শাহরিয়ার কবির। সাংবাদিক, কলামিস্ট, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা। একজন খ্যাতনামা শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও পরিচিত তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন দীর্ঘদিন ধরে। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি।
Advertisement
রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: সমাজ, রাজনীতির নানা অসঙ্গতি নিয়ে লিখছেন, সরব আছেন। ভোট, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
শাহরিয়ার কবির: বাংলাদেশের রাজনীতি আলোচনা করতে গেলে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি না। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়ার পর পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে ডানপন্থিরা। পাকিস্তান আন্দোলনে বামপন্থিরা একেবারেই বাইরে ছিল। এর মধ্য দিয়ে তারা জনবিচ্ছিন্নও হতে থাকে।
Advertisement
মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী মুসলিম লীগ, এরপর আওয়ামী লীগ হলো। মধ্যপন্থার রাজনীতিক ধারা প্রতিষ্ঠা পেতে থাকলো এবং বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা সেখানে গুরুত্ব পেতে থাকল। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এর বিকাশ দেখেছি। এসময় বামপন্থিরাও শক্তিশালী অবস্থানে ছিল। এ কারণে আওয়ামী লীগ মধ্য বামপন্থার দিকে ঝুঁকতে থাকে।
আরও পড়ুন>> রাজনীতিতে হেভিওয়েটদের ডায়েটে যাওয়া উচিত
বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন লেখায়, বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আমি কমিউনিস্ট সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি’। সমাজতন্ত্র তো বামপন্থার। আবার বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলতে তিনি সম্প্রীতির কথা বুঝিয়েছেন। বাংলাদেশ কেমন রাষ্ট্র হবে, তা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন স্পষ্ট হয়ে গেছে। অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার কথা বারবার এসেছে। ১৯৭২ সালে যে সংবিধান পেলাম তার ভিত্তি চারটি। পাকিস্তান আমলে তো গণতন্ত্র ছিল না।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ কিছুটা কাজ করেছিল। এরপর ধনতান্ত্রিক মডেল অনুসরণ করছে, যা তৃতীয় বিশ্বে করা হয়েছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক অর্জন তাদের আছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে আওয়ামী লীগ অনেক দূরে সরে গেছে।
Advertisement
জাগো নিউজ: ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন হলো এবং আওয়ামী লীগ জয়ী হলো। নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়ই হলো।
শাহরিয়ার কবির: ২৩ বছর পর প্রথম নির্বাচন হয়। বিজয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে গণহত্যা শুরু করলো, যুদ্ধ ঘোষণা করলো। গণতন্ত্র থাকলে তো ক্ষমতা হস্তান্তর করতো।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে আমরা একটি অসাধারণ সংবিধান পেলাম। এই সংবিধানের আলোকে আমরা একটি সুন্দর সমাজ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আবার ডানপন্থার উত্থান হলো।
জাগো নিউজ: সংবিধানের চার মূল নীতির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র। আসলে গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র একসঙ্গে যায়?
শাহরিয়ার কবির: গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে নতুন সংজ্ঞা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। জাতীয়তাবাদীর সঙ্গে আমরা পরিচিত।
বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রের ধারার সঙ্গে যুক্ত করে বলেছিলেন, আমরা শোষিতের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। এজন্য তিনি বলেছিলেন, ‘আমি শোষকের অধিকার খর্ব করতে রাজি আছি’।
আরও পড়ুন>> ঐকমত্যে না পৌঁছাতে পারলে পুরো জাতি খাদে পড়বে
সমাজতন্ত্রের প্রতি দুর্বলতার কথা তিনি বহু বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। তিনি চীনে গিয়েছিলেন। সেখানকার সমাজতন্ত্র তার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু কমিউনিস্টদের যে রুল, অর্থাৎ আর কোনো দল থাকতে পারবে না, এটি তিনি পছন্দ করেননি। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের একটি মিশ্রিক মডেল যেটি ভারতে ইন্দিরা গান্ধী করতে চেয়েছিলেন। মিশর, ইন্দোনেশিয়া করতে চেয়েছিল। জমির মালিকানা বণ্টন, আয়-ব্যয়ের বৈষম্য কমিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। কৃষি বিপ্লবের কথা বলেছেন। ক্লাসিক্যাল সমাজতন্ত্র নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। বিস্তর আলোচনা। বঙ্গবন্ধু বারবার বলেছেন, আমাদের সমাজতন্ত্র চীন বা রাশিয়া থেকে ধার করে আনা নয়।
আওয়ামী লীগ ক্রমশই দক্ষিণপন্থার দিকে যাবে। বামপন্থির উত্থান না ঘটলে আওয়ামী লীগকে দক্ষিণপন্থা থেকে ঠেকানো যাবে না। বিএনপি আরও দক্ষিণপন্থার দিকে যাবে। পুরো বাংলাদেশটাই উগ্র দক্ষিণপন্থার দিকে যাবে। এটিই আমাদের উদ্বেগের বিষয়।
জাগো নিউজ: বামপন্থিদের অনেকেই মনে করেন, সমাজতন্ত্রে গণতন্ত্রের কোনো ঠাঁই নেই। বঙ্গবন্ধু আসলে কী চেয়েছিলেন?
শাহরিয়ার কবির: সমাজতন্ত্রে গণতন্ত্রের জায়গা নেই, তাহলে বামপন্থিরা নির্বাচনে অংশ নেয় কেন?
জাগো নিউজ: ক্লাসিক্যাল সমাজতন্ত্রে তো আসলে গণতন্ত্র নেই।
শাহরিয়ার কবির: বঙ্গবন্ধু পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। এক্সপেরিমেন্ট কেন ফেল করলো, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে। ষাট বা সত্তরের দশকে বিশ্বজুড়ে অনেক দেশেই এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে। এমনকি স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো তো সমাজতন্ত্রের অনেকটা কাছাকাছি। তাদের আয়-ব্যয়ের যে বণ্টন তাতে বৈষম্য অনেক কমিয়ে আনে। মালিক-শ্রমিক জীবনমান কাছাকাছি। সত্তরের দশকে বিচিত্রায় এ নিয়ে লিখেছিলাম।
জাগো নিউজ: সমাজতন্ত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধুর যে ভাবনা তাতে কোনো দ্বিধা ছিল কি না? স্পষ্ট ঘোষণা দিলেও পারতেন?
শাহরিয়ার কবির: সংবিধানে পরিষ্কারভাবে বলা আছে। গণপরিষদে এ নিয়ে তিনটি ভাষণ আছে এবং পরবর্তীকালে তিনি আরও ব্যাখ্যা করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের জন্য যে ধরনের দল দরকার আওয়ামী লীগ সে ধরনের দল ছিল কি না?
আওয়ামী লীগের মধ্যেও তো ডানপন্থিরা ছিল। খন্দকার মোশতাকরা তো ছিল। আওয়ামী লীগের মধ্যে বাম ও ডানপন্থার মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরেই আওয়ামী লীগে ডানপন্থার উত্থান ঘটেছে। খন্দকার মোশতাক তো ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ই আওয়ামী লীগের মধ্যে ষড়যন্ত্র করেছেন এবং পাকিস্তানকে এক রাখার চেষ্টা করেছেন।
আরও পড়ুন>> ‘আমরা একটি বিপজ্জনক ফাঁদের ভেতরে পড়ে যাচ্ছি’
অন্যদিকে তাজউদ্দিন আহমদরা বামপন্থার দিকে ছিলেন। আব্দুস সামাদ আজাদরা তো ন্যাপ থেকে আওয়ামী লীগে এসেছেন। মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুর চেয়ে সমাজতন্ত্রের প্রতি দুর্বলতা ছিল। বঙ্গবন্ধুকে বলাই হয় ভাসানীর মানসপুত্র।
ভাসানী সেই অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি করতেন না। প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তার ওইরকম ধারণা ছিল না। কিন্তু তার দর্শনের পুরো প্রতিফলন আমরা বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দেখতে পাই।
জাগো নিউজ: এখনকার আওয়ামী লীগ নিয়ে কী বলবেন? ডানপন্থায় আরও বেশি ভর করলো কি না?
শাহরিয়ার কবির: ’৭৫-এর পর থেকে শুরু হয়েছে। দীর্ঘ ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ উপলব্ধি করেছে, সমাজতন্ত্রের দিকে যাওয়া যাবে না। সারা বিশ্বে সমাজতন্ত্রের পতন হয়ে গেছে। এখন ধনতন্ত্রে ভর করতে হবে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাকে ধনতন্ত্রে ভর করতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ কিছুটা কাজ করেছিল। এরপর ধনতান্ত্রিক মডেল অনুসরণ করছে, যা তৃতীয় বিশ্বে করা হয়েছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক অর্জন তাদের আছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে আওয়ামী লীগ অনেক দূরে সরে গেছে।
এর জন্য পুরোটা আওয়ামী লীগকে দায়ী করলে চলবে না। এখানে বামপন্থিদের একটি বড় দায়িত্ব ছিল, যা তারা পালন করতে পারেনি। বিএনপি তো পুরোপুরি ডানপন্থিদের নিয়েই গঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ মনে করে বিএনপিকে মোকাবিলা করতে গেলে ডানপন্থায় ঝুঁকতে হবে। আওয়ামী লীগ ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল। সেই আওয়ামী লীগ এখন ধর্মীয় রাজনীতি করে এবং উগ্রপন্থিদের উৎসাহিত করে।
দক্ষিণপন্থাকে মোকাবিলা করার জন্য এখানে শক্তিশালী বাম আন্দোলন দরকার ছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা রাজনীতি করবে এটি কোনোভাবেই হতে পারে না। বিএনপি যাদের নিয়ে রাজনীতি করছে তারা বাংলাদেশের ধারণাকে বিশ্বাস করে না। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জামায়াতের রাজনীতির কোনো পার্থক্য নেই। আওয়ামী লীগও একই পথে হাঁটছে।
জাগো নিউজ: এই পথে হেঁটে আওয়ামী লীগের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী?
শাহরিয়ার কবির: আওয়ামী লীগ ক্রমশই দক্ষিণপন্থার দিকে যাবে। বামপন্থির উত্থান না ঘটলে আওয়ামী লীগকে দক্ষিণপন্থা থেকে ঠেকানো যাবে না। বিএনপি আরও দক্ষিণপন্থার দিকে যাবে। পুরো বাংলাদেশটাই উগ্র দক্ষিণপন্থার দিকে যাবে। এটিই আমাদের উদ্বেগের বিষয়।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশকে এই পথেই যেতে হচ্ছে কেন?
শাহরিয়ার কবির: প্রথমত, বামদের ব্যর্থতার কারণে যাচ্ছে। বামরা যদি একটি শক্তি অর্জন করতেন, তাহলে এই দশা হতো না। বঙ্গবন্ধু তো সিপিবির সঙ্গে জোট করেছিলেন। তখন সিপিবির একটি শক্তি ছিল। ষাটের দশকে কৃষক আন্দোলনে পুরো নেতৃত্ব দিয়েছে বামপন্থিরা। শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্রআন্দোলনে বামরাই নেতৃত্ব দিয়েছে।
জাগো নিউজ: বামপন্থিরা তো অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগই বামপন্থিদের জায়গা সংকুচিত করেছে। আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে যে আচরণ করে বামপন্থিদের সঙ্গেও একই আচরণ করে?
শাহরিয়ার কবির: যারা এই অভিযোগ করেন, তারা চরম দেউলিয়াত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এখন আমাদের বামরা কেউ আওয়ামী লীগের সুবিধা চাইছে কেউ বিএনপির সুবিধা চাইছে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেছেন, ‘ভিক্ষাবৃত্তি করছে আমাদের বামরা আওয়ামী লীগের কাছে।’ নৌকা না পেলে বামপন্থিরা জিতে আসতে পারবে না। ভিক্ষাবৃত্তি করেই বামরা নৌকা প্রতীক নিয়েছে। আর কী হতে পারে! বাসদ, সিপিবিও তাই। তারা বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক করছে। বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশকে মোল্লা ওমরের আফগানিস্তান বানাতে চাইছে।
বামদের একদল আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করছে আরেক দল বিএনপির লেজুড়বৃত্তি করছে। বামদের তো নিজস্ব কোনো সত্তা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ভারতে এখনো বামদের উপস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালায় আমরা দেখতে পাচ্ছি তো। আমাদের এখানে তো তা-ও দেখতে পাচ্ছি না।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে বামদের ব্যবহারিক দেউলিয়াত্ব যেমন আছে, তাত্ত্বিক দেউলিয়াপনাও তো আছে। এনজিওর ধারায় চলছে বামপন্থিরা।
এএসএস/এএসএ/এএসএম