জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালে দেশের অনেক যুবক-কিশোর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা হাজার হাজার কিশোরের মধ্যে ছিলেন নড়াইল সদরের ১৬ বছর বয়সী শওকতুর রহমান। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তিনি চিনু নামেই বেশি পরিচিত।
Advertisement
ক্রিকেট খেলেছেন ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে। খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করে ক্রিকেট কোচিং করিয়েছেন। আম্পায়ারিং করেছেন। ঘরোয়া প্রতিযোগিতা ছাড়াও তিনি একটি টেস্ট ৩টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ফিল্ড আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেছেন। টিভি আম্পায়েরর দায়িত্বে ছিলেন ৮ ম্যাচে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) গ্রেড-‘এ’ ম্যাচ রেফারি।
শওকতুর রহমান চিনু স্কুল ও কলেজ জীবন শেষ করে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। লোক প্রশাসনে অর্নাস ও মাস্টার্স শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ১৯৮১-৮২ সালে ভারতের পাতিয়ালায় ক্রিকেট কোচিং কোর্স করেন।
ক্রিকেট খেলেছেন ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। ঢাকা ক্রিকেট লিগে ওয়ারি, শান্তিনগর, আজাদ বয়েজ, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, গুলশান ইয়ুথ ক্লাব, উত্তরা স্পোর্টিং ক্লাব এবং নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলে ক্রিকেট খেলেছেন। ১৯৭৭ সালে মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) যখন প্রথম ঢাকা সফর করে, তখন বাংলাদেশ সাউথ জোনের হয়ে অংশ নিয়েছিলেন চিনু।
Advertisement
কোচিং করিয়েছেন ওয়ারি, রূপালি ব্যাংক, অগ্রণী বাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ক্রিকেট ক্লাব (জিএমসিসি), ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ও উত্তরা স্পোর্টিং ক্লাবে। ১৯৮৩ সালে শুরু করে আম্পায়ারিং করেছেন ২০০৮ পর্যন্ত। ২০০২ থেকে তিন বছর ছিলেন আইসিসির প্যানেল আম্পায়ার ও টিভি আম্পায়ার।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) ক্রিকেট কোচ হিসেবে চাকরি শুরু করেছিলেন ১৯৮২ সালে। বেশিদিন করেননি। দেড় বছর পর তিনি যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর পদে। সেখান থেকে অবসরে যান পরিচালক হিসেবে। ২০১৩ সাল থেকে ৬ বছরের মতো ছিলেন স্পেশাল অলিম্পিকের পরিচালক।
শওকতুর রহমান চিনুর ১৯৭১ সালে বয়স ছিল ১৬ বছর। ওই বছর তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। স্কুলে পড়া অবস্থাতেই বাবা ও তিন ভাইকে নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে।
৫ ভাইয়ের ছোটজনের বয়স ছিল ওই সময় ৩ বছর। চিনু ছিলেন ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা এম শামসুর রহমান ছিলেন পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা। পরিবার ও বংশের অন্যদের মিলিয়ে তারা ৬২ জন অংশ নিয়েছিলেন স্বাধীনতার আন্দোলনে।
Advertisement
কিভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন? ওই সময়ের ঘটনাগুলো যদি বলতেন। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিয়েছেন দেশের অভিজ্ঞ এই ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব। তিনি বলেন,‘স্কুল জীবনেই আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ে যেতাম। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর যখন ঢাকায় পাক হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে, তার দুই-তিনদিন পর আমরা নড়াইলের ট্রেজারি থেকে অস্ত্র লুটে অংশ নেই। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার সময় যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন। তার সে ডাকেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমাদের এলাকায় কয়েকজন সেনা সদস্য ছিলেন। তাদেরসহ আমরা একটা গ্রুপ তৈরি করি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। তারপর কালিয়া থানার খড়রিয়া নিজেদের গ্রামে যাই। ওখানে গিয়ে স্থানীয়দের নিয়ে সংগঠন তৈরি করি।’
‘এপ্রিল-মে মাসের দিকে আমাদের মনে হলো এই অস্ত্র দিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যাবে না। সিদ্ধান্ত নিলাম ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নেওয়ার। আমি যাবো কিনা তা মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন বাবা। কোনো বাধা দেননি মা। বরং তিনি উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন- আমি অন্য ছেলেদের মতো ওকেও মুক্তিযুদ্ধের জন্য উৎসর্গ করলাম। জুনের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহ হবে, ভারত চলে গেলাম। আমার বাবা ভারত গিয়েছিলেন পরে। আমি ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসার পর বাবাকে পাইনি। তখন তিনি ভারত চলে গেছেন ট্রেনিংয়ের জন্য। আমাকে পোস্টিং দেওয়া হলো ৯ নম্বর সেক্টরে মেজর জলিলের অধীনে।’
তাহলে আপনি ৯ নম্বর সেক্টরেই যুদ্ধ করেছেন? ‘না। আমি সেক্টর বদলে ৮ নম্বরে গিয়েছিলাম। আমি মেজর জলিলকে অনুরোধ করেছিলাম ৮ নম্বরে দিতে। প্রথমে তিনি রাজী হননি। পরে অনুমতি দিয়ে ৮ নম্বরে পোস্টিং দেন আমাকে। সেখান থেকে আমাকে পাঠানো হয় বয়রা সাব সেক্টরে। ওই সাব সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর কে এন হুদা। বয়রা সাব সেক্টর থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে দেশে ঢুকি এক প্লাটুন মুক্তিবাহিনী নিয়ে। আমি ছিলাম ওই প্লাটুনের কমান্ডার’- বলছিলেন শওকতুর রহমান চিনু।
ওই সময় দেশে ঢুকে পরিস্থিতি কেমন দেখেছিলেন? শওকতুর রহমান চিনু বলেন,‘গ্রামে ঢুকে দেখি তখন মুক্তিবাহিনীর আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। তেমন গোলাবারুদ ছিল না। আমরা এসে শাখাওয়াত হোসেন রানা নামের একজনকে কমান্ডার করে দিলাম। তারপর আমরা যুদ্ধ শুরু করি।’
‘পেরুলি ইউনিয়নে নকশালদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়েছিল প্রায় ৩৬ ঘন্টার মতো। ওই যুদ্ধে আমরা জিতি। দেড়শ’র মতো হানাদার আত্মসমর্পন করেছিল। কয়েকজন পালিয়ে গিয়েছিল। এরপর শ্যামনগরে হানাদার বাহিনী ও মিলিশিয়া বাহিনীর সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হলো। আমরা সব সময় রাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম। যখন সন্ধ্যা হলো তথন গ্রেনেড হামলা করলে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায়।’
‘পরপর দুটি যুদ্ধে জয়ের পর আমাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। এরপর নড়াইল আক্রমণ করি ৯ ডিসেম্বর। দক্ষিণ দিক দিয়ে আমরা শহরে আক্রমণ শুরু করেছিলাম। পুলিশ লাইনে ৬ ঘণ্টার মতো যুদ্ধ হয়েছিল। রাতে পাকবাহিনী অবস্থান করা ওয়াপদা ভবন ঘেরাও করলাম। ১০ ডিসেম্বর দুপুরে তারা আত্মসমর্পণ করে। ওদের কাছ থেকে ১৬৮ টি অস্ত্র পেয়েছিলাম। আমরা সব হানাদারকে ধরে নড়াইল জেলখানায় দিয়ে দেই।’
আপনার বাবা এবং অন্য তিন ভাই তখন কোথায় যুদ্ধ করছিলেন? ‘বাবা তখন জি-ফোর কোম্পানির টুআইসি ছিলেন। আমাদের মধ্যে সেজো ভাই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের পরিবারের কেউ শহীদ হননি মুক্তিযোদ্ধায়’- বলছিলেন শওকতুর রহমান চিনু। মুক্তিযুদ্ধেও সময় বাড়ির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল? আপনার মায়ের খবর নিতে পেরেছিলেন? চিনু বলেন,‘বিজয়ের আগে মায়ের সঙ্গে আমাদের কারো দেখা হয়নি। অনেকে মায়ের কাছে আমার নামে মিথ্যা সংবাদ দিয়েছিলেন। আমি মারা গেছি, আমাকে গাছে ঝুলিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। এসব খবরের পর গ্রামে আমার গায়েবি জানাজাও হয়েছিল।’
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন আপনি কোথায় ছিলেন? ‘আমি তখন নড়াইলে ছিলাম। যখন খবর পেলাম পাকবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেছেন, তখন আমরা গুলি ছুড়ে অনেক আনন্দ করেছি। ৮ নম্বর সাব-সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল নাজমুল হুদা যশোর থেকে ছুটে এসেছিলেন আমাদের নড়াইলে’-বিজয়ের দিনের কথা এভাবে বর্ননা করছিলেন শওকতুর রহমান চিনু।
স্বামী ও ৪ সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে মহান কাজ করেছিলেন আপনার মা। মুক্তিযুদ্ধের সময়টা নিশ্চয়ই তার জন্য কঠিন ছিল? নিজের মাকেও মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করে সাবেক এই ইন্টারন্যাশনাল আম্পায়ার বলেন, ‘কেবল স্বামী-ছেলেদের পাঠিয়েই নয়, মা নিজেও মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সহায়তা করেছেন মুক্তিবাহিনীকে। আমার মা ছিলেন পুলিশের মেয়ে। আমাদের পারিবারিক যে রাইফেলটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সেটা সার্বক্ষণিক কাছে রাখতেন। আমাদের বাড়িতেই মুক্তিবাহিনীদের একটি ক্যাম্প ছিল। প্রায় দেড়শ মানুষের প্রতিদিনের খাবার তদারকি করতেন আমার মা।’
পাক হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে আপনার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধ নিয়ে যদি কিছু বলতেন। শওকতুর রহমান চিনু ৮ ডিসেম্বরের একটি ঘটনার বর্ণনা দেন এভাবে, ‘ওই দিন কালিয়া আক্রমণের সময় আমরা খুব ঝুঁকিতে ছিলাম। ওখানে গিয়ে আমরা শেষ রাতে যুদ্ধের জন্য পজিশন নেই। তবে এটা পাক বাহিনী ও রাজাকাররা টের পেয়ে গিয়েছিল। ঘন কুয়াশার মধ্যে একটু দুরের মানুষই ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। প্রথমে রাজাকাররা আমাদের দিকে চলে আসে। এক পর্যায়ে আমাদের ঘেরাও করে ফেলে। আমাদের পেছনে একটা নদী ছিল। কিছু সময় চুপ করে ছিলাম। আমাদের সঙ্গে আর্মির একজন হাবিলদার ছিলেন। তিনি আমাদের চুপ করে যে যার স্থানে থাকতে বলেছিলেন। এরপর আমরা রাজাকার দেখে দেখে গুলি করে ৮-৯ জনকে ফেলে দিয়েছিলাম। এক পর্যায়ে আমাদের এলএমজি কাজ করছিল না। তাই আর যুদ্ধ করা হয়নি। ওই যুদ্ধে আমরা সুবিধা করতে পারিনি।’
আপনার পরিবারে এখন কে কে আছেন? ‘আমার বাবা মারা গেছেন ২০১২ সালে। তার ৬ বছর পর মারা যান মা। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম তারা সবাই ভাতা পাই সরকারের পক্ষ থেকে। মাকেও বলেছিলাম মুক্তিযোদ্ধার ভাতার জন্য আবেদন করতে। তিনি করেননি। বলেছিলেন- তোমাদের বাবার ভাতাই তো আমি তুলি। তাই তিনি আবেদন করেননি।’
‘আমার দুই ছেলে। একজন ব্যাংকার। আরেকজন যুক্তরাজ্যে থাকেন। আমার স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত গার্হাস্থ্য অর্থনীতি কলেজের লাইব্রেরিয়ান। আমার বয়স এখন ৬৯ বছর। লেখাপড়া, খেলাধুলা এবং চাকরি করেছি। তবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়াই আমার জীবনের সবচেয়ে গর্ব ও অহংকারের। আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে মায়ের কাছে। তিনি আমাকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ না করলে হয়তো দেশের গৌরবময় ইতিহাসের অংশ হতে পারতাম না’- বলছিলেন অনেক গুনের অধিকারী সাবেক আম্পায়ার ও বর্তমানে ম্যাচ রেফারি শওকতুর রহমান চিনু।
আরআই/আইএইচএস/