জাতীয়

রিকশা আছে, নেই রিকশাআর্ট

ঢাকাকে বলা হয় রিকশার নগরী। ঢাকা তো বটেই, দেশের অন্যান্য শহর-নগর থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জেও তিন চাকার রিকশা যাতায়াতের অন্যতম বাহন। রিকশা শুধু ঐতিহ্য নয়, আরামদায়ক এবং কারুকার্যময় একটি বাহন। রিকশার আরোহীরা যেমন রিকশায় চলাচল উপভোগ করেন, তেমনি রিকশার পেছনো সাঁটানো টিনের শিটে (ঝুলবোর্ড) নানা চিত্রকর্ম মুগ্ধ করতো পথচারীদের। একই সঙ্গে নানা ধরনের বাণী ও হাস্যরসাত্মক উক্তি ছড়িয়ে দিতো মানুষের মধ্যে। বিচিত্র জীবজন্তু, ফুল, পাখি, লতাপাতা কিংবা চলচ্চিত্র তারকাদের চিত্র দিয়ে চাকচিক্য করে তোলা হতো রিকশাকে। ঠাঁই পেতো মনীষী বা বিখ্যাত ব্যক্তিদের চিরন্তন বাণী ও বিভিন্ন হাস্যরসাত্মক উক্তি। তবে টিনের পাতে ফুটে ওঠা দেশীয় এই সংস্কৃতি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।

Advertisement

শহরের বুকে এখনো রিকশা দাঁপিয়ে বেড়ালেও রিকশার পেছনে টিনের শিট এখন প্রায় ম্রিয়মাণ। ডিজিটাল প্রযুক্তির আবির্ভাবে রিকশাচিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিতে নানান ধরনের পেইন্টিং ও চিত্রকর্ম অল্প সময়ে ও কম খরচ হওয়ায় রিকশাওয়ালারা সেদিকেই ঝুঁকছেন। রিকশাচিত্রের শিল্পীরাও রঙ-তুলি থেকে দূরে সরে গেছেন। ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে রিকশাচিত্রের ঐতিহ্য।

বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের ইতিহাসে রিকশাচিত্রকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। সম্প্রতি ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র ইউনেস্কোর ‘অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আফ্রিকার বোতসোয়ানার কাসানে শহরে ‘অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ সংরক্ষণ বিষয়ক কনভেনশনের আন্তঃরাষ্ট্রীয় পরিষদের সভায় এ বৈশ্বিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এতে রিকশার চিত্রশিল্পীরা সন্মানিত বোধ করছেন। তবে রিকশাচিত্রের এসব স্বীকৃতি মিললেও রিকশার পেছনে নেই রিকশাচিত্রের ছাপ।

আরও পড়ুন>> ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেলো ঢাকার রিকশা ও রিকশাচিত্র

Advertisement

চিত্রশিল্পীরা জানিয়েছেন, ৯০ দশকে রিকশাচিত্রের যে জনপ্রিয়তা ছিল সেটি হারাতে বসেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশে এখন কেউ বেশি দাম দিয়ে রিকশাচিত্র বানাতে চান না। সবাই এখন প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। রঙ ও পারিশ্রমিক বেশি হওয়ার কারণে কেউ পেইন্টিং করতে চান না। ডিজিটালে নামমাত্র মূল্যে পেইন্টিং পাওয়ায় রিকশাওয়ালারা বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে রিকশাচিত্র বানাতে চান না।

পুরান ঢাকার হোসেনি দালান রোডের ছোট্ট একটি ঝুপড়ি দোকানে রিকশাচিত্র, সিনেমার পোস্টার, ও গৃহস্থালির নানান অনুষঙ্গের কাজে ব্যস্ত ছিলেন ডেনমার্ক ফিল্ম ব্যানার ফেস্টিভ্যালে অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত রিকশা চিত্রশিল্পী হানিপ পাপ্পু। ৫৫ বছর থেকে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত তিনি। সেখানে কথা হয় তার সঙ্গে।

এই চিত্রশিল্পী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মূলত ফিল্ম ব্যানার নিয়ে কাজ করতাম। ৯০ দশকের হিট হিট ছবিগুলোর পোস্টার আঁকতাম। এই জনপ্রিয় ছবিগুলোর ফ্রেম রিকশার পেছনে টিনশেডে স্থান পেতো। তখন রিকশার মালিকরা খুব সৌখিন ছিলেন। সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী খরচ কম ছিল। তারা এসে আবদার করে বলতেন, পাপ্পু ভাই আমাকে নিশান ছবির ১০টা ফ্রেম করে দেন বা বেদের মেয়ে জোৎস্না ছবির ফ্রেম করে দেন। সেই থেকে ফিল্ম ব্যানারের পাশাপাশি রিকশাচিত্র আঁকা শুরু করি। এরপর ডিজিটাল প্রযুক্তি আসার পর রঙ ও আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় ২০০০ সালের পর থেকে রিকশাচিত্রের চাহিদা ধীরে ধীরে হারাতে থাকে।

তিনি বলেন, ‘রিকশায় সাধারণত পশু-পাখি, ফুল, লতাপাতার পাশাপাশি ৯০ দশকের জনপ্রিয় সিনেমাগুলোর ফ্রেম রিকশাচিত্রে বেশি স্থান পেতো। ‘নিশান’, ‘বেদের মেয়ে জোৎস্না’, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’র মতো ছবিগুলোর ফ্রেম এখনো রিকশার পেছনে টিনশেডে সাঁটানো আছে।’

Advertisement

আরও পড়ুন>> বাংলা একাডেমি থেকে ১১১ রিকশা চিত্রশিল্পীকে সম্মাননা

এই শিল্পী বলেন, ‘একটি রিকশাচিত্র আঁকতে এখন কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা নিই আমরা। এতে সময় লাগে তিন থেকে চারদিন। ডিজিটালে একটা রিকশাচিত্র আঁকিয়ে নিতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা লাগে। তাহলে নিম্নআয়ের রিকশাওয়ালারা কেন এত টাকা দিয়ে রিকশাচিত্র আঁকবেন?’

হানিফ পাপ্পু বলেন, ‘চাহিদা কমে যাওয়ায় শিল্পীরা এখন গৃহস্থালি ও ঘর সাজানোর নানান অনুষঙ্গে রিকশাচিত্র আঁকছেন। মানুষ ঘরের আসবাবপত্রে ও অবকাঠামোতে এখন রিকশাচিত্র আঁকিয়ে নিচ্ছেন। এভাবে কিছুটা রিকশাচিত্রের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন শিল্পীরা।’

এই রিকশা চিত্রশিল্পী বলেন , ‘এ শিল্প একেবারে বিলীন হয়ে যাবে। আমরা যে কয়েকজন বেঁচে আছি তারা শিল্পটাকে ধরে রেখেছি। আমরা মরে গেলে রিকশাচিত্র হারিয়ে যাবে। সরকার যদি একটি পরিকল্পনা করে, একটি প্রতিষ্ঠান করে, যেখানে আমরা তরুণ প্রজন্মকে এই আর্ট শেখাবো, কমমূল্যে রিকশাচিত্র তৈরি করবো। তা না হলে রিকশাচিত্র ধরে রাখার জন্য কাউকে পাওয়া যাবে না ‘

হানিফ পাপ্পুর পাশাপাশি শহরের যে কয়েকজন শিল্পী রিকশাচিত্রের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম পুরান ঢাকার রিকশা পেইন্টার সোলায়মান। লক্ষীবাজারের মহানগর মহিলা কলেজের পেছনের গলিতে তার দোকান। সেখানেই কথা হয় এই শিল্পীর সঙ্গে।

আরও পড়ুন>> বাংলাদেশে রিকশা এলো কীভাবে?

চিত্রশিল্পী সোলায়মান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন শহর-গ্রামে যে রিকশাগুলো ছুটে চলছে এগুলোর পেছনে তাকালেই বোঝা যাবে এই রিকশাচিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। সব রিকশার পেছনে ডিজিটাল প্রযুক্তির পোস্টার সাঁটানো। প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এই ঐতিহ্য ধরে রাখা এখন কষ্টসাধ্য। আমরা অন্যান্য কাজ করে মোটামুটি খেয়েপরে বেঁচে আছি।’

রিকশাচিত্রের বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক বজলুর রশিদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের দেশের রিকশাচিত্রের সৌন্দর্য আসলে আমরা ধরতে পারিনি। বিদেশিরা আমাদের মাটিতে এসে রিকশাচিত্র দেখে একটা ফ্যান্টাসি অনুভব করেছেন। সেজন্য ইউনেস্কো থেকে স্বীকৃতি এসেছে। দেশেও রিকশাচিত্রকে ঐতিহ্যবাহী আর্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। বর্তমানে হানিফ পাপ্পু, বাহারামসহ হাতেগোনা কয়েকজন শিল্পী এই সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছেন। সরকারের উচিত এখানে ভর্তুকি দেওয়া, যেন শিল্পীরা কমমূল্যে রিকশাওয়ালাদের কাছে এই চিত্র বিক্রি করতে পারেন।’

আরও পড়ুন>> ‘আজ অন্তত রিকশা নিরাপদ মনে করছি’

তিনি বলেন, ‘এই চিত্রকে ধরে রাখতে বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউটে রিকশা পেইন্টারদের নিয়ে আমরা স্টুডেন্টদের ওয়ার্কশপ করাচ্ছি। প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে না টিকে থাকতে পারলেও এই পেন্টিং যেন অন্যকিছুতে টিকে থাকে আমরা সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

জানা যায়, ১৯৮৮ সালে লন্ডনে মিউজিয়াম অব ম্যানকাইন্ডে শিরিন আকবরের কিউরেটিংয়ে ঢাকার রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘ট্রাফিক আর্ট: রিকশা পেইন্টিং ফ্রম বাংলাদেশ’। ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের সুসজ্জিত ও চিত্রিত রিকশা সংগৃহীত আছে। এছাড়া জাপানের ফুকুয়োকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী হয়েছে। ২০১৩ সালে জাপানের তাকামাতসু শহরে একটি আর্ট ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের রিকশাচিত্র বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে। নেপালেও হয়েছে বাংলাদেশের রিকশাচিত্রের প্রদর্শনী। বাংলাদেশে রিকশা পেইন্টিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনীটি হয়েছে ১৯৯৯ সালে ঢাকায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে।

আরএএস/ইএ/জেআইএম