মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন ৪১তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারে (সমাজকল্যাণ) সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোটের হানগড়া গ্রামে। তিনি কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের পাটোয়ার ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং আলিমে জিপিএ-৫ পান। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে সমাজকল্যাণ বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে দাওরায়ে হাদিস এবং ইসলামি আইন শাস্ত্রের ওপর ইফতা সম্পন্ন করেন। তিনি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে সারাদেশে চতুর্থ, ফজিলতে (স্নাতক) বাইশতম এবং দাওরায়ে হাদিসে ষোলোতম হয়ে বোর্ড স্ট্যান্ড করেন।
Advertisement
সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি বিসিএস জয়, ক্যারিয়ার পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার ছেলেবেলা ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানতে চাই—মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন: কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোটের হানগড়া গ্রামে একটি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারে আমার জন্ম। পড়ালেখার হাতেখড়ি আমার মায়ের কাছে। বাংলা, ইংরেজির প্রাথমিক শিক্ষা এবং ধর্মীয় শিক্ষা মায়ের কাছেই। এছাড়া কৈরাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছি। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি পেয়ে উপজেলায় প্রথম হয়েছিলাম। মাধ্যমিকের পড়াশোনা করেছি ঢাকার ডেমরায় বাইতুন নূর মাদ্রাসা থেকে। এটি ছিল জেনারেল ও ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয়ে অত্যাধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে পড়ে শৈশবেই ইংরেজি ও আরবিতে অনর্গল কথা বলতে পারতাম। মূলত আমার জেনারেল শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষায় সফলতা লাভের পেছনে এ প্রতিষ্ঠানের অবদান সবচেয়ে বেশি।
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন: আমার ছোটবেলা থেকেই বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, একদিন প্রধান শিক্ষক ছাত্রদের সমাবেশে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মাঝে কে কে বিসিএস ক্যাডার হতে চাও? সবার মাঝে কেবল আমিই দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, স্যার! আমি হতে চাই। স্যার তখন জানতে চাইলেন, তুমি কি বোঝ বিসিএস ক্যাডার মানে কী? আমি উত্তরে বললাম, জ্বি না স্যার। তখন স্যারসহ হেসে উঠলেন। এভাবে না বুঝেই হয়তো ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নটা দেখেছিলাম। পঁচিশ বছরের শিক্ষাজীবনে সেই স্বপ্ন পূরণের পেছনে হন্য হয়ে ছুটেছি। ২০১৫ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, মূলত তখন থেকেই বিসিএস সম্পর্কে আমি পুরোপুরি অবগত হই। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে আমি প্রচুর টিউশন করতাম। দুপুর দুইটা পর্যন্ত ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যেতাম টিউশন করানোর জন্য। এতে নিজের উপার্জিত টাকায় চলতে পারতাম। পরিবারের সদস্য বেশি থাকায় বাড়ি থেকে টাকা আনতাম না। এছাড়া নিয়মিত অঙ্ক, ইংরেজি পড়ানোয় চাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি আমি ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার এবং ডেইলি অবজারভারে নিয়মিত লেখালেখি করতাম। এতে ফ্রিহ্যান্ড রাইটিং দক্ষতা অনেক বেড়েছে, যা বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় খুব কাজে দিয়েছে।
Advertisement
আরও পড়ুন: ভিন্নধর্মী কাজ দিয়ে মন জয় করেছেন মনি
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন: আমি মূলত অনার্স শেষ করার পর বিসিএস প্রস্তুতি শুরু করি। তবে গণিত, ইংরেজির বেসিক ফাউন্ডেশন আমার আগে থেকেই ভালো ছিল। ২০২০ সাল করোনার সময় গৃহবন্দি থাকাকালে প্রিলিমিনারির জন্য ভালোমতো প্রস্তুতি নিই। নিয়মিত লাইভ এমসিকিউতে পরীক্ষা দিতাম। গাইড বইয়ের পাশাপাশি বোর্ড বই ও ডাইজেস্ট পড়েছি। ২০২১ সালের ১৯ মার্চ প্রিলি হলো। পাস করার ব্যাপারে ইতিবাচক ছিলাম। তবে প্রিলি পাসের পর রিটেন প্রস্তুতির জন্য মাত্র তিন মাস সময় পেলাম। রিটেন প্রস্তুতির জন্য আমি একটি কোচিংয়ে নিয়মিত এক্সাম ব্যাচে পরীক্ষা দিতাম। বেসিক নলেজ ভালো থাকায় রিটেন আমার সব সময়ই স্ট্রং জোন। প্রস্তুতি খুব ভালো ছিল। কিন্তু পরীক্ষার আগে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। অসুস্থতা নিয়েই পরীক্ষা দিই। এরমধ্যে ইংরেজি ও বাংলা খুবই ভালো দিয়েছিলাম। নিয়মিত ইংরেজি পত্রিকা পড়ার অভ্যাস থাকায় ইংরেজি বরাবরই আমার শক্তির জায়গা। বাকি পরীক্ষাও খারাপ হয়নি।
আমার ফ্রিহ্যান্ড রাইটিং, উপস্থাপনা, খাতা সাজানো আগে থেকেই ভালো ছিল। কোনো প্রশ্নের উত্তর ছেড়ে আসিনি। শিক্ষা ক্যাডারের ২০০ মার্কসের পরীক্ষার আগে এক মাস সময় পেয়েছিলাম। এই সময়ে আমি সিরিয়াস পড়াশোনা করেছি। ফলস্বরূপ পরীক্ষাটা হয়েছিল অসাধারণ। আল্লাহ পাকের রহমতে আমার ভাইভাটাও আউটস্ট্যান্ডিং ছিল। আমি বরাবরই ভাইভা ফেস করতে উপভোগ করি। ভাইভা বোর্ডে আমি ইতিবাচক ও আত্মবিশ্বাসী থাকার চেষ্টা করেছি। কোনো জড়তা কাজ করেনি। বোর্ড মেম্বাররা খুব স্যাটিসফাইড ছিলেন। আমার ক্যাডার হওয়ার পেছনে ভাইভার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা শেষ করার পর এটি আমার প্রথম বিসিএস ছিল। আমি শুধু টেকনিক্যাল বা পেশাগত ক্যাডারের প্রার্থী। তাই বলতে পারেন, শুধু শিক্ষা ক্যাডার পাওয়ার জন্যই আমি লড়াই করেছি। আমার বাবা, দাদা, নানা সবাই শিক্ষক ছিলেন। তাই শিক্ষকতার প্রতি আমার একটা আকর্ষণ আছে। রিটেন এবং ভাইভার পর আমি আশাবাদী ছিলাম। মহান আল্লাহ আমাকে হতাশ করেননি। রেজাল্ট শিটে আমার রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটা দেখার পর অনেক আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম।
জাগো নিউজ: পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন: আমার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার বাবা-মায়ের। তাঁদের কষ্ট সহিষ্ণুতা, নিদারূণ ত্যাগ-তিতীক্ষা আমাকে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আমার বাবা একটি আলিয়া মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক হিসেবে অবসরে গেছেন। আল্লাহর রহমতে আমরা সাত ভাই। বাবা এই সামান্য উপার্জন দিয়ে আমাদের সাত ভাইকে উচ্চশিক্ষিত করেছেন। আমরা তিন ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। একজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, একজন মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়েছেন এবং অপরজন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি পড়ছেন। সবার ছোট বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী। আমার মনে আছে, ২০১১-২০১২ সালের দিকে এক বছর বাবার বেতন বন্ধ থাকে। আমরা তিন ভাই তখন ঢাকার ডেমরায় পড়তাম। বাবা তখন মায়ের সব গয়না বিক্রি করে এবং সব জমি বন্ধক রেখে আমাদের পড়ার খরচ জুগিয়েছেন। অথচ আমরা তা বুঝতেও পারিনি। পরে যখন জানতে পারলাম, আমি তখনই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমার চাকরির প্রথম টাকা দিয়ে আমি মায়ের জন্য সেই বিক্রিত গয়নার সমপরিমাণ গয়না কিনবো। সৃষ্টিকর্তা আমার সেই স্বপ্ন পূরণের সুযোগ করে দিয়েছেন। বাবাকে যখন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার হওয়ার কথা বললাম, তিনি আনন্দে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। দু’ফোটা অশ্রু ফেলে মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। আমার চেয়েও বাবা-মায়ের আনন্দটা ছিল অনেক বেশি।
Advertisement
আরও পড়ুন: টানা সাত বছরের চেষ্টায় সফল সোহান
জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএসের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন: নতুন যারা চাকরির জন্য প্রস্তুতি শুরু করছেন, তাদের জন্য বলবো বিসিএস একটা চাকরিমাত্র; জীবনের সব কিছু নয়। আপনি চাইলে উদ্যোক্তা হতে পারেন। নিজের কোনো সুনির্দিষ্ট কারিগরি দক্ষতা থাকলে, তা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন। বিসিএসকেই একমাত্র টার্গেট রাখা উচিত নয়। সবারই অপশন বি থাকা উচিত। তবে বিসিএসই যাদের প্রধান প্রায়োরিটি, তাদের বলবো, আগে থেকেই বেসিক ম্যাথ এবং ইংরেজি আয়ত্তে রাখুন। বিজ্ঞান, আইসিটি, বেসিক জিকেও পড়ে রাখতে পারেন। বর্তমানে যারা গণিত, বিজ্ঞান এবং ইংরেজিতে দক্ষ, তারাই বিসিএস প্রিলি রিটেনে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং ক্যাডার হওয়ার ক্ষেত্রেও তারা কয়েক ধাপ এগিয়ে। বিসিএসে সবচেয়ে কঠিন ধাপ হলো প্রিলিমিনারি। তাই প্রিলিমিনারির জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন: আমি আরও উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে চাই। সেজন্য ভবিষ্যতে আরেকটি মাস্টার্স, এমফিল এবং পিএইচডি করবো ইনশাআল্লাহ। বিসিএস ক্যাডার হওয়াই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়, আমার আরও কিছু লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে, যেগুলো অর্জন করার জন্য প্রচুর ফ্রি সময় প্রয়োজন। এ সময় এবং সুযোগটা আমি কেবল শিক্ষা ক্যাডারেই পাবো। এ কারণেই আমি শুধু শিক্ষা ক্যাডার চয়েজ দিয়েছি। ভবিষ্যতে একজন লেখক ও গবেষক হতে চাই। যতটুকু শিখেছি সেটা ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম একটি মাধ্যম হলো লেখালেখি। তরুণ প্রজন্ম, মোটিভেশন, ক্যারিয়ার নির্বাচন, ধর্মীয় সহমর্মিতা, শান্তির বাণী এবং জাতীয় উন্নয়নের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে লিখতে চাই। লিখতে চাই নিরন্নদের হাহাকার, বঞ্চিতদের অধিকার, তরুণ প্রজন্মের হতাশা এবং সমসাময়িক বিষয় নিয়ে।
এসইউ/এএসএম