মতামত

ভোটার উপস্থিতির চ্যালেঞ্জ এবং একটি সমীক্ষা

উৎসবমুখর পরিবেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দ্বাদশ সংসদকে গ্রহণযোগ্য করার প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেছে নির্বাচন কমিশন। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার প্রায় ১২ কোটি। এর মধ্যে ৬ কোটি ৭ লাখ, ৭১ হাজার ৫৭৯ পুরুষ এবং ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ নারী ভোটার। এছাড়া রয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার। এর মধ্যে ২০ শতাংশ প্রথমবারের মতো ভোটার হয়েছে। অর্থাৎ বৃহৎ অংশ তরুণ ভোটার, যাদের ভোট দেওয়ার সুযোগ এসেছে প্রথমবারের মতো।

Advertisement

এই বৃহৎ সংখ্যক তরুণ ভোটার যারা গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে বেড়ে উঠেছে, তাদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসা একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের সমর্থকগোষ্ঠীকে কেন্দ্রে নিয়ে আসা কিংবা কোনো একটি নির্দিষ্ট দলের সমর্থক না হলেও তাদের ভোট দিতে উৎসাহিত করা কাজ খুবই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এদিকে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল।

অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য নিবন্ধিত নতুন ভোটারদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কাজে সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর উপায় আসলে কি? আওয়ামী লীগ আর্থিক জোগান, সাংগঠনিক শক্তি ব্যবহার এবং সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের সহায়তায় সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করবে বলে জানা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ভোটারের মনোজগৎ উন্মোচন করার জন্য কোনো জরিপ কিংবা গবেষণা এ অবধি হয়েছে বলে জানা যায়নি।

দেশে দেশে ভোটের চিত্র :সুইডেন থেকে প্রকাশিত Voter Turnout Trends around the World গ্রন্থে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কারণ কীভাবে ভোটারদের ভোটদান প্রভাবিত করে তার বিস্তারিত বিবরণ উপস্থাপন করা হয়েছে। গবেষকের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়, তিনটি মূল এবং একাধিক সহায়ক কারণ ভোটারকে ভোটদানে প্রভাবিত করে। যেমন- ক. আর্থ-সামাজিক কারণ- জনসংখ্যার আকার, জনসংখ্যার স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, খ. রাজনৈতিক কারণ- নির্বাচনের সংলগ্নতা, রাজনৈতিক সমস্যার ঝুঁকি উপলব্ধি, প্রচারাভিযানের ব্যয়, রাজনৈতিক বিভাজন, গ. প্রাতিষ্ঠানিক কারণ- নির্বাচনী ব্যবস্থা, বাধ্যতামূলক ভোটদান, সমসাময়িক নির্বাচন বা একাধিক নির্বাচন।

Advertisement

ওই গ্রন্থে বর্ণিত কারণ বা প্রভাবকগুলো বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির চ্যালেঞ্জ বিশ্লেষণে গ্রহণ করা যেতে পারে। আমাদের দেশ ছোট হলেও জনসংখ্যা বিপুল এবং বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী বা একই এলাকায় তারা দীর্ঘকাল বসবাস করে। সাধারণত স্থানীয় সমস্যা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান আছে তাদের। তাদের দৈনন্দিন জীবনের সংকট তারা জানে। ফলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত স্বচ্ছভাবে নিতে পারে। অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কেও একটা সাধারণ ধারণা আছে। এদিক থেকে মানুষ আরও বেশি সচেতন এবং রাজনৈতিক কারণে যেন অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা বেঁচে থাকাকে প্রভাবিত না করে- সে বিষয়ে সচেতন। একথা সত্য অর্থনৈতিক কষ্ট ভোটারদের উদাসীনতা এবং জনগণকে রাজনীতি থেকে সরে যেতে প্ররোচিত করে। তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ একটি জরুরি প্রপঞ্চ।

অপরদিকে রাজনৈতিক কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-আসন্ন নির্বাচন ঘনিয়ে এলে ভোটের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয়। সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক সমস্যা ও ঝুঁকিগুলো উপলব্ধি করে। উপরন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের নীতি ভোটারদের প্রভাবিত করে। বিশেষত একটি নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায় তা তাদের চিন্তায় প্রভাব ফেলে। নির্বাচনে প্রচারাভিযানের ব্যয় বেশি হতে দেখলে জনগণের অনুভূতি আন্দোলিত হয়। নির্বাচন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য নাগরিকদের মধ্যে ‘নাগরিক কর্তব্য’ প্রচারিত হলে ভোটার ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আবার রাজনৈতিক বিভাজন বা দলাদলি ভোটারদের মানসিক চাপ তৈরি করে।

প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলের সংখ্যা বেশি হলে ভোটারদের উপস্থিতি প্রভাবিত করতে পারে। এটাও সত্য, বেশি বিকল্প ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে পারে এবং তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন করে তুলতে পারে। রাজনৈতিক কারণে এসব বিষয় ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক কারণে ভোটাররা প্রভাবিত হয়। যেমন- নির্বাচনীব্যবস্থা। নিরাপদ ও সহজ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় এমন নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি বেশি হয়।

অন্যদিকে বিশ্বের কোনো কোনো দেশে বাধ্যতামূলক ভোটদান প্রচলিত। স্বাভাবিকভাবেই ভোটাররা যখন ভোট দিতে আইনগতভাবে বাধ্য তখন ভোটদানের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। যেমনটি অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে ঘটেছে। নব্বই দশকের শুরু থেকে প্রত্যক্ষ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনকারী দেশের সংখ্যা বেড়েছে। তবে বৈশ্বিক গড় অনুপাতে একই সময়ে ভোটার উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা ইউরোপে সবচেয়ে দৃশ্যমান। সেখানকার নাগরিকদের আগ্রহ এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম হওয়ায় ভোটার উপস্থিতি নিম্নমুখী। সেখানে যখন একই সময়ে একাধিক নির্বাচন হয় তখন ভোটার উপস্থিতি সাধারণত বেশি থাকে। এর কারণ একজন স্বতন্ত্র ভোটার অন্তত একটি নির্বাচনে তার ভোট দিতে অনুপ্রাণিত হতে পারে।

Advertisement

গণতান্ত্রিক শাসনের একটি মৌলিক হাতিয়ার হিসেবে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিকে ধরে রাখার জন্য রাজনৈতিক দল, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং সুশীল সমাজের ভূমিকা রয়েছে। Voter Turnout Trends around the World গ্রন্থে দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখানো হয়েছে যে, সমানতালে বিশ্বব্যাপী ভোটারদের হার কমেছে। সৌদি আরব কিংবা ব্রুনাইয়ের মতো বিশ্বের অনেক দেশই নির্বাচনকে গুরুত্ব দেয় না। ফলে গণতন্ত্রে ভোটারদের অংশগ্রহণের বিষয়টি গুরুত্বহীন হওয়ায় ভোটার হারে এই নিম্নমুখী প্রবণতা।

অর্থাৎ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভোটারদের ভোটদানের পরিসংখ্যান বিভিন্ন। ভোটার উপস্থিতি যে কোনো দেশে যে কোনো সময়ে কমবেশি হওয়াটা স্বাভাবিক ঘটনা। এর মধ্যে ইউরোপ-আমেরিকায় ভোটদানে বিরত থাকা মানুষের সংখ্যাও রয়েছে। ২০১৯ সালে ভারতের লোকসভা ভোটের ৫৪২টি নির্বাচনী এলাকাজুড়ে ভোট পড়ে ৬৭.১১ শতাংশ, যা ২০১৪ সালে ছিল ৬৫.৯৫ শতাংশ। ২০২২ সালে ফ্রান্সে আইনসভা নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল আগের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম, মাত্র ৫২.৪ শতাংশ। সেখানে ২০১৭ সালে ৫৭.৩৬ শতাংশ ভোটার ভোট দেয়নি। ২০ বছর আগে এর সংখ্যা ছিল ৩৫.৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে ৫০ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়নি। ২০২০ সালে পৌরসভা নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে ৫৫.২৫ শতাংশ বাড়িতে বসে ছিল।

আঞ্চলিক নির্বাচনে ২০২১ সালে ৬৬.৭২ শতাংশ বাড়িতে বসে থাকে। তবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ২৬.৩১ শতাংশ ভোটদানে বিরত ছিল। নেপালে পার্লামেন্ট এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে প্রায় ৬১ শতাংশ ভোট পড়ে। তবে বিক্ষিপ্ত সহিংসতা এবং সংঘর্ষের জন্য বেশ কয়েকটি স্থানে ভোটগ্রহণ ব্যাহত হয়। যেখানে ২০১৩ সালে ছিল ৭৭ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ছিল ৭৮ শতাংশ।

জার্মানিতেও ২০২১ সালের নির্বাচনে মাত্র ২৫.৭ শতাংশ ভোটার ভোট দেয় একটি বাম দলকে। অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের দল ১৮.৯ শতাংশ ভোটে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরগুলোর মেয়র নির্বাচনে ২০-২৫ শতাংশ ভোট পড়ার নজির রয়েছে। ইংল্যান্ডের ২০১৬ সালের সিটি নির্বাচনে কয়েকটি শহরে যেমন- ব্রিস্টলে ২৪ শতাংশ, লিভারপুলে ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল। বাংলাদেশে এই চিত্রটি ভিন্ন। এদেশে ২০২৪ সালের নির্বাচনে নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ৩০টির মতো দল অংশ নিচ্ছে। নির্বাচন উৎসবমুখর হওয়ার জন্য সমর্থকদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি জরুরি বলেই রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয় রয়েছে মাঠে-ময়দানে।

অতীতের নির্বাচন ও গত ১৫ বছরের পরিসংখ্যান :পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়া ভোটের ৩০.০৮ শতাংশ পায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দলটির ভোট ৭ শতাংশ বেড়ে ৩৭.৪৪ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে দলটির ভোট ৩ শতাংশ বেড়ে ৪০.১৩ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট আরও প্রায় ৮ শতাংশ বেড়ে ৪৮.০৪ শতাংশে দাঁড়ায়। এবার ভোটার আকৃষ্ট করার জন্য ‘নির্বাচনী ইশতেহার’কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের দলীয় অভীপ্সা :বিএনপি দলগতভাবে ভোটে থাকছে না—এটা ধরে নিয়েই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছক সাজিয়েছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলটির নির্বাচনী কৌশলের মূলে রয়েছে, যত বেশি সম্ভব ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। ভোট পড়ার হার বাড়াতে পারলে দেশে-বিদেশে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা দেখানো যাবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। দলীয় প্রার্থীদের প্রত্যেকটি নির্বাচনী কেন্দ্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বলা হয়েছে, টার্গেট রাখতে হবে প্রত্যেকটি কেন্দ্রে ৫৬ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির। যদি সম্ভব না হয়, কমপক্ষে ৫০ শতাংশ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে বলা হচ্ছে।

২০১৪ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় এবার প্রত্যেকটি ভোটকেন্দ্রে শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটি ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের সব ধরনের নাশকতার প্রচেষ্টা প্রতিহত করবে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করবে। শুধু নৌকা প্রতীকের পক্ষেই ভোটারদের আনা হবে তা নয়। সেখানে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী যদি থাকেন, যদি বোঝা যায় কোনো ভোটার ওই প্রার্থীর সমর্থক তাহলে তাকেও ভোটকেন্দ্রে আনার জন্য উৎসাহিত করা হবে। এসব প্রচেষ্টা প্রকৃতপক্ষে বেশ কাজে দেবে।

দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা :আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার দিন ২৬ নভেম্বর গণভবনে এক মতবিনিময় সভায় ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সেজন্য নেতাকর্মীদের ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে।

সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতারা অন্য চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা নিয়েও ভাবছেন। দলের দিক থেকে সাধারণত কমপক্ষে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ ভোট পড়লে আন্তর্জাতিকভাবে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও তার মিত্ররা অংশ না নিলে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলের নেতাকর্মীদের অন্তত ৪৫ শতাংশ ভোট যাতে পড়ে, সেটি নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন।

এজন্য গত ৩০ আগস্ট (২০২৩) গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘অংশগ্রহণ বলতে কাদের অংশগ্রহণ? আমার কাছে অংশগ্রহণ হচ্ছে জনগণের অংশগ্রহণ। জনগণ ভোট দিতে পারলে, সেই ভোটে যারা জয়ী হবে, তারা সরকারে আসবে।’

লেখাবাহুল্য, বিএনপি ভোটে না থাকলেও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে কোনো সমস্যা নেই। আওয়ামী লীগের ২৭০ আসন পাওয়ার দরকার নেই। ১৭০-১৮০ আসন হলেই যথেষ্ট। বাকিগুলো অন্যরা পেতে পারে। ভোটারের উপস্থিতি বাড়িয়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারলেই হবে বলে মনে করেন নেতারা।

সাংগঠনিক উদ্যোগ :দ্বাদশ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে দৃশ্যমান কিছু সাংগঠনিক উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শুরু হয়েছে ‘রোড টু স্মার্ট বাংলাদেশ’ নামের কর্মসূচি। দেশের প্রতিটি ওয়ার্ডে স্থানীয় প্রচারকর্মী মনোনয়ন করা হয়। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষক ও মেন্টর নিয়োগ করা হয়েছে। সারাদেশে প্রশিক্ষণের জন্য দুই শতাধিক ব্যক্তিকে ‘মাস্টারট্রেইনার’ মনোনীত করে কর্মশালা শুরু হয়েছে।

দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- ‘ভোটারদের প্রয়োজনে হাতে-পায়ে ধরে কেন্দ্রে নিয়ে আসব। প্রত্যেক ভোটারের মুখোমুখি হয়ে সরকারের অর্জন তুলে ধরব। আওয়ামী লীগের নিজস্ব ভোট আছে, এর সঙ্গে আছে নানান সুফলভোগী। তাদের ঠিকমতো বোঝাতে পারলে কেন্দ্রে আসবেন। সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনে এর প্রমাণ মিলেছে।’

সিটি করপোরেশন নির্বাচন :একাদশ সংসদ আমলে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে গাজীপুর, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল। ভোটার উপস্থিতি, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পরিবেশ বিবেচনায় এ নির্বাচনগুলো অনেকটা মডেল হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। সেসময় বিএনপি দল হিসেবে এ নির্বাচনগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বর্জনের ঘোষণা দেয়। তবে দলটির কোনো কোনো নেতা মেয়র পদে ভোট করেন। কাউন্সিলর পদে বিএনপি, এমনকি জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীও ছিল। যদিও তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। মেয়র পদে কেউ না জিতলেও কাউন্সিলর পদে বিএনপির অনেকেই জয়ী হয়েছেন।

৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপি ভোটে না এলে তাদের তৃণমূলের, জেলা পর্যায়ের অনেককেই ভোটে আনার চেষ্টা হয়েছে ক্ষমতাসীনদের। এর বাইরে ইসলামপন্থি দলকেও ভোটে টানা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো যাবে। সরকারের মূল দায়িত্ব হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা।

গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে পরিবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। এজন্য ভোটারের উপস্থিতি বেশি ছিল। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৫৮ শতাংশ। রাজশাহী সিটিতে ভোট পড়েছে ৫৬ শতাংশ। সিলেট, বরিশাল ও খুলনায়ও মেয়র পদে একাধিক প্রার্থী হয়েছিলেন। এর মধ্যে সিলেটে ভোট পড়ার হার ছিল প্রায় ৪৭ শতাংশ। বরিশালে ভোট পড়েছে ৫১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। খুলনায় ভোট পড়ে প্রায় ৪৮ শতাংশ।

আগেই বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চান। আর তা করতে পারলে নির্বাচনের পরে সরকারের বৈধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে না।

নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব:নির্বাচন কমিশন তথা আয়োজকরা যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের নিশ্চয়তা এবং প্রশাসন ভোটের পরিবেশ ও নিরাপত্তা বিধান না করে, তাহলে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে চাইবে না। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পেছনে নির্বাচন কমিশনেরও দায় থাকে। ‘প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক’ রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি আবশ্যিক শর্ত হলো ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন।

নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রত্যেক নাগরিকের সমান সুযোগ এবং অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত ইচ্ছা ও মতামতের প্রতিফলন নিশ্চিত করা একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ নির্বাচনের প্রাথমিক ও মৌলিক উপাদান। এজন্য নির্বাচন ব্যবস্থায় নিরপেক্ষ ভূমিকা আবশ্যক। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে নির্বাচন পরিচালনার সময়কালে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘নির্বাচনকালীন সরকারে’র কর্তৃত্বের চেয়ে ‘নির্বাচন কমিশনে’র কর্তৃত্ব ঊর্ধ্বে থাকবে। বলাবাহুল্য, ইসি রাজনৈতিক দলগুলো এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর পুরোপুরি আস্থা রেখে তারা কাজ করছে।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে কমিশনকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর চলমান আন্দোলন মোকাবিলা; অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন; নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের বড় অংশের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন এড়ানো; ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো; ভোট প্রদানের হার বৃদ্ধি; সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা এবং অনিয়ম ঠেকানো। ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারছে কি না, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চান তারা।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘যদি এক শতাংশ ভোট পড়ে, ৯৯ শতাংশ না পড়ে, তাহলে আইনগতভাবে নির্বাচন সঠিক। প্রশ্ন উঠবে লেজিটিমেসি নিয়ে, লিগ্যালিটি নিয়ে নয়। কাজেই লিগ্যালিটি এবং লেজিটিমেসি নিয়ে কনফ্লিক্ট আছে।’ তারা মনে করছেন, রাজনৈতিক পরিবেশ শান্ত ও নির্বাচন সহিংসতামুক্ত রাখা গেলে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে পারে। সেই লক্ষ্য অর্জনে মাঠ প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।

নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘কত শতাংশ ভোট পড়েছে, আমরা সেটা দেখবে না। নির্বাচন নির্বাচনের গতিতে চলবে। সংবিধানে কোথাও লেখা নেই কত ভোট কাস্ট হতে হবে।’ অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ সবার ভাষ্য হলো সব রাজনৈতিক দল না এলেও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে, যদি মানুষ ব্যাপক হারে ভোটকেন্দ্রে আসে। সাধারণ মানুষ বা জনগণ যদি ভোট দেয়, সেটিই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন। বাস্তবের ঘটনা আর নির্বাচন কমিশনের অবস্থান বা বক্তব্যে মিল থাকতে হবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন থানার ওসি এবং ১১০ ইউএনওকে বদলির অনুমোদন দিয়েছে ইসি। আসলে মানুষের আস্থাভাজন নির্বাচন কমিশন হতে হবে। ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। তাদের ভোটের যে গুরুত্ব আছে তা কথা ও কাজে মিল রেখে প্রমাণ করতে হবে। এজন্য ভোটের দিন গণপরিবহন বন্ধ করা যাবে না। মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের অনুমতি দিতে হবে। অথবা নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনায় পরিবহন সুবিধা প্রদান করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিরপেক্ষ করতে হবে। ভোটারদের ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করবে যারা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যদিও নিরাপত্তার বিষয়ে ইতোমধ্যে আশ্বস্ত করা হয়েছে ইসি’র পক্ষ থেকে।

ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো নির্বাচন কর্মকর্তা কিংবা কমিশনের কাজ নয়। ভোটারদের নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে আগের আইনে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিধান ছিল না। এখন তা সংশোধন করা হয়েছে। ভোটাররা যাতে নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে, সে বিষয়ে নতুন আইন করা হয়েছে। যদি কেউ ভোটারকে ভোট দিতে বাধা প্রদান করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভোটারদের নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে আসার আহ্বান বারবার জানাতে হবে নির্বাচন কমিশনকেই।

জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে :বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা সত্যি সত্যি জনগণ থেকে দূরে সরে গেছেন কি? এ প্রশ্ন এখন সবার। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন গুরুত্ববহ করে তোলার জন্য তৃণমূল মানুষের দ্বারের কাছে অপেক্ষমাণ মনোনয়ন পাওয়া নেতারা।

আতঙ্ক ছড়ানো বন্ধ করতে হবে:ভোটের আগের কয়েকটি দিন বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সেসময় অযথা আতঙ্ক তৈরি হয় এরকম পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে হবে। এক্ষেত্রে ভোটারদের আস্থা ও বিশ্বাস বৃদ্ধি করতে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব রয়েছে। একইভাবে রাজনীতিবিদরাও সক্রিয় হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। ভোটার উপস্থিতিও বাড়বে।

শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমঝোতা :কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীও থাকা আবশ্যক। পছন্দের দল এবং শক্ত প্রার্থী থাকলে ভোটাররাও আগ্রহ নিয়ে ভোট দিতে আসবে। সেজন্য ভোটের হার বাড়াতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা প্রয়োজন। নির্বাচন বর্জনের সংস্কৃতি মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। মনে রাখতে হবে নির্বাচনই ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পথ।ছোট-বড় অনেক দল অংশ নিলে এবং মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলে ভোটাররাও ভোট উৎসব করেন। সেজন্য ভোটকে উৎসবে পরিণত করতে হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে।নির্বাচন বর্জনের সংস্কৃতি ছাড়তে হবে।

সরকারের উন্নয়নের বার্তা প্রচার :ভোটের দিন পর্যন্ত দলের সব ধরনের কর্মকাণ্ডকে ‘রোড টু স্মার্ট বাংলাদেশ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। এর আওতায় ভোটারদের কাছে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দিতে চায় আওয়ামী লীগ। এলক্ষ্যে সারা দেশে দলীয় কার্যালয়গুলোতে স্থাপন করা হচ্ছে স্মার্ট কর্নার। এই কর্নারগুলোতে যারা কাজ করবেন, তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন এমন প্রশিক্ষক ইতোমধ্যে নির্বাচিত করেছে আওয়ামী লীগ। দলটি ঢাকায় ডেকে ওইসব প্রশিক্ষদেরও প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট করণীয়। এ উদ্যোগের আওতায় একটি সুসংগঠিত প্রচার টিমের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে সরকারের উন্নয়ন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বার্তা পৌঁছে দেওয়া হবে। এই টিমের সদস্যদের প্রধান কাজ হবে কেন্দ্রে আসার জন্য ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করা।

নির্বাচন কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের ভোটকেন্দ্রভিত্তিক ‘ইউনিট কমিটি’ গঠন করা হচ্ছে। প্রতিটি কমিটিতে সদস্য থাকবেন ন্যূনতম ১৫০ জন। এভাবে সারা দেশে ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটিতে কাজ করবেন আওয়ামী লীগের প্রায় ৬৩ লাখ নেতাকর্মী। অক্টোবরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ে এসব কমিটি গঠনের নির্দেশ যায়। ইউনিট কমিটির প্রধান লক্ষ্য হলো-সরকারের সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী। বিধবা, অসচ্ছল, পঙ্গু, মুক্তিযোদ্ধা যারা সরকারের কাছ থেকে নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন-তাদের ভোটকেন্দ্রে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবেন ইউনিট কমিটির সদস্যরা। ফলে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে স্বাভাবিকভাবে।

নারী ভোটার টার্গেট :প্রায় ৬ কোটি নারী ভোটারকে ভোট কেন্দ্রে আনার জন্য সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। বিশেষত মহিলা আওয়ামী লীগ এবং যুব মহিলা লীগকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। তৃণমূলে নারীর ক্ষমতায় ঘটেছে এরকম প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে হবে। নারী নেতৃবৃন্দ গ্রামীণ ভোটার হিসেবে চিহ্নিত মা-বোনদের কাছে পৌঁছাতে পারলে সহজেই তাদের মন জয় করতে পারবেন।

ছাত্রলীগ :আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রভিত্তিক ২০ সদস্যের কমিটি গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনে বাধা দেওয়ার সব প্রচেষ্টাও প্রতিহত করার দায়িত্ব পালন করবে ছাত্রলীগের এসব কমিটি।

নির্বাচনে অবৈধ টাকার খেলা বন্ধ করতে হবে। সন্ত্রাস, পেশিশক্তির প্রভাব ও দুর্বৃত্তমুক্ত নির্বাচন করতে হবে। সামাজিকভাবে অপরাধীকে দূরে ঠেলে দিয়ে সৎ মানুষকে সামনে আনতে হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উপেক্ষা করতে হবে। প্রান্তিক বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আশাবাদী করে তুলতে হবে। বিএনপি ও তাদের মিত্ররা জাতীয় নির্বাচন প্রতিরোধ করতে পারে। আর তা মোকাবিলা করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে ভালো নির্বাচনের অন্যতম পথ।

মানবিক শেখ হাসিনাকে তুলে ধরা :কেবল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের উন্নয়নের ফিরিস্তি নয় বরং তাঁর মানবিক দিকগুলো সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে পৌঁছে দেওয়া দরকার। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষকে বোঝানো দরকার বিএনপি-জামায়াত হরতাল-অবরোধের নামে আসলে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। স্বাভাবিক জীবনকে আতঙ্কিত করে তুলেছে বিএনপি-জামায়াতের আগুনসন্ত্রাসীরা।মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়ে যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে তারা- এ বিষয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষ ধিক্কার জানাচ্ছে –এ তথ্য সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে।

মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও জানাতে হবে। ভিডিও এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতের অমানবিক এবং দুর্নীতিময় কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে পারলে মানুষ নিজের গরজে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হবে। এজন্য দরকার কেবল তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা ও তাদের সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের পথ বাতলে দেওয়া। স্বপ্ন দেখানো এবং স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথও দেখাতে হবে তাদের। প্রান্তিক ও গরিব-দুঃখী মানুষকে শেখ হাসিনার কথা বললে তারা আলোড়িত হবে এবং ভোট দিতে গরজ বোধ করবে। তাদের বোঝাতে হবে নৌকা মার্কার ৩০০ আসনই শেখ হাসিনার।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান :বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক স্কুল-কলেজ এবং বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের তরুণ সমাজকে ভোট সম্পর্কে অবহিত করার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষকমণ্ডলীকে। এক্ষেত্রে স্থানীয় লেখক ও সাংবাদিকদের যুক্ত করতে হবে। ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের আনার জন্য ব্যক্তিগত যোগাযোগ খুবই কার্যকর উপায়। এই কাজটি করতে পারে স্থানীয় শিক্ষক-লেখক ও সাংবাদিক সমাজ। মসজিদ-মাদ্রাসার মৌওলানা, ইমামরাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।

উপসংহার:ভোটারদের ভোটদানকে উৎসাহিত করার জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশকে সুন্দর করতে হবে। ভোট দেওয়া একটি নাগরিক দায়িত্ব এটাও প্রচার করতে হবে সাধারণ মানুষের আঙিনায়। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনকে সুনির্দিষ্ট নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ভোটারদের অংশগ্রহণে বাধা হিসেবে চিহ্নিত প্রতিবন্ধকতাগুলো অপসারণ করতে হবে।

জনসংখ্যার বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ভোটদানের তারতম্য চিহ্নিত করে ভোটারদের অংশগ্রহণে উৎসাহিত করার জন্য কৌশল ও পদক্ষেপ নিতে হবে। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৮৭.১৩ শতাংশ, যা বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ৮০ শতাংশ ভোটের হার ছিল ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০২৪ সালে এসব পরিসংখ্যান অতিক্রম করে বিপুল সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি নির্বাচনকে উৎসবমুখর করবে এ প্রত্যাশা সকলের।

লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ। drmiltonbiswas1971@gmail.com

এইচআর/এমএস