প্রবাস

‘ইট মাস্ট হ্যাভ বিন লাভ’

বিশ বছর আগের কথা। আমার বাবা-মা তখন সুইডেনে। তাদের জীবনের শেষ সময়ের বেশিরভাগ সময় সুইডেনে বসবাস করেছেন। কোনো এক সময়ে ছুটিতে বাবা-মাকে নিয়ে লস এঞ্জেলসে ছোট বোনের বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। হঠাৎ মার শরীর খারাপ হবার কারণে তিনি জার্নি বাতিল করলেন, মা সুইডেনে থেকে গেলেন। আমি শেষে শুধু বাবাকে নিয়ে আমেরিকা বেড়াতে গেলাম।

Advertisement

চলছে ঘোরাঘুরি আমাদের, একদিন বাবা বললেন ‘বাবা এখানে কি বাংলাদেশের তৈরি সোনার গয়না পাওয়া যায়?’ আমি বললাম, হ্যাঁ যায়, তবে আধা ঘণ্টার মতো জার্নি হবে গাড়িতে, জায়গার নাম আর্টিশিয়া, লস এঞ্জেলস রেঞ্জের মধ্যে। বাবা বললেন সেখানে যেতে হবে কিছু সোনার গয়না কিনতে। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, কার জন্য? বাবা উত্তরে বললেন তোমার মার জন্য, আমি তার ১২ ভরি সোনা তোমাদের লেখাপড়ার কাজে বিক্রি করেছি, এখন সেটা ফেরত দিতে হবে।

আমি বললাম কেন মা কি বলেছেন সেটা? বাবা বললেন, হ্যাঁ প্রায়ই বলেন। মাকে ফোন করলাম। এ কথা, সে কথা বলতে জিজ্ঞেস করলাম, বাবার কাছে আমাদের জন্য ব্যয় করা তোমার সেই ১২ ভরি সোনা নাকি তুমি ফেরত চেয়েছো? মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আমার বাবা-মা আমার বিয়ের সময় সেগুলো দিয়েছিলেন, আমি সেগুলো এখন ফেরত চাই। কারণ আমি এখন যাকে খুশি তাকে দেব।’ আমি নাছোড় বান্দা নতুন প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। বললাম, বাবা এত টাকা কোথায় পাবেন এখন? মা মুহূর্তের মধ্যে বললেন ‘কোথায় পাবে মানে? তোমরা দিবা।’

এতক্ষণে বুঝলাম, মার ইচ্ছে তাঁর সোনা দরকারে কাজে লেগেছে, এখন তার সকল সন্তানেরা নিজ নিজ পায়ে দাঁড়িয়েছে বিধায় তার সোনা তিনি ফেরত চান। আমি তর্কাতর্কি না করে চলে গেলাম সোনার দোকানে। তবে গাড়িতে যেতে পথে ভেবেছিলাম বাবা-মার এখনও ৯ ছেলে-মেয়ে জীবিত, সবাই প্রতিষ্ঠিত অথচ কেউ বিষয়টাতে সাড়া দিলো না! যাইহোক বাবা তার পছন্দ মতো কয়েক ভরি সোনার গয়না কিনলেন, ছোট বোন জলির তখন সবে বিয়ে হয়েছে, তাকে বেশ কিছু গয়না দিলেন মার তরফ থেকে।

Advertisement

বুঝলাম মা এলে এ কাজটি তিনিই করতেন, যেহেতু আসেননি অসুস্থতার কারণে, সেক্ষেত্রে বাবাকেই বলে দিয়েছেন কাজটি করতে। বাকি সোনা সুইডেন থেকে কিনে দিয়েছি যা তিনি তার অন্য দুই মেয়েসহ বেটার বউদের দিয়েছেন। আমার বউয়ের বাবার বাড়ি স্পেনে, মার বাড়ি সুইডেনে। সে তার নানি এবং দাদির থেকে বেশ সোনা পেয়েছে। পুরনো আমলের সোনা, তারপর মোটা, যা এ যুগের ছেলে-মেয়েরা ব্যবহার করে না।

গতকাল ১৬ গ্রাম (১.৩৭ ভরি) ওজনের একটি গলার হার নিয়ে আমরা স্টকহোমের একটি সেকেন্ড হান্ড সোনার দোকানে গিয়েছিলাম। এখানে সোনা বা ঘড়ি বিক্রি বা বন্ধক রাখার যন্য একটি বিশেষ দোকান আছে যাকে সুইডিশ ভাষায় বলা হয় পান্ট ব্যাংক (pantbank)। আমার সঙ্গে ছিল আমার বউ মারিয়া এবং বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধা। আমি দোকানে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম সোনা বিক্রি করবো, কত দিবা প্রতি গ্রাম? দোকান্দার জিজ্ঞেস করলো কত ক্যারাট? বললাম ১৮ ক্যারাট। দোকান্দার বললো পাঁচ হাজার ক্রোনার। আমি বললাম তিনগুণ কম বর্তমান বাজারের তুলনায়?

দোকানদার বললো, না বেচতে চাইলে বন্ধক রাখতে পার, মাসে ১০ শতাংশ সুদ হারে। এতক্ষণে বড় ভাই চুপচাপ সব কথা শুনছেন, হঠাৎ দোকানদারকে ধরে বসলেন, মাসে ১০ শতাংশ? দোকানদার অল্প বয়েসের একটি মেয়ে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললো, হ্যাঁ। বড় ভাই বললেন, ‘আর ইউ কিডিং?’ এমন সময় দোকানের মালিক এসে হাজির। তিনি বললেন, না আমরা মাসের হিসেবে সুদ নিই। বড় ভাই বললেন সুদের হিসেব সব জায়গায় বছরে হয় তোমরা মাসে নাও? কবে থেকে এমনটি শুরু করেছো?

উত্তরে দোকানের মালিক বললো, দুই ইহুদি বন্ধুর ডিম বণ্টনের গল্প জানো? আমি বললাম, হ্যাঁ (নয়টা ডিম দুই বন্ধু ‘ক’এবং ‘খ’ এর মাঝে চোখের সামনে ভাগ করার পরও একজন পেলো ছয়টা অন্যজন পেলো তিনটা। প্রথমে দুইজনই একটা একটা করে ডিম নিলো, পরে বন্ধু ‘ক‘ তার বন্ধু ‘খ’-কে আরেকটা ডিম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কয়টা পেয়েছো? উত্তরে বন্ধু ‘খ’ বললো দুইটা, এখন বন্ধু ‘ক’ বললো তাহলে আমিও এখন দুইটা নিলাম। এবার বন্ধু ‘ক’ আরও একটি ডিম বন্ধু ‘খ’-কে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো তুমি এখন কয়টা ডিম পেয়েছো? বন্ধু ‘খ’ উত্তরে বললো তিনটা। বন্ধ ‘ক’ তখন বললো তাহলে আমি এখন বাকি তিনটা নিলাম, ব্যাস, হয়ে গেলো ডিম বণ্টন। বন্ধু ‘ক’ পেলো ছয়টা আর বন্ধ ‘খ’ পেলো তিনটা)।

Advertisement

বলো তো সে কোন সময়ের কথা? আমি বললাম হবে ইসলাম ধর্মের আগের সময়। নারী তখন হেসে দিয়ে বললো তার মানে বুঝতে সমস্যা হবার কথা না। এদিকে বড় ভাই রেগেমেগে সুইডিশ ছেড়ে ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করেছেন। যেমন বললেন এই সুদের কারণে ব্রিটিশ তাড়িয়েছি বাংলাদেশ থেকে। অথচ সেই সুদ এখনও চলছে? নারী তৎক্ষণাৎ বলে বসলো, ‘তোমাদের দেশে তো সুদ দেওয়া নেওয়া আরো জোরালো হয়েছে এবং নোবেল পুরস্কারও পেয়েছে, ব্রিটিশ তাড়িয়ে তেমন লাভ হইছে কি?’ বড় ভাই হঠাৎ একটু থমকে গেলেন! পরে বল্লেন, নোবেল তো তোমরা দিয়েছো মাইক্রোক্রেডিটের ওপর, সেটা তো অন্য জিনিস।

নারী বললো, সুদের অংক এক এক জায়গায় একেক রকম। এতক্ষণের আলোচনায় সোনা বিক্রি হলো না তবে বড় ভাই সুইডিশ রয়েল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলোজি বিশ্ব্যবিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রফেসরসহ পদার্থবিজ্ঞান এবং অংকেরও শিক্ষক, তারপর নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. ইউনূসের বেশ কাছের বন্ধু। তিনি কেন ক্ষেপে গেলেন সুদের হার ১০ শতাংশ মাসে শোনার পর! আমি দোকানদারের সব কথা শোনার পর বাংলাদেশে থাকাকালীন ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করতে করতে বাড়ির পথে রওনা দিলাম।

চলতে পথে মনে পড়ে গেলো কত কথা। যারা চড়া সুদ নিয়ে বা বন্দক রেখে গরিবের সম্পদ আত্মসাৎ করত তাদেরকে আমরা সুদখোর বলতাম। সুদখোরদের নাম করে গরুর গলায় গ্রামে মানুষ তাবিজ ঝুলিয়ে দিত, তাতে করে গরুর গায়ে পোকা থাকলে সেগুলো পালিয়ে যেত ইত্যাদি। জানি না এখন এসব প্রথা গ্রামে চলমান আছে কি না! যাইহোক সুদ এবং মুনাফা সম্পর্কে ধর্মীয় মতামত একটু ঘেটে দেখলাম, যার বিশ্লেষণ অনেকটা এরকম।

সুদ গরিবের প্রতি জুলুম। আল্লাহ জুলুম হারাম করেছেন। আর মুনাফা মহান আল্লাহর দয়া ও অনুদান। সুদ রোগাক্রান্ত ও অভাবী ব্যক্তিকে বিপদে ফেলার কৌশল। আর মুনাফা হলো মানুষের চাহিদা পূরণের ফলাফল। সুদে মানসিক ক্ষতি আছে, যা মুনাফায় নেই। মুনাফার সন্ধান করা ইবাদত। তাতে আল্লাহর ভয় থাকে। এর বিপরীতে সুদ আল্লাহর নাফরমানি ও প্রবৃত্তির অনুসরণ। মুনাফায় ঈমান বাড়ে। অন্তরে রহমত আসে। আর সুদের কারণে অন্তর পাষাণ হয়, অহংকার ও কৃপণতা আসে।

মুনাফার কারণে মানুষের মধ্যে মিল-মহব্বত জন্মে এবং হিংসা দূর হয়। আর সুদ সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে এবং হিংসার উদ্রেক ঘটায়। সুদ মানুষের সম্পদ বিনিময়বিহীন গ্রহণ করার পথ। আর মুনাফা এর বিপরীত। সুদ চূড়ান্তভাবে হারাম। আর মুনাফা চূড়ান্তভাবে হালাল। সুদ খাওয়া আল্লাহর নিয়ামতের অকৃতজ্ঞতা। আর মুনাফা আল্লাহর দয়া তালাশ করা। সুদে লভ্যাংশ নির্দিষ্ট।

মুনাফায় অনির্দিষ্ট। তাই মুনাফা ঝুঁকি বহনের পুরস্কার। সুদে ক্ষতির আশঙ্কা নেই। আর মুনাফায় ঝুঁকি থাকে। সুদের সম্পর্ক ঋণ ও সময়ের সঙ্গে। আর মুনাফার সম্পর্ক বেচাকেনার সঙ্গে। সুদ অনেক সময় চক্রবৃদ্ধি আকারে হয়। মুনাফা এর বিপরীত। সুদ ঋণের চুক্তি। আর মুনাফা আর্থিক সম্পদের বিনিময়। সুদপ্রথা সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করে। আর মুনাফা তা বৃদ্ধি করে। সুদ মানুষকে দুর্ভাগা বানায়। আর মুনাফা সৌভাগ্যবান বানায়।

তবে যে সুদের মাধ্যমে মূলধন বৃদ্ধি পায়, আবার ব্যবসায়ের মাধ্যমেও তা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ইসলামে সুদের অর্জিত বৃদ্ধিকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে আর ব্যবসার মাধ্যমে বৃদ্ধিকে হালাল করা হয়েছে। কেননা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীকে মূলধন ও শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়েছে এবং ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়েছে। মূলধন ও শ্রম বিনিয়োগ এবং ঝুঁকি গ্রহণের মাধ্যমে মূলধনের যে বৃদ্ধি তা-ই মুনাফা। এখানে আরও উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ যদি কোনো ব্যক্তিকে ১০ টাকা ঋণ দেয় এ শর্তে যে এক দিন পরে তাকে ১৫ টাকা দিতে হবে।

এখানে অতিরিক্ত ৫ টাকা সুদ, যা ইসলামি শরিয়তে হারাম। বিপরীত পক্ষে, কেউ যদি হাট থেকে ১০ টাকা দিয়ে এক কেজি বেগুন কিনে অন্য বাজারে গিয়ে ১৫ টাকায় বিক্রি করে, তাহলে যে ৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাকে সুদ বলা যাবে না। এই ৫ টাকা লাভ, যা হালাল বলে গণ্য।

পরিশেষে সুদ ও মুনাফার পার্থক্য সংক্ষেপে বলা যায় এভাবে—মুনাফা বেচাকেনা বা ব্যবসার স্বাভাবিক ফল থেকে আসে। বিপরীতপক্ষে, সুদ অর্জিত হয় ঋণের ওপর। মুনাফা উদ্যোক্তার পুঁজি, শ্রম ও সময় বিনিয়োগ এবং ঝুঁকি গ্রহণের ফল; কিন্তু সুদের ক্ষেত্রে ঋণদাতা পুঁজি, শ্রম ও সময় বিনিয়োগ এবং ঝুঁকি গ্রহণ করে না, অর্থ ধার দেয় মাত্র। মুনাফা অনির্ধারিত ও অনিশ্চিত, কিন্তু সুদ পূর্বনির্ধারিত ও নিশ্চিত। মুনাফায় ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়, আর সুদে তা গ্রহণ করতে হয় না।

তারপরও আমার ভাবনায় যা থেকে গেলো সেটা হলো, আমরা বিশ্বব্যাংক বা অন্যান্য দেশ থেকে সুদে যে সব অর্থ নিয়ে দেশের নানা উন্নতি বা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করছি, সুদে-মূলে সে সমস্ত ঋণ জাতিকে কোনো এক সময় শোধ করতে হবে। যে অর্থ বহিঃবিশ্ব থেকে সুদসহ ধার করছি তাও আবার দুর্নীতিবাজদের ছোবলে গ্রাস অতবা বেগম পাড়া, দুবাই, আমেরিকা, সিংগাপুর বা কানাডাসহ নানা দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

রাষ্ট্র ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছু দেখছে বা জানছে না। এটাই কি ঘটনা নাকি অন্য কিছু? এত কিছুর পরও বিশ্বের অর্থনীতি আজ এমনভাবে আমাদের জীবনে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে জড়িত যে আমরা সুদ বা ঋণ মুক্ত কেউ না, এ বিষয় নিশ্চিত। বড় ভাই সব জেনে শুনে যে বিটলামি করলেন আজ, তাতে করে বাধ্য হলাম ঘটনাটি তুলে ধরতে, নিজের খেয়ে, বিনা সুদে, কয়েক ঘণ্টা সময় দিয়ে, জানি না কারো উপকারে আসবে কি না!

আমি সুদ এবং মুনাফার বর্বণা দিতে গিয়ে অন্য একটি বিষয় ভেবেছি, সেটা হলো দুর্নীতি। যেমন সুদও কিন্তু অনির্ধারিত ও অনিশ্চিত, সুদে ঝুঁকি গ্রহণ এবং শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়, তাহলে কি বাংলাদেশ দুর্নীতিকে নীতিতে পরিণত করেছে! তানা হলে সব সেক্টরে এত দুর্নীতি কেন? খুব জানতে ইচ্ছে করে। তবে আমার মার সোনা বিক্রি করে বাবা আমাদের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করেছিলেন। মা পরে বাবার থেকে সুদে নয় শুধু মূলে সেই সোনা ফেরত নিয়েছিলেন এবং পরে সেই সোনা তারই প্রিয় সন্তানদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তার মৃত্যুর আগে, এটা ছিল মা-বাবার ভালোবাসা সে বিষয় আমি আজ নিশ্চিত হয়েছি।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com

এমআরএম/এএসএম