেখা গেছে। রেল লাইনের স্লিপার তুলে ফেলা, ট্রেনের বগিতে আগুন দেওয়াসহ মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তাদের অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়ার সঙ্গে এসব জঘন্য কাজের মিল হয়েছে। শুধু মানুষ হত্যা নয়, সামাজিক অস্থিরতাও সৃষ্টি করছে। জনমনে ব্যাপক ভীতির সঞ্চার করছে। তাহলে এ কথা কি বলা যাবে না, এ সব দলগুলো পুরোপুরি সন্ত্রাসী দলে (terrorist organizations) পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা ও রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ অনেক দেশের অর্থনীতিকে সংকটে ফেলেছে। বাংলাদেশ একটি অগ্রসরমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে আরো বেশি সংকটের মুখোমুখি। ভূ-রাজনৈতিক দিক দিয়ে বড় দেশগুলোর নজর বাংলাদেশের দিকে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা জাতি আশা করে।

এহেন মুহূর্তে বিএনপি ও তাদের মিত্রদের অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেশের বিরুদ্ধে, দেশের তরুণদের বিরুদ্ধে, ও সুন্দর একটি ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে। তাদের উচিত হবে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি পরিহার করে, জনগণের কাছে যাওয়া। নির্বাচনে অংশ নেওয়া। গণতান্ত্রিক পন্থা যেকোনো সহায়ক ধ্বংসাত্মক পন্থার চেয়ে উত্তম। মনে রাখতে হবে, সংঘাত নতুন ধরনের সংঘাতের জন্ম দেয় (Violence breeds violence) । তাই, এসব নেতিবাচক পথ পরিহার করে গণতান্ত্রিক পন্থায় ফিরে এলে দলটির মঙ্গল হবে।

লেখক: অধ্যাপক শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/জেআইএম