দেশের শেয়ারবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) বড় ধরনের ধস নেমেছে। বিদায়ের পথে থাকা ২০২৩ সালে মাত্র দুটি কোম্পানি আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করেছে। স্মরণকালের মধ্যে এক বছরে এত কম আইপিও আর দেখা যায়নি।
Advertisement
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট ও বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানির সরবরাহ যত বাড়বে, বাজারের গভীরতা তত বাড়বে। বাজারে নতুন নতুন কোম্পানির শেয়ার এলে বিনিয়োগের বিকল্প মাধ্যম সৃষ্টি হয়। কিন্তু গত এক বছর শেয়ারবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না। ফ্লোর প্রাইস দিয়ে বাজারকে এক প্রকার বন্ধ করে রাখা হয়।
তারা বলছেন, শেয়ারবাজারকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। বাজার স্বাভাবিক না থাকায় ২০২৩ সালে আইপিও আসার সংখ্যা কমে গেছে। এক বছরে আইপিও’তে মাত্র দুটি কোম্পানির শেয়ার ছাড়া কোনো ভালো বাজারের লক্ষণ না। শেয়ারবাজারে অবশ্যই ভালো ভালো কোম্পানির আইপিও আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
অপরদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেক কোম্পানির আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে যেসব কোম্পানি আইপিওতে আসতে চায়, তারা আইপিও’র জন্য আবেদন করেনি। তবে আগামী বছর আইপিও’র সংখ্যা বাড়বে।
Advertisement
আরও পড়ুন>> আইপিওতে ধস, অর্ধেকে নেমেছে অর্থ উত্তোলন
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ২০২০ ও ২০২১ সাল পর পর দুই বছর শেয়ারবাজার থেকে আইপিও মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন হয়। ২০২২ সালে আইপিও’র সংখ্যা কমে আসে। আর ২০২৩ সালে আইপিওতে রীতিমতো ধস নেমেছে।
২০২৩ সালে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করা দুই কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- মিডল্যান্ড ব্যাংক এবং ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। দুটি কোম্পানিই স্থির মূল্য পদ্ধতিতে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করে। এর মধ্যে মিডল্যান্ড ব্যাংক ৭০ কোটি টাকা এবং ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ১৬ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। অর্থাৎ দুটি কোম্পানির উত্তোলন করা অর্থের পরিমাণ ৮১ কোটি টাকা।
এর আগে ২০২২ সালে ৬টি প্রতিষ্ঠান আইপিও’র মধ্যে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করে। প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ৬২৬ কোটি ২৬ লাখ ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে আইপিও আসার সংখ্যা কমেছে ৪টি এবং অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ কমেছে ৫৪৫ কোটি ২৬ লাখ ১০ হাজার টাকা।
Advertisement
আরও পড়ুন>> ‘অনিয়মে নিমজ্জিত’ ট্রাস্ট লাইফের আইপিও আবেদন শুরু সোমবার
দুই বছর আগের সঙ্গে তুলনা করলে ২০২৩ সালে আইপিও’র চিত্র আরও হতাশাজনক দেখাবে। কারণ ২০২১ সালে আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৪টি। প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মেলিতভাবে অর্থ উত্তোলন করে ১ হাজার ২৩৩ কোটি ২৬ লাখ ৯ হাজার টাকা।
এর আগে ২০২০ সালে আইপিও’র মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে রেকর্ড পরিমাণ ১ হাজার ২৯৬ কোটি ৮৭ লাখ ৮৮ হাজার টাকা উত্তোলন করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বছরটিতে আইপিও’র মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হলেও বছরের শুরুর চিত্র মোটেও ভালো ছিল না। মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ফলে এসময় শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ থাকে।
তার আগে ২০১৯ সালে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ ওঠে খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি একের পর এক দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেন। যার ফলে সার্বিক শেয়ারবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বড় ধরনের সমালোচনার মুখে পড়ে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল কমিশন সভা করে নতুন আইপিও না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি।
আরও পড়ুন>> নারীদের এগিয়ে নিতে ‘অরেঞ্জ বন্ড’ আনার পরিকল্পনা বিএসইসির
ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস ২০১৫ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত ৩০ এপ্রিল থেকে আইপিও সংক্রান্ত নতুন কোনো আবেদন গ্রহণ করা হবে না। অবশ্য ওই সিদ্ধান্তের আড়াই মাসের মধ্যে আইপিওতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটা বাড়িয়ে পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫-এর সংশোধন আনে বিএসইসি। এরপর দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও নতুন কোনো আইপিও আর অনুমোদন দেয়নি খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন। ফলে ২০২০ সালের প্রথম পাঁচ মাসও আইপিও শূন্য থাকে।
তবে মে মাসের শেষদিকে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেওয়ার পর আবার আইপিও মার্কেট সরগম হয়ে ওঠে। তার নেতৃত্বাধীন কমিশন একের পর এক প্রতিষ্ঠানের আইপিও দিতে থাকে। ফলে ২০২০ সালে মাত্র সাত মাসেই রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের সুযোগ পেয়ে যান উদ্যোক্তারা। এখন সেই শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনই স্মরণকালের মধ্যে সব থেকে কম আইপিও দেওয়ার রেকর্ড গড়লো।
এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, এক বছরে দুটি আইপিও আসা ভালো বাজার বা স্বাভাবিক বাজারের লক্ষণ না। আরও বেশি আসা উচিত। দুটি আইপিও এলে কীভাবে হবে?
আইপিও না আসায় বাজারের অবস্থা আরও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে কি? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আইপিও না আসায় বাজারের অবস্থা দুর্বল তো হবেই। এক বছর ধরে বাজার লেনদেন হচ্ছে। শুধু কতগুলো জাঙ্ক শেয়ার লেনদেন হচ্ছে। জাঙ্ক শেয়ার বাদে বাজার বন্ধই রয়েছে। এর মধ্যে আইপিও আসবে কীভাবে।
আরও পড়ুন>> রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কার ধাক্কা শেয়ারবাজারে
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এক বছরে দুটি কোম্পানির আইপিও আসা যথেষ্ট না। আমি মনে করি আইপিও’র সংখ্যা আরও বাড়া উচিত।
আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন কমার কারণ হিসেবে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। আর্থিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেসব কোম্পানি আইপিওতে আসার আবেদন করেনি। এ কারণে আইপিওতে আসা কোম্পানির সংখ্যা কম।
আইপিও বাড়ানোর ক্ষেত্রে আপনাদের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইপিও আনার দায়িত্ব ইস্যু ম্যানেজারদের। কমিশন আবেদন করলে আইপিও অনুমোন দেয়। তবে আমরা আশা করছি আগামী বছর আইপিওতে আসা কোম্পানির সংখ্যা বাড়বে। অনেক কোম্পানি ডিসেম্বর মাসের আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে আইপিও আবেদন করবে।
এমএএস/ইএ/জিকেএস