রাজনীতি

মানুষ আমাকে ভয় পায় না, ভালোবাসে

এ কে এম শামীম ওসমান। ব্যক্তিগত জীবনে খুবই স্পষ্টবাদী ও সাহসী এই ব্যক্তির যেমন সমালোচনা আছে, তেমন প্রশংসাও। বাবা এ কে এম শামসুজ্জোহা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ সদস্য। দাদা এম ওসমান আলী ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পৈতৃক সূত্রে আওয়ামী রাজনীতিতে যুক্ত শামীম ওসমান। ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের তিনবারের এমপি তিনি।

Advertisement

জাগো নিউজের সঙ্গে জীবনের নানা বাঁক নিয়ে খোলামেলা কথা হয়েছে তার। বলেছেন, মানুষ তাকে ভয় পায় না, বরং ভালোবাসে। তবে তিনি আল্লাহ ছাড়া কাউকে কেয়ার করেন না। তার বড় শক্তি বাবা-মা’র দোয়া। তিনি মনে করেন, বাবা-মা’র দোয়া থাকলে কোনো অনিষ্ট কাজে আসে না।

দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সালাহ উদ্দিন জসিম।

জাগো নিউজ: আপনাকে অনেকে ভয় পায়। অথচ আপনি কাউকে ভয় পান না। এই শক্তিটা কোত্থেকে পান?

Advertisement

শামীম ওসমান: আমি একটা মানুষ। এই বিশ্বাসটা যদি থাকে আমার ভেতরে, এই পৃথিবীতে আমরা এসেছি, পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। আর কিছু না। আমরা জিরো। আমরা কাল মারা যেতে পারি, আজও মারা যেতে পারি। আমি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি, বিশ্বাস রাখি। এর বাইরে কিছু না। তবে আপনি যেটা বললেন, ভয় পায়। আপনি আমার সঙ্গে রাস্তায় চলেন, বাংলাদেশের যে কোনো জেলায়। দেখবেন, মানুষ আমাকে ভয় পায় না। বরং প্রচণ্ড ভালোবাসে। বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্ম।

গতকাল আমি (রোববার) সিলেটে গেছি, সেখানে অন্তত এক হাজার মানুষ আমার সঙ্গে ছবি তুলেছে। এর মধ্যে পাগলও ছিল, ফকিরও ছিল। আমি কাউকে না করি না। বরং আমি মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বলি। অনেকে হয়তো আমার কথা পছন্দ করেন না। কারণ, যে খারাপ আমি তাকে সরাসরি খারাপ বলি। যে ভালো, সরাসরি ভালো বলি। আমাকে তো জামায়াত-বিএনপি ভালো বলবে না। তাদেরও তো বিশাল অংশ আছে, এটা তো অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

আরও পড়ুন>> সামনে সরকার কোনো বিপদ দেখছে না

তাদের ভেতরে সাংবাদিক, পুলিশসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ আছে। তারা যখন আমার বিষয়ে নেতিবাচক বলে, তাদের প্রচার মাধ্যমে যখন আমাকে নিয়ে নেগেটিভ কথা বলে, প্রগতিশীল সেজে যারা প্রতিক্রিয়াশীলের হয়ে কাজ করে, তাদের নেগেটিভ কথায় আমি মনে করি আমি সঠিক পথে আছি। যেদিন থেকে তারা আমার পক্ষে কথা বলা শুরু করবে, আমি মনে করবো আমি আমার পথ হারিয়েছি।

Advertisement

…রাজহাঁসের গলাকাটা হয়েছে। ওকে (সেলিম ওসমান) পিস্তল দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। যদি আমরা গডফাদারই হতাম, তাহলে তো প্রতিশোধ নিতাম। আমরা তো ক্ষমতায় আজ ১৫ বছর। অথচ আমরা কোথাও তো কাউকে ফুলের টোকাও দেইনি। আমি ভেবেছি, ওরা যা করেছে, তার কারণে মানুষ তাদের ঘৃণা করে।

আর শক্তির যে কথা বললেন, আসলে বড় শক্তি হলো- বাবা-মার দোয়া। আমি বিশ্বাস করি, বাবা-মায়ের দোয়া থাকলে কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। যার বাবা-মা আছে তারা যেন তাদের সেবা করে। মায়ের দিকে একবার তাকালেও কবুল হজের সওয়াব পাওয়া যায়।

জাগো নিউজ: তিন প্রজন্মের রাজনীতিবিদ আপনি। পারিবারিক একটি ঐতিহ্য আছে আপনার রাজনীতিতে। বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির ধারক-বাহক আপনার পরিবার। কিন্তু তৃতীয় প্রজন্মে তথা আপনার সময়ে এসে কোথাও কোথাও সমালোচনা আছে। এটা কেন?

শামীম ওসমান: যে কাজ করবে তারই তো সমালোচনা হবে। যে কাজ করবে না তার তো সমালোচনা নেই। আমি এটা বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে কেউ পারফেক্ট না। না আপনি, না আমি, সবাই। আরেকটা বিষয় হলো- আমাদের পরিবারটা স্বাধীনতার পক্ষের পরিবার। আমার দাদা (ওসমান আলী) নবাব হাবিবুল্লাহর জামানত বাজেয়াপ্ত করে ঢাকা বিভাগ থেকে এমএলএ হয়ে ছিলেন। আমার দাদা ও বাবা দুজনেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। আমরা তিন ভাই এমপি হয়েছি। যারা হতে পারেন নাই, তাদের তো একটা ক্ষোভ থাকেই। তারাই আমাদের বিরুদ্ধে নানা সময়ে নানাভাবে নেতিবাচকতা ছড়ায়।

জাগো নিউজ: আপনি বিএনপির লংমার্চ আটকে দিয়েছিলেন, সেই ঘটনায় সারা দেশ তোলপাড় হয়েছিল, আপনি কি নিজে থেকে লংমার্চ আটকেছিলেন, নাকি কারও নির্দেশ ছিল?

শামীম ওসমান: ১৯৯৬ সালে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিচুক্তি হলো। তখন খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেতা। তখন বলা হলো- নোয়াখালী পর্যন্ত বাংলাদেশটা অন্য দেশ হয়ে যাবে। যদিও এখন পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু এই অজুহাত তৈরি করে বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসী সংগঠন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। ওই সফরে সব গাড়ি মার্কিং করা ছিল। ১ নম্বর গাড়ি, ২ নম্বর গাড়ি, এভাবে। আগের দিন আমাকে বলা হলো, খালেদা জিয়ার ছয়টা গাড়ির পর দুটো বাস ছিল। সেখানে লেবার শ্রেণির লোক নেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে মাটি কাটার লেবার নেওয়া হয়েছিল। সেই গাড়ি দুটো ফেনীতে (যেহেতু সেখানে জয়নাল হাজারীর বাসা) কোনো এক জায়গায় বোমা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়ার কথা।

সেজন্য চট্টগ্রামে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ একটা টিম, ঢাকায় মির্জা আব্বাস-সাদেক হোসেন খোকাসহ একটা টিম, এভাবে টিম ভাগ করা হয়েছিল। খালেদা জিয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে না, ৬৫ জন নিহত হয়েছে ইত্যাদি। সেই রাতে একটা সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল, এটা আটকাতে হবে একটা সময়ের জন্য। যাতে সময়টা পিছিয়ে যায়। কিন্তু কোনো রকম আঘাত করা যাবে না। কোনো ধরনের ঝামেলা করা যাবে না। ওটা খুব কঠিন কাজ ছিল। ওই কর্মসূচিতে গোলাম আযমও ছিল। আমরা কিন্তু ওই কাজটা করেছি। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বহর আটকে রেখেছি। যখন পুরো রাস্তায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলো এবং বলা হলো, তারা যেতে পারে তখন আমরা ছেড়ে দিয়েছি, তারা কিন্তু গেছে। পরদিন সংসদে এ নিয়ে আমার ওপর ক্ষেপলেন। কারণ আমার কারণে তাদের ৫শ কোটি টাকার প্রকল্প ভেস্তে গেলো।

আরও পড়ুন>> রাজনীতিতে হেভিওয়েটদের ডায়েটে যাওয়া উচিত

জাগো নিউজ: বিরোধীদের তীর্যক মন্তব্য কি আপনাকে রাজনীতিতে কঠোর হতে উদ্বুদ্ধ করেছে?

শামীম ওসমান: না। বরং উল্টো হয়েছে। তারা যখন দেখলো, নানা রকম কথা বলে আমাকে কিছু করা যাচ্ছে না। তখনই আমার ওপর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বোমা হামলা হলো। আমার ২০ জন মানুষ মারা গেলো। আমি পঙ্গু হলাম। আমার অনেকেই পঙ্গু হয়েছে। একজন বন্ধুর পা নাই। ২০০১ এর পরে আমার বাড়ি ভাঙা হয়েছে। আমার মেজো ভাইয়ের খামারে গিয়ে বোবা প্রাণী ৩০০ গরুর দুধের বান কাটা হয়েছে। রাজহাঁসের গলাকাটা হয়েছে। ওকে (সেলিম ওসমান) পিস্তল দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। যদি আমরা গডফাদারই হতাম, তাহলে তো প্রতিশোধ নিতাম। আমরা তো ক্ষমতায় আজ ১৫ বছর। অথচ আমরা কোথাও তো কাউকে ফুলের টোকাও দেইনি। আমি ভেবেছি, ওরা যা করেছে, তার কারণে মানুষ তাদের ঘৃণা করে।

আমার রাজনীতির পরে যদি একটা পেশা ভালো লাগে, সেটা সাংবাদিকতা। এমনও হতে পারে, রাজনীতি ছাড়লে আমি সাংবাদিকতা করবো। আমার ইচ্ছা আছে। এই দুটো জিনিসের জন্য একটি জিনিস লাগে। সেটা সত্য। সত্য সুন্দর, সুন্দরই সত্য। আপনি যদি রাজনীতি করেন, তাহলে সাহস থাকলে সত্য কথা বলেন। আর সাহস না থাকলে বলবেন না।

জাগো নিউজ: প্রশাসনকে আপনি অনেক সময় হুমকি দেন। এটা কি চাপে রাখার জন্য, নাকি আপনি মনে করেন, তারাও আইনে ঊর্ধ্বে নয়?

শামীম ওসমান: আমি তো বলেছি, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। প্রশাসন কেন, আমি তো সংসদে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার বিরুদ্ধেও কথা বলেছি। আমার রাজনীতির পরে যদি একটা পেশা ভালো লাগে, সেটা সাংবাদিকতা। এমনও হতে পারে, রাজনীতি ছাড়লে আমি সাংবাদিকতা করবো। আমার ইচ্ছা আছে। এই দুটো জিনিসের জন্য একটি জিনিস লাগে। সেটা সত্য। সত্য সুন্দর, সুন্দরই সত্য। আপনি যদি রাজনীতি করেন, তাহলে সাহস থাকলে সত্য কথা বলেন। আর সাহস না থাকলে বলবেন না।

আরও পড়ুন>> ‘সরকার ৭ জানুয়ারি নির্বাচন করতে পারবে বলে মনে করি না’

একইভাবে সাংবাদিকতায়ও। আপনি যদি লেখেন, সাহস নিয়ে সত্য লেখেন। আর যদি তা না পারেন, লিখবেন না। কিন্তু নিউজ তৈরি কইরেন না। আপনার কাজ সত্য তুলে ধরা। আমার কাজ সত্যটা বলা। আমি বলছি না আমি পারফেক্ট। তবে আজ পর্যন্ত চেষ্টা করেছি, পার্টির ভেতরে বা বাইরে, ঘরে বা বাইরে সত্যটা বলার। এই প্রশ্নে, আমি আল্লাহ ছাড়া কাউকে কেয়ার করি না।

জাগো নিউজ: সাংবাদিকদের সঙ্গেও তো আপনার সমস্যা হয়?

শামীম ওসমান: আমার সঙ্গে কখনো কোনো সাংবাদিকের সমস্যা হয়নি। যারা বলে আমার সমন্ধে, তারা বরং নারায়ণগঞ্জে অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিকের নামে মামলা করেছে। আমি কিন্তু জীবনেও কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করিনি।

 

জাগো নিউজ: কিন্তু, আপনার কথা, উক্তি বা মাঠের বক্তব্য কখনো কখনো আপনাকে সমালোচনায় ফেলে দেয়, রাজনীতির মাঠের ভাষাই কি আলাদা হয় বলে?

শামীম ওসমান: না। রাজনীতির মাঠের ভাষা আলাদা হবে কেন? রাজনীতির মাঠে যেটা বলি, সেটাই আমি সঠিক বলি। আপনাকে মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালে ২১ শতাংশ লোক আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। তার অর্থ কী? একটা শক্তি ছিল, যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। তারা তো মরে নাই বা দুনিয়া থেকে উধাও হয়ে যায় নাই। বরং ১৯৭৫ এর পর থেকে এরা বেড়েছে সব জায়গায়। ওই শক্তি তো চুপ করে বসে থাকবে না। অনেকে বলে বিরোধী দল তো থাকবেই। বিএনপি বিরোধী দল। একটা সময় আমিও বিএনপিকে বিরোধী দল ভাবতাম। স্যরি, আমি এখন বিএনপিকে বিরোধী দল ভাবতে পারি না। কারণ, যে দলটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে ২১ আগস্ট ঘটায়, সাবেক অর্থমন্ত্রীকে হত্যা করে, শ্রমিক নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করে, মেয়েদের ধর্ষণ করে। বাদ দেন সেগুলো। ২০১৩-১৪ তে এসে কী করলো? আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারলো। আমরা ভাবলাম, ওরা হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। এটা আমাদের সরকারের ব্যর্থতা। তখন যদি তাদের বিচার হতো, আজ তারা এই সাহস দেখাতে পারতো না। এখনো কিন্তু ৮/৯শ গাড়ি পোড়ালো।

জাগো নিউজ: বিএনপির অভিযোগ- তাদের ওপর দমনপীড়ন হচ্ছে। তাদের নেতারা জেলখানায়। তারপরও আপনি বলছেন, আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন ছিল তাদের প্রতি?

শামীম ওসমান: আমি মনে করি, আইনের শাসন হওয়া উচিত। আমি আইনের ছাত্র। আমি একটা জিনিস বুঝি, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সবাই আইনের মধ্যেই। আপনি একটা দেশ দেখান তো যেখানে স্বাধীনতার বিরোধিতা হয়েছিল। দেশবিরোধীরা আবার রাজনীতি করার সুযোগ পায় কেমন করে?

এসইউজে/এএসএ/এমএস