ফিচার

প্রাচীন বাংলাসহ ১৩০ দেশের মুদ্রা সংগ্রহে তার

লোকসংস্কৃতিবিদ ও সংগ্রাহক ফখরুল হাসান। কিশোর বয়স থেকেই মুদ্রা সংগ্রহের প্রতি তার ঝোঁক। তার সংগ্রহে আছে বাংলা থেকে বিলুপ্ত হওয়া প্রাচীন মুদ্রাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুদ্রা, ডাক টিকেট, স্মারক ইত্যাদি। এছাড়া বাংলার বিলুপ্তপ্রায় তামা-কাঁসা, কুপিবাতি, হারিকেন, পুরোনো দিনের টেলিফোন ইত্যাদি তিনি তার সংরক্ষণে রেখেছেন।

Advertisement

নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার দক্ষিণ মির্জা নগর ইউনিয়নে ঐতিহাসিক মূল্যের জিনিসগুলো রাখতে, নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন মিনি মিউজিয়াম। নাম দিয়েছেন ‘সংগ্রহশালা’। ফখরুল হাসানের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তিনি জানিয়েছেন তার মুদ্র , প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিস সংরক্ষণ ও সংগ্রহশালার ভবিষ্যৎ নিয়ে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মামুনূর রহমান হৃদয়।

জাগো নিউজ: মুদ্রা সংগ্রহের প্রতি ঝোঁক তৈরি হলো কীভাবে?ফখরুল হাসান: ১৯৮৮ সালের কথা। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। কোরবানির ঈদে আমার মামা হাফেজ মাওলানা কেরামত আলী ৫টি এক টাকার নোট দিলেন। সবগুলো নোটে হরিণের সুন্দর চিত্র আঁকা। আমার নতুন টাকার প্রতি একটা আকর্ষণ কাজ করত। আমি টাকাগুলো সযত্নে আমার বইয়ের ভেতর রেখে দিলাম। সেই টাকাটা আবার যখন পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছি, তখনো নতুন বইয়ের পাতায় সযত্নে রেখে দেই। প্রাথমিকভাবে বলা চলে এভাবেই মুদ্রা সংগ্রহের প্রতি আমার ঝোঁক তৈরি হলো।

আরও পড়ুন: এক কাপ কফির দাম প্রায় ২ লাখ টাকা

Advertisement

জাগো নিউজ: আপনার কাছে বাংলার বিভিন্ন সময়ের মুদ্রা আছে, এগুলো কীভাবে সংগ্রহ করলেন?ফখরুল হাসান: বাংলার চলমান মুদ্রা সংগ্রহের পাশাপাশি এক সময় মন চাইল যেই টাকাগুলো এখন দেখছি না, বাবা-দাদার আমলের; সেই টাকাগুলো আমি দেখব। কোনো কোনো বইয়ের পাতায় দেখেছি সেই সময়ের টাকার ছবি। তখনতো মোবাইলের যুগ ছিল না। ইচ্ছে করলেই যে একটা ছবি তুলে কাউকে দেখিয়ে খুঁজব তার উপায় নেই। তাই ঐ ছবিগুলো কাঁচি দিয়ে কেটে খুঁজতে থাকি বিলুপ্ত মুদ্রাগুলো। তারপর বিভিন্ন সময় নানা কাকতালীয় ঘটনায় সেই টাকাগুলো খুঁজে পাই।

জাগো নিউজ: আপনার সংগ্রহশালায় বিশ্বের কয়টি দেশের মুদ্রা সংরক্ষিত আছে?ফখরুল হাসান: ধারাবাহিকভাবে যদি বলি শুরু থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত ১৩০ দেশের মুদ্রা সংগ্রহ করেছি। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, জাপান, জার্মান, আমেরিকা ইত্যাদি দেশের মুদ্রা আমার কাছে আছে। আমাদের বাংলাদেশে যেমন এক টাকা থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আছে তেমন অন্যান্য দেশের এক টাকা থেকে শেষ পর্যন্ত যেই টাকাটা আছে সেটাও আমি আমার সংগ্রহে রাখার চেষ্টা করেছি। এই সবগুলো টাকাই আমার এ্যালবামে সযত্নে রাখা আছে।

জাগো নিউজ: বাইরের দেশের এই মুদ্রাগুলো কীভাবে সংগ্রহ করেছেন?ফখরুল হাসান: শুরু থেকে অধ্যাবদি পর্যন্ত আমি দেশের বাইরে যাইনি। বিভিন্ন বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, প্রিয়জনের মাধ্যমে বাইরের মুদ্রাগুলো সংগ্রহ করা। তারা শুরুর দিকে যখন জানতে পারে আমি বাইরের মুদ্রা সংগ্রহ করি তখন তারাই ভালোবেসে বাইরের মুদ্রা দিয়ে বলত নাও এটা রাখো। কেউ মালয়েশিয়া থেকে আসছে, কেউ সিঙ্গাপুর থেকে, কেউবা সৌদি, কানাডা ইত্যাদি দেশ থেকে এসে উপহারস্বরূপ মুদ্রাগুলো দিয়েছে। তবে আমার অন্য কোন লোভ-লালসা নেই। আমি সংগ্রাহক, আমি মুদ্রাগুলো স্মৃতির পাতায় ধরে রাখতে চাই। আরেকটা কথা বলতে চাই, নিজের ভেতর একটা আত্মতৃপ্তি পাই কেননা দেশের বাইরে না গেলেও সে স ব দেশের মুদ্রা আমার সংগ্রহশালায় আছে।

জাগো নিউজ: মুদ্রা ছাড়াও পুরোনো দিনের ব্যবহৃত আর কী কী রয়েছে আপনার সংগ্রহে?ফখরুল হাসান: আমার কাছে পুরোনো দিনের ব্যবহৃত অনেক সামগ্রী রয়েছে। যার ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। এর মধ্যে অন্যতম তামা-কাঁসা। এছাড়াও আমার মায়ের আরও কিছু স্মৃতি আছে। এই মুহূর্তে একটি নাম খুব করে মনে পড়ছে ‘চিলুনচি’। বর্তমানে আমরা দেখি হাত ধোয়ার জন্য বাটি রাখা হয় বা বেসিন থেকে ধুয়ে আসতে হয়। তবে এক সময় মনে করা হতো যে বাড়িতে মেহমানদের হাত ধোয়ার জন্য চিলুনচি দেওয়া হবে সেই বাড়ি মেহমানদারিতে ততো পাকাপোক্ত। আর সেই বাড়িকে আপ্যায়নপ্রিয় ও অতিথিপরায়ণ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

Advertisement

জাগো নিউজ: এমন কোন মূল্যবান সামগ্রী কি আছে যেটা পেতে বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন?ফখরুল হাসান: আমি রাজধানীর ফার্মগেটে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার একটি স্মারক পছন্দ হলো। স্মারকটি যুক্তিসঙ্গত দামেই ছিল। স্মারকের দাম ১৫ হাজার টাকা। এর নিচে তিনি দিবেন না তবে আমি নিতে ইচ্ছুক। পকেট থেকে টাকা বের করে দেখি পনের হাজার একশ টাকার মতো আছে। চিন্তা করছি বাসায়ও ফিরতে হবে, তবে স্মারকটি রেখে চলে গেলে অন্য কেউ নিয়েও যেতে পারে! এতে আমার শখটা অপূর্ণ থেকে যাবে। তো এই ধরনের পরিস্থিতে আমি বিকাশ ছাড়াও অন্যান্য মাধ্যমে টাকা এনে সেই কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি ক্রয় করেছি। এমন অনেক গল্প আমার রয়েছে।

আরও পড়ুন: সুন্দরীদের চড়-থাপ্পড় খেতে হয় যে রেস্তোরাঁয়

জাগো নিউজ: মিনি মিউজিয়ামের গড়ার উদ্যোগ কখন নিলেন?ফখরুল হাসান: আগেকার দিনে আমার বাবার একটি ঘর ছিল। সবার কাছে সেই ঘরটি ‘বাংলা ঘর’ নামেই পরিচিত। পরিবেশগত কারণে আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী যারা বেড়াতে আসতেন তাদের বাংলা ঘরেই বসানোর ব্যবস্থা করতেন। সেই থেকে আমার ইচ্ছা জাগলো আমার যে এতো সংগ্রহের জিনিস হচ্ছে এগুলো আমি কোথায় রাখব! কখনো ট্রাঙ্কের ভেতর রাখতাম, কখনো শোকেসে। একসঙ্গে তো কোথাও থাকছে না। তখন থেকেই চিন্তা করলাম বাংলা ঘরটাকেই আমি সংগ্রহশালায় রূপান্তর করব। সেখানেই সংগ্রহের জিনিস সাজিয়ে রাখব। আমাদের আশেপাশে অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা জাদুঘর সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না বা কখনো দেখেনি। তারা যেন আমার এখানে এসে অন্তত জানতে পারে ঐতিহাসিক এই জিনিসটি এখানে আছে, এই জিনিসটার নাম অমুক।

জাগো নিউজ: একজন সংগ্রাহক হিসেবে পরিবারের সমর্থন কেমন পেয়েছেন?ফখরুল হাসান: ১৯৮৮ সাল থেকে মুদ্রা সংগ্রহ শুরু করি। শুরু থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত আমি টাকা, ধাতব মুদ্রা, ডাকটিকিট, বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিস সংগ্রহ করেছি। অনেকেই বলতেন এটা তোমার নতুন করে কিসের শখ জাগলো, আবার অনেকে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দিতেন। খুব সুন্দর, অসাধারণ তোমার চিন্তা-চেতনা। আমাকে উৎসাহ জোগানর পেছনে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে অন্যতম আমার বড় ভাই ড. আবদুল হাই সিদ্দিক। এছাড়াও আমার পরিবার এই বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। আমার কাছে আরও আছে স্বারক, কয়লা চালিত ইস্ত্রি, কুপি বাতি, আগের যুগের টেলিফোন, টর্চ লাইট, বিভিন্ন মিডিয়ার উপহারস্বরূপ মগ, প্রয়াত পপ সম্রাট আজম খানের ব্যবহৃত জিনিস ইত্যাদি। আমার পরিবার তা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে সবসময়ই পাশে ছিল। এছাড়াও আমার সন্তানকে তার মা গর্বের সহিত বলে, এগুলো তোমার বাবার শখের জিনিস সাবধানে রেখো।

জাগো নিউজ: সংগ্রহশালা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?ফখরুল হাসান: আমি যেন আমার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এই সংগ্রহশালায় বসে কাটাতে পারি। আমার শখের সংগ্রহের জিনিসগুলো দেখতে পারি এটাই আমার ইচ্ছা। একটা সময় আমি থাকব না। তবে এই সংগ্রহশালা যেন আজীবন বেঁচে থাকে। যেন দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসে এই দেশের ও দেশের বাইরের হারানো দিনের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে, বুঝতে পারে। তাহলেই এটা হবে আমার পরম পাওয়া।

কেএসকে/জেআইএম