মতামত

জ্বালাও-পোড়াও চলছে, বিদেশি মুরুব্বিরা কোথায়?

কিছুদিন আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে বিদেশিদের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে তাদের দিক থেকে অনবরত সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছিল। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তরফ থেকে বাংলাদেশের জন্য আলাদা ভিসানীতি ঘোষণা করে গণতন্ত্র, নির্বাচন এবং মানবাধিকারের বিপরীতে যারা অবস্থান করবে তাদের বিরুদ্ধে এই নীতি প্রয়োগযোগ্য হবে বলে জানানো হয়। এই ভিসানীতিতে এটাও বলা হয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গই কেবল নয়, তাদের পরিবারের সদস্যরাও এর আওতায় পড়বেন।

Advertisement

গত ২২ সেপ্টেম্বর এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যথু মিলার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আজ থেকেই শুরু হয়েছে।’ এরই মধ্যে এই নীতির প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে এবং বাংলাদেশের কিছু সরকারি কর্মকর্তা এর আওতায় এসেছেন বলে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড ল্যু-ও। তিনি জানান, তাঁর দেশ বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে। কারা এই নিষেধাজ্ঞার আওয়ায় থাকবেন এর জবাবে জানানো হয়, সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যবৃন্দ, সরকারি এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা এর আওতাধীন থাকবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই নীতি ঘোষণার পর আমরা তাদের সহচর কয়েকটি দেশের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন এবং এই নির্বাচন কতটুকু অংশগ্রহণমূলক হবে এসব নিয়ে নানা উদ্বেগের প্রকাশ দেখলাম বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সফরের মধ্য দিয়ে। এসব কিছু থেকেই যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে লক্ষণীয় হয়েছে তা হচ্ছে এক্ষেত্রে আমাদের রাজনীতির মাঠে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির দাবিগুলোই আসলে তাদের উদ্বেগের মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হয়েছে। সেই সঙ্গে সবসময় সরকারের অবস্থানের বিপরীতে থাকা কিছু সুশীল সমাজের নেতৃবর্গ, যাদের বিভিন্ন পর্যায়ে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে তাদের তরফ থেকেও সরকারের উপর একধরনের আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার প্রয়াস আড়াল করার কিছু নেই।

এসব কিছুকে অতিক্রম করে দেশ আজ দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের গন্তব্য আগামী ৭ জানুয়ারির দিকে এগিয়ে চলছে। এরই মধ্যে জানা হয়ে গেছে বিএনপি তাদের দাবিকৃত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে সরকারকে বাধ্য করতে না পারায় এই নির্বাচনটি বর্জন করেছে। তবে তাদের এই বর্জনের মধ্য দিয়ে রাজনীতি এবং নির্বাচনী অবস্থায় সেরকম কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয়নি, যেমনটা তারা প্রত্যাশা করেছিল। এরই মধ্যে এটাও এখন পরিষ্কার যে বিএনপির এই অবস্থানের বিপরীতে গিয়ে তাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা কেউ ভিন্ন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করে, কেউ অপরাপর রাজনৈতিক দলে এবং কেউ বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়াই করার জন্য প্রার্থী হয়েছে।

Advertisement

গত কয়েকদিন আগে বিএনপি থেকে সদ্য বহিষ্কৃত সাবেক সংসদ সদস্য মেজর আখতারুজ্জামান (অব.) (যিনি নিজেও এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী) বলছিলেন, ‘দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে যারা কারাগার থেকে বের করতে পারে, না সেই দল কী করে রাজনীতি করবে? শূন্য নেতৃত্ব নিয়ে আর কতদিন চলবে বিএনপি? ফাঁকা বুলি দিয়ে আর কতদিন চলবে বিএনপি?’ তিনি সার্বিক ব্যর্থতার জন্য লন্ডনে আত্মগোপনে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অভিযুক্ত করেন।

আজকের লেখাটার মূল বিষয়বস্তু আসলে নির্বাচন এবং নির্বাচন ঘিরে যে ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ড সংগঠিত হচ্ছে এবং এর বিপরীতে কিছুদিন আগ পর্যন্ত আমাদের দেশের রাজনীতি এবং নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যে দেশগুলো সরব ভূমিকা পালন করে আসছিল তাদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে। আমরা এরই মধ্যে জেনে গেছি বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও রাজনীতির ময়দানে তারা এর সমর্থনে খুব একটা সঙ্গী জোগাড় করতে পারেনি।

বর্তমানে বাংলাদেশে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৯টি দলের এক হাজার ৮৯৬ জন এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে, যার মধ্যে বিএনপির বাইরে অপর যে দলগুলো এই নির্বাচন করছে না তাদের অতীত নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে খুব একটা সাফল্যের ইতিহাস পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বাইরে জামায়াত এবং জাতীয় পার্টি ছাড়া ক্ষুদ্র অপরাপর দলগুলোর খুব একটা ভূমিকা সচারচর দেখা যায় না, যেমনটা ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যায়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, যুদ্ধপরাধের দায়ে এরই মধ্যে জামায়াত তাদের নিবন্ধন হারিয়েছে, সেক্ষেত্রে সার্বিক অবস্থায় নির্বাচনটি বিএনপি ব্যতীত অপর যারা তাদের সহযোগী হয়ে বর্জন করেছে, তারা বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হওয়া দল, সেদিক দিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে শর্তগুলো পূরণ হওয়া দরকার এর সবকটিই আমরা দেখতে পাচ্ছি এবারের নির্বাচনে।

Advertisement

তবে আমাদের সাম্প্রতিক সময়ে যে বিষয়গুলো বেশি আতংকিত করে তুলছে তা হচ্ছে এই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আমেজে যখন সারা দেশ ব্যস্ত এমন পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষ থেকে একের পর এক হরতাল এবং অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা এবং তা সর্বাত্মকভাবে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও তা অব্যাহত রেখে বিভিন্ন ধরণের নাশকতামূলক ঘটনা ঘটানোর মধ্য দিয়ে জনমনে যেভাবে ভীতি এবং আতংক ছড়ানো হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে কার্যত একটাই উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হচ্ছে, আর তা হচ্ছে এই নির্বাচনী আয়োজনকে ভণ্ডুল করে দেওয়া। আর যদি সাফল্যের সঙ্গে এই কাজটি করা যায় তাহলে তাদের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এটাই বোঝানো হবে যে সরকার আসলে তাদের বাদ দিয়ে যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করছিল তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

আর এর মধ্য দিয়ে সরকারের এই ব্যর্থতাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরাই তাদের উদ্দেশ্য। জনসমর্থনহীন এধরনের কর্মকাণ্ডে কোনো ধরনের সাড়া না পেয়ে সবশেষে তাদের পক্ষ থেকে তথাকথিত অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে। সরকারকে সব ধরনের কর, খাজনা, গ্যাস, পানি এবং বিদ্যুতের বিল না দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে ভবিষ্যতে তারা ক্ষমতায় এলে সব পুষিয়ে দেওয়া হবে।

এটা কোন বাংলাদেশ বানানোর পাঁয়তারা? বিদেশে বসে বিএনপির সর্বোচ্চ নেতার এই আহ্বানে জনগণ যখন সায় দিচ্ছে না, এমন অবস্থায় তারা বেছে নিয়েছে নাশকতার পথ। রাতের অন্ধকারে বাসে বা গাড়িতে আগুন দিয়েও যখন ভীতি ছড়ানো যাচ্ছে না, নিরাপদ বাহন হিসেবে পরিচিত ট্রেনের ওপর নজর দেওয়া হয়েছে।

গত এক সপ্তাহের মধ্যে সাতটি এ ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটানো হয়েছে, যার মধ্যে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৯ ডিসেম্বর। ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া মোহনগঞ্জ ট্রেনে দেওয়া আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন তিন বছরের শিশুসহ মা এবং আরো দুজন। এর কয়েকঘণ্টা পর দিনাজপুরে রেললাইনের স্লিপার লাইনের ওপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে চালকের সতর্কতায় রক্ষা পান শতাধিক যাত্রী।

এভাবে একের পর এক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারা যেভাবে দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে, এর বিপরীতে তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমে এলেও আমরা গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা তাদের দোসরদের মুখ থেকে কোনো ধরনের নিন্দা, ঘৃণা কিংবা উদ্বেগের কথা শুনতে পাচ্ছি না।

কথিত মার্কিন ভিসানীতিতে স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণা থাকলেও বিএনপির কারো বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত এই নীতির প্রয়োগ না হওয়াতে এটাই সন্দেহ জাগে যে বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রা তাদের জন্য এক ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থে বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে নতুন করে উঠে পড়ে লেগেছে। গত ২৮ অক্টোবর সমাবেশের নামে তারা যে ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে, দেশের প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা এবং একজন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, এর পরের প্রতিটি ঘটনা, যার সঙ্গে সামান্যতম জনসমপৃক্ততা নেই জেনেও কোনো ধরণের আন্তর্জাতিক উদ্বেগের সামান্যতম প্রকাশ না ঘটা আমাদের কাছে এটাই বার্তা দেয় যে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদ রয়েছে এর প্রতিটিতে।

বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছে অনেক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মোকাবেলা করে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে সেসময় যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তারাই আজ একটি দলের পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় রয়েছে, যাদের রাজনীতির মূল সঙ্গী একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী শক্তি। একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং দেশপ্রেম আমাদের সব ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করতে পারে এবং এই শক্তি নিয়েই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি- এটাই আমাদের প্রধান প্রেরণা।

লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। mfulka@yahoo.com

এইচআর/এমএস