বাংলা একাডেমি প্রণীত বাংলা অভিধানে একটি বানানের বিকল্প একাধিক বানান রাখায় তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি বাড়ছে বলে মনে করেন শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, গণমাধ্যমকর্মী, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা। বানান যথাসম্ভব এক রীতিতে আনতে বাংলা একাডেমিকে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও উল্লেখ করেছেন তারা।
Advertisement
‘বাংলা বানান: বর্তমান পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ করণীয়’ নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে অংশ নিয়ে এমন মতামত তুলে ধরেন তারা। বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে দিনব্যাপী এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, বিশ্বের কোনো ভাষার অভিধানে বিকল্প বানান রাখা হয় না। শুধু বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি প্রণীত অভিধানে এ রীতি দেখা যায়। ফলে ছোট থেকে শিশুরা যখন একাধিক বানান দেখে বড় হয়, তখন তাদের মধ্যে ভুল করার প্রবণতাও বাড়ে। পাশাপাশি পত্র-পত্রিকাগুলো অভিধানের যেকোনো একটি বেছে নিয়ে থাকে। এতে এক পত্রিকা যা লেখে, অন্য পত্রিকা তার বিকল্পটা বেছে নেয়। এটি বানানের জগতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দেয়।
সেমিনারে ‘বাংলা বানান: সমস্যার ক্ষেত্র ও সমাধানের উপায়’ নিয়ে আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তারিক মনজুর। তিনি বলেন, ‘বানানের আদৌও নিয়ম বলে কিছু আছে কি না, সেটাই তো বড় প্রশ্ন। তবে, বিশৃঙ্খলা বা বিভ্রান্তি এড়াতে অভিধানই এর সমাধান। কারণ কেউ সন্দেহ-সংশয়ে পড়লে অভিধান খুলে বানানটা খোঁজেন।’
Advertisement
বানান নির্ধারণ প্রশ্নে সমালোচনার মুখে বাংলা একাডেমি ভেঙে পড়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি, বাংলা একাডেমি কারণে-অকারণে ভেঙে পড়ে। গরু ও ঈদ বানান নিয়ে সমালোচনার মুখে তারা বিবৃতি দিতেও বাধ্য হয়েছে যে, আমরা এগুলো পুনর্বিবেচনা করবো। কিন্তু এ দ্বিধাটা কেন? তার মানে কি বাংলা একাডেমি নিজের অবস্থান নিয়ে সচেতন নয়? তারা যেটা করেছেন বা করছেন তা হয়তো ভুল অথবা ঠিক কাজ করেও জনগণের চাপে ভেঙে পড়েছেন। অথচ ভাষার ক্ষেত্রে বানান খুবই গৌণ ব্যাপার। এটা নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হওয়াটাই উচিত নয়।’
বাংলা একাডেমির অভিধান ও বিশ্বকোষ উপবিভাগের কর্মকর্তা রাজীব কুমার সাহা বলেন, ‘বাংলা বানানের বিকল্প যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে। একটি বানানকে একমুখী করার চেষ্টা করা উচিত। বানান নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে সেটা থামানোর জন্য হুটহাট পরিবর্তনের দিকে ঝুঁকে পড়াও উচিত নয়। তাতে আরেকটি বিতর্কের শুরু হয়। পাশাপাশি বিদেশি শব্দে আত্তীকরণে সতর্ক থাকতে হবে।’
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ড. এম আবদুল আলীম বলেন, ‘কথায় কথায় আমরা প্রতিষ্ঠানকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই। এতে কোনো কৃতিত্ব নেই। বরং আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। আজকে যে আয়োজন এখানে করা হয়েছে, তা নিয়মিত আয়োজনে পরিণত করতে হবে। অংশীজনদের ডাকতে হবে। তাদের কথা শুনতে হবে এবং ভালো পরামর্শ গ্রহণ করে সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে।’
প্রথম আলোর সাহিত্য সম্পাদক আলতাফ শাহনেওয়াজ বলেন, ‘প্রথম আলো প্রকৃত অর্থে আলাদা কোনো বানানরীতি মেনে চলে না। আমরা অভিধানে থাকা যেকোনো একটি বানান বেছে নিয়ে থাকি। আমাদের নিজস্ব কোনো বানানরীতিও নেই।’
Advertisement
মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের উপ-পরিচালক স্নিগ্ধা বাউল বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে বানান ভুল ধরলেই কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হন। আবার প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক কাজ করা কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের এ নিয়ে জানাশোনাও নেই। তারা ভুল করেন। তাদের নিয়েও প্রশিক্ষণের আয়োজন করা উচিত।’
এর আগে উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান বলেন, ‘ভাষা গতিশীল হবে এটা স্বাভাবিক। এ নিয়ে অতি বিপ্লবী হওয়ার প্রয়োজন নেই। বাংলা একাডেমিকে আরও গুরুত্বসহকারে কাজ করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের ঐতিহ্য ও রীতি বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।’
সভাপতির বক্তব্যে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ বলেন, বাংলা একাডেমির প্রতি মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তারাই সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোতে বাংলা অভিধান অনুযায়ী বানানরীতির ব্যবহার নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলা একাডেমি সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। বাংলা একাডেমি এখন পর্যন্ত ড. জনসনের মতো একটি সর্বজনগ্রাহ্য অভিধানও তৈরি করতে পারেনি। তারা যদি সেটি করতে পারতো, বানানরীতি নিয়ে কারও কোনো ধোঁয়াশা থাকতো না।
সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মফিদুর রহমান। অন্যদের মধ্যে আলোচনা করেন বাংলা একাডেমির অভিধান ও বিশ্বকোষ উপবিভাগের কর্মকর্তা মতিন রায়হান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সম্পাদক ড. মো. ছাইদুর রহমান, ভাসানটেক সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ড. মো. হাননান মিঞা, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংস্কার ও গবেষণা অনুবিভাগের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ বিশেষজ্ঞ কাজী জুলফিকার আলী প্রমুখ।
এএএইচ/এমএএইচ/জিকেএস