৭ জানুয়ারি দেশে যে একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে ওই নির্বাচনের পর দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার সব চেষ্টাই ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। তবে বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ কম। আবার বিএনপি নির্বাচন প্রতিহত করার যে আন্দোলন করছে, তাতেও মানুষের আগ্রহ তেমন আছে বলে মনে হচ্ছে না। মানুষ এটা ধরেই নিয়েছে যে নির্বাচন হবে এবং তাতে আওয়ামী লীগই বিপুলভাবে জয়ী হবে। শেখ হাসিনা আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন।
Advertisement
গত ২০ ডিসেম্বর সিলেট থেকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্থানীয় আলিয়া মাদরাসা মাঠে বিশাল নির্বাচনী জনসভার মঞ্চে নৌকার প্রার্থীদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও ছিলেন। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগেরই।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেশিরভাগ আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগের নৌকার সঙ্গে একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, দুই শতাধিক আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। যাদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়া বর্তমান ২৮ জন সংসদ সদস্য। স্বতন্ত্র তালিকায় আছেন জেলা, মহানগর ও উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, জেলা ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। স্থানীয়ভাবে এসব নেতার অনেকেই প্রভাবশালী ও জনপ্রিয়।
যদিও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৭টি রাজনৈতিক দল এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তবে জাতীয় পার্টি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলো বেশকিছু আসনে নিজ নিজ দলের প্রতীকে প্রার্থী দিলেও সামান্য কিছু আসন ছাড়া কোথাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো অবস্থা নেই তাদের। জাতীয় পার্টিও সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করেই নির্বাচনে নেমেছে। এমনকি জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর নির্বাচনী পোস্টারেও ‘আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী’ লেখা হয়েছে।
Advertisement
এবারের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীদের। যেসব আসনে নৌকা নেই সেখানেও আওয়ামী লীগের ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীরাই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীদের হারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও রাখেন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কেউ কেউ। এবার নির্বাচনে ২২১ আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ৩৮২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। জোটের শরিক ও জাতীয় পার্টিকে যে ৩২টি আসন ছাড় দেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে কয়জন জিতে আসতে পারবেন, বলা কঠিন।
যেসব আসনে নৌকার চেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা শক্তিশালী, সেসব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরই বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সরকার এবং নির্বাচন কমিশন এবার কোনোভাবেই নির্বাচন বিতর্কিত করতে চায় না। তারপরও নির্বাচন বিতর্কমুক্ত হবে- এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। প্রধানমন্ত্রী সংঘাত পরিহার করার কথা বললেও শুরু থেকেই সংঘাত হচ্ছে। কোনো কোনো আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বিঘ্নে তাদের প্রচার কার্যক্রম চালাতে পারছেন না। এর মধ্যে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। সংঘাত বাড়বে বৈ কমবে না।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনা নিজেই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উৎসাহিত করেছেন। নৌকার প্রার্থীরা যাতে স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ অন্য দলের প্রার্থীদের কোনোভাবেই বাধা কিংবা হয়রানি না করে, সেজন্যও দলের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে কঠোর নির্দেশনা। কিন্তু এসব নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে বলে মনে হয় না।
সিলেটের নির্বাচনী জনসভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ঝগড়া করবেন না। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা স্বতন্ত্র ইলেকশন করবেন। নৌকার প্রার্থীরা নৌকার ইলেকশন করবেন। কারও সঙ্গে কারও ঝগড়ার প্রয়োজন নেই। এই নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার জন্য, সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে চান। এজন্য তিনি স্বতন্ত্রদেরও প্রার্থী করতে বলেছেন। এভাবে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এবার নির্বাচনে ৪৫-৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করার পরিকল্পনা করেছে আওয়ামী লীগ।
Advertisement
নির্বাচন উৎসবমুখর করার জন্য বাংলাদেশের ক্রিকেটের পোস্টারবয় সাকিব আল হাসান, চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের মতো প্রার্থীরা আছেন। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও ৭ জানুয়ারির নির্বাচন কতটা উৎসবমুখর হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বিভিন্ন পত্রিকায় যেসব আসনে নৌকার সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জোর লড়াইয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তার কয়েকটি হলো : ফরিদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা উপ-কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্লাহ। এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল প্রতীকে লড়ছেন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। নিক্সন বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী জাফর উল্লাহর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করে জিতেছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ তার পক্ষে কাজ করছে। এবারো আসনটিতে নিক্সনের জয়ের সম্ভাবনা বেশি।
মাদারীপুর-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। এখানে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগম। এখানে তাহমিনা বেগম ঈগল প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। স্থানীয় জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ তাহমিনার পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। কাজেই গোলাপের জয়ের পথে তাহমিনা বড় বাধা।
ঢাকা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক এপিএস ড. আওলাদ হোসেন। তিনি ট্রাক প্রতীকে লড়ছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ আওলাদের পক্ষে মাঠে কাজ করছে। লাঙ্গল প্রতীকে এখানে লড়ছেন বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। তবে নৌকার সঙ্গে এখানে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওলাদের ঈগল প্রতীকের।
ঢাকা-৫ আসনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ মুন্না। এখানে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান সজল মোল্লা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কামরুল হাসান রিপন। সজল লড়ছেন ট্রাক প্রতীকে আর রিপন লড়ছেন ঈগল প্রতীকে। ত্রিমুখী লড়াইয়ের আভাস মিলছে আসনটিতে।
পঞ্চগড়-১ আসনে এবার নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন নাইমুজ্জামান ভুঁইয়া মুক্তা। এখানে ট্রাক প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট। এই দুই প্রার্থীর মধ্যে তুমুল লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে এলাকার ভোটাররা নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে অভ্যস্ত।
চট্টগ্রাম-১২ আসনে নৌকা প্রতীকে লড়ছেন মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। আসনটিতে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও হুইপ সামশুল হক চৌধুরী। তিনি লড়ছেন ঈগল প্রতীকে। এই দুই প্রার্থীর মধ্যে প্রবল লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
এরকম দুই শতাধিক আসনে বর্তমান সংসদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতা নৌকার মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়াই করছেন। দলের পক্ষ থেকেও তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেকেই বিজয়ী হতে পারেন। সংসদে জাতীয় পার্টির চেয়ে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশি আসন লাভ করতে পারেন।
প্রার্থীদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ভোটকেন্দ্রে ভোটার আনা। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রে ভোটার টানতে নানান কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এর অংশ হিসেবে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পাশাপাশি দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে নির্দেশনা দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। এতে সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে বলপ্রয়োগের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
এটা এখন সবার জানা যে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের কড়া নজর রয়েছে। কেন্দ্রে ভোটারদের সরব উপস্থিতি না থাকলে এবং ভোটে কোনো ধরনের কারচুপি, সহিংসতার ঘটনা ঘটলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সামনে আনতে পারে তারা। এতে ভোটের পরে দেশে আরও বেশি অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকছে।
নির্বাচনে ২৬৮ আসনে দলীয় প্রার্থী রয়েছে আওয়ামী লীগের। এর মধ্যে ঋণখেলাপি ও দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে দুজন নির্বাচন করতে পারছেন না। অন্যদিকে জোটভুক্ত ছয়জন নৌকা নিয়ে নির্বাচন করায় বর্তমানে নৌকার প্রার্থী আছে ২৭২টি আসনে। অন্যদিকে জোটকে ছেড়ে দেওয়া ৩২ আসনসহ ২১৯টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতা।
ভোটে বিএনপি না থাকায় আওয়ামী লীগের পরাজয়ের ভয় নেই। ভোটার কেন্দ্রে এলে ভোটাররা হয় নৌকার প্রার্থীকে, না হয় দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ভোট দেবেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী ১৬ স্বতন্ত্রের মধ্যে ১৪ জনই আওয়ামী লীগে যোগ দেন। দ্বাদশ নির্বাচনেও বিজয়ের পরে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আওয়ামী লীগে যোগ দেবেন। না হয় সংসদকে প্রাণবন্ত করতে তাদের মাধ্যমে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতে উৎসাহিত করা হবে।
নির্বাচন উৎসবমুখর করার জন্য বাংলাদেশের ক্রিকেটের পোস্টারবয় সাকিব আল হাসান, চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের মতো প্রার্থীরা আছেন। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও ৭ জানুয়ারির নির্বাচন কতটা উৎসবমুখর হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম