সব মানুষের মনে ভালো কিছু পাওয়ার ইচ্ছা থাকে। কারও কাছে সুন্দর কিছু দেখলে মনে হতে পারে ইস্ আমারও যদি এ জিনিসটা থাকতো। অন্যের ভালো আসবাবপত্র, সুন্দর বাড়ি-গাড়ি দেখেও আমাদের পেতে ইচ্ছা হতে পারে। এমনকি বন্ধু খুব ভালো রেজাল্ট করলেও একধরনের কষ্ট হতে পারে মনে। বন্ধু ১৮ ঘণ্টা পড়াশোনা করেছে বলে রাগ হতাম, বিরক্ত হতাম। আমার এই রাগের মধ্যে কোনো অপরাধ ছিল না এবং মনের এ অবস্থাকে হিংসা বলে না। হিংসা হতো তখনই, যদি ওর ক্ষতি করার ইচ্ছা হতো।
Advertisement
হিংসা নামের ক্ষতিকর রিপুটা এখন আমাদের মনে এতটাই ডালপালা মেলে বসেছে যে, মনের ভেতরে সত্যিকারভাবে হিংসার উদ্রেগ হলেও আমরা অনেকেই তা বুঝি না। বুঝলেও সরানোর চেষ্টা করি না এবং নিজেদের মনের হিংসা ও হীনতা নিয়ে মাথাও ঘামাই না। উপরন্তু হিংসা নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি এবং হিংসার কারণে মানুষের ক্ষতি করতেও কুণ্ঠিত হচ্ছি না। আমাদের চারপাশে এখন যত বড় বড় অপরাধ হচ্ছে, তা হচ্ছে লোভ ও হিংসা থেকে।
কথাটা মনে হলো এজন্য যে আমরা কি পারছি আমাদের সন্তানদের হিংসা ও লোভ ছাড়া বড় করতে? ‘হিংসা যে কতটা ভয়াবহ পরিণাম বয়ে আনতে পারে, সেটা নিয়ে কি সন্তানের সাথে কখনো কথা বলেছি? হিংসা, দ্বেষ, অহংকার, রাগ যে বিপজ্জনক সেটা নিয়ে কেন আমরা নিজেরাও ভাবি না এবং সন্তানকেও ভাবতে সাহায্য করি না? আমরা বড়রা হিংসা, অহংকার, লোভ, রাগ, ঘৃণাকে মন থেকে তাড়াতে পারি না বলে ছোটদেরও এ বিষয়ে শিক্ষা দেই না। হিংসা মানুষের ষড়রিপুর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর রিপু। হিংসা থেকেই লোভ হয়, হিংসা থেকেই ধ্বংস করার ইচ্ছা জাগে। হিংসার কারণেই রাগ বাড়ে। এই হিংসার কারণেই অন্যের যেমন ক্ষতি হয়, পাশাপাশি নিজের মন ও শরীরেরও ক্ষতি হয়। আমার মা বলতেন, লোভী আর হিংসুক মানুষ কখনো বড় হতে পারে না।
কিন্তু আসলে কি তাই হয়? লোভী আর হিংসুক মানুষ কি সত্যিই বড় হয় না? যদি বড় নাই-ই হতো, তাহলে চারদিকে এত বড় মাপের লোভী ও হিংসুক মানুষ কেন দেখছি আমরা। কেন পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম সব ইস্যুতে আমাদের মনে হিংসা খুব বেশি পরিমাণে কাজ করে? আর এ হিংসার কারণেই সবক্ষেত্রে আমরা ধ্বংসাত্মক কাজ বেশি করছি। প্রতিদিন খবরে দেখছি কারও পুকুরে প্রচুর মাছের চাষ হয়েছে বলে বিষ দিয়ে সেই মাছ মেরে ফেলেছেন তার প্রতিবেশী।
Advertisement
অথবা হাঁস চাষ করে কেউ লাভের মুখ দেখছেন বলে তারই আরেক ভাই বিষ দিয়ে হাঁসগুলো মেরে ফেলেছেন। শুধু কি তাই? ছোট ভাইয়ের বাচ্চা হয়েছে বলে হিংসায় বড় ভাই ও তার বউ মিলে নবজাতককে মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটিয়েছে। কী ভয়াবহ ব্যাপার, এগুলো বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। প্রতিবেশীর কলার ক্ষেতে অনেক ফলন হয়েছে বলে, এক রাতে পুরো কলাক্ষেত কেটে তছনছ করে দিয়েছে এমন খবর তো দেখছি হরহামেশা। এমনকি একদল পাখি সরিষা ক্ষেতে সরিষা খেতে আসে বলে বিষ দিয়ে পাখিগুলো মেরে ফেলার অমানবিক ঘটনাও ঘটেছে।
গ্রামে, এমনকি শহরেও প্রায়ই শোনা যায় কারও ভালো বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে, কান ভাঙচি দিয়ে সেই বিয়ে ভেঙে দেওয়ার ঘটনা। এটাকে বলে ‘কানপড়ানি’। একশ্রেণির মানুষই থাকেন যারা অন্যের বিয়ে ভেঙে দিয়ে প্রভূত শান্তি পান। কোনো দম্পতির সন্তান না হলে তাদের হেয় করা, কারও বিয়ে বিচ্ছেদ হলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করা হয়, এমনকি কারও সন্তান আত্মহত্যা করলেও সেই পরিবারকে নিয়ে বাজে কথা বলাটা যেন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এমনও দেখি কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য করে বা অতিরিক্ত কাজ করে টাকা আয় করেছেন বলে তাতেও সর্বনাশ ঘটে যায়। সেই ব্যক্তির নামে মিথ্যা কথা রটিয়ে প্রায় একঘরে করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এগুলো সবই হিংসা থেকে উৎসারিত ঘটনা।
কোন নারী বা মেয়ে কাজ করতে শহরে বা বিদেশে যাওয়ার পর, মেয়েগুলো যখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ফিরে আসেন, তখন তাদের নিয়েই প্রচুর নিন্দা-মন্দ করা হয়। হিংসার বশবর্তী হয়ে তাদের চরিত্র এমনভাবে হনন করা হয়, যেন এদের সবাই মন্দ বলে, এদের বিয়ে না হয় এবং এরা যেন সমাজ বিছিন্ন হয়ে পড়ে। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে যে মেয়েরা কাজ করতে বাইরে গেলেন, আয় করলেন, নিজের পায়ে দাঁড়ালেন, নিজ পরিবারের উন্নতি করলেন অথচ তাদের নিয়ে অনেক আজেবাজে মন্তব্য করে সমাজ। কিন্তু কেন এমনটা করে সমাজ? করে হিংসা থেকে। এই সমাজের গাত্রদাহ হয় এই ভেবে যে, কেন এই খেটে খাওয়া মেয়েগুলো আর দরিদ্র নয়, কেন ওরাও নিজের অবস্থান শক্ত করে ফেলেছে? তাই ওদের ক্ষতি করতেই হবে। কাজেই পেছন থেকে এদের টেনে ধরে নিচে নামাতেই হবে।
এই পা ধরে অন্যকে টেনে নিচে নামানোটা যে অন্যায় ও অপরাধ, হিংসা করা যে পাপ একথাগুলো আমরা অনেকেই মেনে চলি না, আমাদের সন্তানদেরও শেখাই না। আর তাই শিশুরা যখন অন্য বন্ধুর ভালো কিছু দেখে হিংসা করে, এবং তাদের মধ্যে লোভ সৃষ্টি হয়, তখন তারা তা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। হিংসার এই পরিধি ব্যক্তি থেকে পরিবারে, পরিবার থেকে সমাজে ও সমাজ থেকে রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে।
Advertisement
সরকারকে যারা পছন্দ করেন না, তারা এ সরকারের সময়কালে করা ভালো উদ্যোগগুলোকে হিংসা করেন, মন্দ বলেন। সুযোগ পেলে এই অবকাঠামোগুলোর ক্ষতি করার চেষ্টাও করেন। নিজের ধর্ম ভালো, নিজেরা ভালো, নিজের চিন্তাই উত্তম এরকম মানসিকতাই আমাদের মনকে কলুষিত করে তোলে। তাই বাংলাদেশি দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং লেখক আরজ আলী মাতুব্বর যথার্থই বলেছেন, ‘সকলেই বলিয়া থাকেন যে তাঁহাদের আপন আপন ধর্মই একমাত্র সত্যধর্ম, অন্য কোন ধর্মই সত্য নহে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের স্বর্গপ্রাপ্তি, পরিত্রাণ, নির্বাণ বা মোক্ষলাভ ঘটিবে না। এ যেন বাজারের গোয়ালাদের ন্যায় সকলেই আপন আপন দধি মিষ্টি বলে।’
বাংলাদেশের মানুষ এত দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেছি যে ধর্মকর্ম, নীতি-নৈতিকতা, শাসন-শাস্তি কোনোটাই আর আমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না, এর অন্যতম একটি কারণ লোভ। আর এই লোভ এসেছে হিংসা থেকে। ওর আছে, আমার নাই কেন? তাই অন্যের সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য যে কোনো ধরনের অন্যায় ও দুর্নীতি করতেও মানুষের হাত কাঁপে না।
মানুষের চরিত্রে যেসব খারাপ দিক আছে, তার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ খুব বেশি ক্ষতিকারক। এটি এমন একটি ব্যাধি যা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কুড়ে কুড়ে খায়। এতে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবন যেমন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, তেমনি নিজের শরীরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কুচিন্তা, না পাওয়ার কষ্ট এবং অন্যের ক্ষতি করার চিন্তা ব্যক্তিকে মানসিকভাবেও অসুস্থ করে তোলে।
বাংলাদেশের মানুষ দিনরাত ধর্মের কথা বলেন, বেহেশত-দোযখের চিন্তা করেন, ওয়াজ শোনেন, হারাম-হালাল নিয়ে ফতোয়া দেন, নারীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেন। কিন্তু তারা কি জানে না যে, অন্যের সুখ-শান্তি ও ধন-সম্পদ নষ্টের চিন্তা ইসলাম সম্পূর্ণভাবে হারাম বা নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনে সতর্ক করে আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন, সেজন্য কি তারা তাদের ঈর্ষা করে?’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৪)
বিশেষ করে সম্পদের মোহ, পদমর্যাদার লোভ মানুষের সব ভালো কাজকে নষ্ট করে দেয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন ‘তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নিবৃত্ত থাকবে। কেননা, হিংসা মানুষের নেক আমল বা পুণ্যগুলো এমনভাবে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়।’ (আবু দাউদ)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা এরূপ ধারণা জঘন্যতম মিথ্যা। আর কারও দোষ অনুসন্ধান করবে না, কারও গোপনীয় বিষয় অন্বেষণ করবে না, একে অন্যকে ধোঁকা দেবে না, পরস্পর হিংসা করবে না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করবে না, পরস্পর বিরুদ্ধাচরণ করবে না, বরং তোমরা সবাই এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে থাকবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)। অথচ বাস্তবে আমরা কী দেখছি, কোন পথে চলেছি?
শুধু ইসলাম নয়, প্রতিটি ধর্মই মানুষকে হিংসা, লোভ ও অহংকার করা থেকে বিরত থাকতে বলেছে। কিন্তু মানুষ তা শুনছে কোথায়? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইনের ‘মনোদর্পণ’ নামে একটি গল্প এই লেখাটির সাথে যায় বলে উল্লেখ করছি। তরুণ ভিক্ষু সুরবজ্র নিজের বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে আত্মপ্রশংসায় আপ্লুত হয়ে থাকেন। তিনি সুযোগ পেলেই ভিক্ষু কমলসম্ভবের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং নিজের জ্ঞান গরিমা জাহির করেন। একদিন সুরবজ্র কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই কমলসম্ভবকে আক্রমণ করে বললেন, ‘সবাই আপনাকে একজন বোধিসত্তা ভাবে, কিন্তু আপনি তা নন। আপনার মাথাভর্তি গোবর, আপনি আবর্জনার স্তূপের মতো সারা দিন অলসভাবে পড়ে থাকেন।'
কমলসম্ভব লজ্জা পেলেও উদাসীনভাবে সুরবজ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘প্রিয় সুরবজ্র, আমি কিন্তু তোমার মধ্যে স্বয়ং বুদ্ধকেই দেখতে পাই।’ সুরবজ্র চতুর হাসি হেসে বিদায় নিলেন এবং বাড়ি ফিরে যাকেই পেলেন, তাকেই বলতে থাকলেন ‘আজ কমলসম্ভবকে ধ্বসিয়ে দিয়েছি।’
সুরবজ্র তার বোনকে ঘটনাটা বললেন। সব শুনে উত্তমা বললেন, ‘না, ভ্রাতা, তুমিই বরং তার কাছে বাজেভাবে হেরেছ।’ ‘কারণ, তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তোমার স্বরূপটা কেমন। তুমি কি জানো না যে, বাইরে তুমি যা দেখো, তা তোমার মনেরই ছবি। বোধিসত্তা কমলসম্ভব যে তোমার মধ্যে বুদ্ধকে দেখেছেন, তার কারণ তিনি নিজে তাই। তুমি তাকে আবর্জনার স্তূপ হিসেবে দেখেছ কারণ তোমার মনের মধ্যে ময়লার স্তূপ আছে। সুরবজ্র নির্বাক হয়ে গেলেন।
মানুষের অন্তরের অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ ও লোভ তার সব জ্ঞান সৌন্দর্যকে নষ্ট করে দেয়। হিংসা একধরনের মানসিক রোগ। যারা হিংসুক, তারা কোনোভাবেই ইতিবাচক মানসিকতার হয় না। এরা নিজে যা, অন্যকেও সেভাবে দেখে। কখনো অন্যের ভালো চাইতে পারে না। উপনিষদের ভাষায় বলা যায়- তোমার কামনা যা, তোমার ইচ্ছাও তাই, তোমার ইচ্ছা যা, তেমনই তোমার কর্ম, তোমার কর্ম যা, সেটাই তোমার নিয়তি।’
প্রতি বছরই আমরা নতুন বছরকে স্বাগত জানাই, আনন্দ উদযাপন করি, ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখি, অন্যের মঙ্গল কামনা করি, পটকা, আতশবাজি, পার্টি, নাচ-গান করি। অথচ এগুলোর অনেক কিছুই করি শুধু বাহ্যিক আনন্দলাভের জন্য। পরদিন তা ভুলে যাই। নতুন বছর আসে আর যায় কিন্তু আমরা অনেকেই মানসিকভাবে সেই দীন হীনই থেকে যাই। নতুন বছরে এসে আমরা কি বলতে পারি না ঊনিশ শতকের সাংবাদিক, লেখক ও কবি হরিশচন্দ্র মিত্রের কথাগুলো- আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপারসংসারে সে বড় হয়, বড় গুণ যার।গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবেবড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।”
১৯ ডিসেম্বর, ২০২৩
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এমএস