করোনা মহামারির কিছুদিন আগে থেকেই ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিবিধ প্রশ্ন তুলেছিলেন বিশেষজ্ঞেরা। অনেকেই মনে করছিলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ক্রমেই খারাপ হচ্ছে ও তার একমাত্র কারণ হলো ভুল পররাষ্ট্রনীতি। মনে রাখা দরকার, সে সময় নেপালের মতো রাষ্ট্রের সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল ভারত। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও একের পর এক উত্তেজনামূলক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল।
Advertisement
যে বিশেষজ্ঞেরা সে সময় ভারতের পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করছিলেন, তারাই পরবর্তী সময়ে ভারতের বর্তমান আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন। তাদের অনেকেই মনে করেন, করোনার সময় থেকে ভারত সরকার যেভাবে পররাষ্ট্রনীতি চালিয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রনিধানযোগ্য।
বস্তুত, সাম্প্রতিক সময়ে কানাডা বিতর্ক ও কাতার সমস্যার প্রেক্ষাপটেই বিশেষজ্ঞেরা ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে শক্তিশালী বলে মনে করছেন। তাদের বক্তব্য, এই দুই ক্ষেত্রে ভারত যেভাবে সবকিছু সামলেছে, তা দেশের কূটনীতির জন্য অত্যন্ত সাফল্যের। বছরচারেক আগেও এসব নীতি খুব একটা কার্যকর হবে বলে মনে হচ্ছিল না।
দ্রুত একবার বর্তমান সময়ের দিকে চোখ রাখা যাক। খালিস্তানি সমস্যা ভারতে নতুন নয়। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ইন্দিরা গান্ধী অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে অপারেশন ‘ব্লু স্টার’ পরিচালনা করিয়েছিলেন। তার কিছুদিনের মধ্যেই নিজের শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন ইন্দিরা। এ সবই খালিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।
Advertisement
ইন্দিরা সরকারের সঙ্গে সে সময় কানাডা সরকারের বিতর্ক হয়েছে খালিস্তানপন্থি নেতাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য। সময়ের স্রোতে সেই বিতর্ক কখনো কমেছে, কখনো বেড়েছে। সম্প্রতি সেই বিতর্ক ফের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভারত-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক কার্যত থেমে গেছে।
ভারতের সাবেক সেনা কর্মকর্তা লেফটন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্যের বক্তব্য, এক খালিস্তানি নেতাকে হত্যার বিষয়ে কানাডা যে অভিযোগ করছে, সেই বিতর্কে ঢোকার প্রয়োজন নেই। দেখার বিষয় হলো, এই বিতর্ক ঘিরে যে দড়ি টানাটানি চলছে, তাতে ভারত নিজের অবস্থানে স্থির থাকছে। কানাডার চাপে নিজের অবস্থান বদলে নেয়নি। এটা শক্তিশালী কূটনীতির পরিচয়।
‘শুধু তা-ই নয়, কানাডা চেষ্টা চালিয়েছে, বৃহৎশক্তিগুলোকে নিজের দিকে টেনে নিতে। কিন্তু ভারতীয় কূটনীতি সেটা করতে দেয়নি। ভারত বুঝিয়ে দিতে পেরেছে, এই বিতর্কে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তি সরাসরি কানাডাকে সমর্থন করলে অন্য বিতর্কে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের পাশে থাকবে না। উৎপলের বক্তব্য, এটাই কূটনীতির খেলা ও সেখানে ভারত নিজের ভূমিকা পালনে সফল হয়েছে।
শুধু কানাডা নয়, সম্প্রতি ইসরায়েলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে আট সাবেক ভারতীয় নৌসেনাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার। এ ঘটনাতেও ভারত কাতার সরকারের সঙ্গে লাগাতার আলোচনা চালিয়েছে। শেষপর্যন্ত কাতারের আদালতে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ তৈরি করে নিয়েছে। এটিও ভারতের কূটনৈতিক বিজয় বলে মনে করছেন উৎপলের মতো একাধিক কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ।
Advertisement
অর্থনীতিবিদ ও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ভারত একদিনে এই শক্তিশালী কূটনৈতিক অবস্থানে পৌঁছায়নি। গত কয়েকবছরে ঘটে যাওয়া বেশকিছু ঘটনা ও তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অবস্থান দেশকে এই শক্তিশালী কূটনৈতিক অবস্থানে নিয়ে গেছে।
করোনার সময় চীনের সঙ্গে সংঘাতে গিয়েও ভারত যেভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন দীপঙ্কর। পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোকে চীন থেকে ভারতের দিকে দৃষ্টি ঘোরাতে সাহায্য করেছে বলেও তিনি মনে করেন।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান ও তেল বাণিজ্য ভারতের পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্ব গোটা বিশ্বে আলোচনার বিষয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া দুইপক্ষই ভারতে এসে বৈঠক করতে বাধ্য হয়েছে। দীপঙ্করের মতে, বর্তমান কূটনৈতিক অবস্থান এসব সাম্প্রতিক ঘটনার উপর দাঁড়িয়ে আছে। কূটনৈতিকভাবে ভারতের উপর চাপ তৈরি এখন আর সম্ভব নয়। কারণ ভারত প্রমাণ করেছে, তারাও পাল্টা চাপ তৈরি করতে পারে। সম্প্রতি কানাডার ঘটনা সে কথাই স্পষ্ট করছে।
দীপঙ্কর ও উৎপলের অভিমত এই মুহূর্তে ভারতের বহু কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞই মানেন। তবে কেউ কেউ আবার প্রশ্নও তোলেন। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ রায়ের প্রশ্ন, ভারতের কূটনীতিকে যতটা শক্তিশালী দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, আসলেই কি তা ততটা শক্তিশালী? যদি তা-ই হতো, তাহলে শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপের মতো রাষ্ট্র এখনো চীনপন্থি অবস্থান নিত না। চীনের যুদ্ধ জাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরে ঢুকে মালদ্বীপ বা শ্রীলঙ্কায় নোঙর করার কথা ভাবতো না। ফলে উপমহাদেশে এখনো চীনের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।
ভারতীয় কূটনীতি এখনো চীনকে সমানে সমানে টেক্কা দেওয়ার মতো জায়গায় পৌঁছায়নি বলেই মনে করেন ইন্দ্রজিৎ। তবে একই সঙ্গে তার বক্তব্য, গত কয়েক দশকে ভারতীয় কূটনীতি আগের চেয়ে অনেকটা শক্তিশালী হয়েছে। আর বৃহৎ পুঁজির দেশগুলো ভারতের বাজারের উপর নির্ভরশীল বলেই তা সম্ভব হয়েছে।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে
এসএএইচ