১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এদিন যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল, তা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বর্বরতম ঘটনা। এদিন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করা।
Advertisement
বর্বরতম এ হত্যাযজ্ঞ নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক রাসেল মাহমুদ।
জাগো নিউজ: বিজয়ের আগ মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যা কেন?
আরেফিন সিদ্দিক: মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। এটিকে স্মরণ করতে এই দিনকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে নির্ধারণ করেন বঙ্গবন্ধু। আমরা ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করি, তবে বুদ্ধিজীবীদের নিধন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চের কালো রাত থেকেই। এমনকি ২৫ মার্চের আগেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের আগেও আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ওপর আক্রোশ ছিল হানাদার বাহিনীর। ২৫ মার্চের কালো রাতে আমাদের জি সি দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মুনীর চৌধুরীকে হত্যা করা হলো। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়।
Advertisement
‘বুদ্ধিজীবী হত্যার সবশেষ কাজটি করেছে ১৪ ডিসেম্বর। যখন পাকিস্তানী বাহিনী বুঝতে পেরেছে তাদের পক্ষে এদেশে থাকা আর সম্ভব নয়। ২ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত হয়ে গেছে। ঢাকা শহরের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা এগিয়ে আসছেন। তখন পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীরা উপলব্ধি করে, এই দেশে আর থাকা সম্ভব না তাদের। আত্মসমর্পণ করে বিদায় নিতে হবে। তারা কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করেছিল। আমাদের এই দেশে বিভিন্ন পেশায় যারা শীর্ষে অবস্থান করছেন তাদের হত্যা করলে দেশটা পিছিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধ যখন প্রায় শেষপর্যায়ে, তারা দেখলো এখনই তালিকা অনুযায়ী হত্যাগুলো করতে হবে। তারা দায়িত্ব দিলো রাজাকার, আল-বদর, আল-সামস এদেশেরই বিশ্বাসঘাতক চক্রকে। তারাই ১৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষকদের ধরে নিয়ে গেলো। শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সাংবাদিক বিভিন্ন পেশার মানুষকে ধরে নিয়ে গেলো।’
জাগো নিউজ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন তারা বেছে নিয়েছিল?
আরেফিন সিদ্দিক: ২৫ মার্চ কালো রাতেও রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, পিলখানা সদরদপ্তর আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নিয়েছিল হানাদাররা। আমরা যদি দেখি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ও ইপিআর সদরদপ্তর সেখানে কিছু অস্ত্র ছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নিরস্ত্র, শিক্ষকরা নিরস্ত্র তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী তাদের যেই মেধা, দেশপ্রেম এবং মূল্যবোধ বাঙালি জাতিকে দিকনির্দেশনা দেয়। সে কারণেই ২৫ মার্চ থেকেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড শুরু করে এবং ১৪ ডিসেম্বরে আমাদের প্রতিযশা বুদ্ধিজীবীদের তাদের হত্যা করে। আমার মনে হয়, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার একটাই কারণ, স্বাধীন বাংলাদেশ যেন অল্প সময়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। অতএব বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা যেটা বাংলাদেশে ঘটেছে এটি পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। যা জঘন্যভাবে করা হয়েছে। একজন চক্ষু চিকিৎসকের চোখ তুলে ফেলা হয়েছে, একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের হার্ট তুলে ফেলা হয়েছে, একজন বৈজ্ঞানিকের মাথার মগজ তুলে নেওয়া হয়েছে।’
Advertisement
জাগো নিউজ: যতটুকু জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ছিল নৃশংস। এমন নৃশংসতা কেন?
আরেফিন সিদ্দিক: ১৯৭২ সালের ২২ ডিসেম্বর মিরপুর বধ্যভূমির ফলক উন্মোচন করতে গেলেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে তিনি বললেন, বুদ্ধিজীবী হত্যা যেটা বাংলাদেশে ঘটেছে এটি পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। যা জঘন্যভাবে করা হয়েছে। একজন চক্ষু চিকিৎসকের চোখ তুলে ফেলা হয়েছে, একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের হার্ট তুলে ফেলা হয়েছে, একজন বৈজ্ঞানিকের মাথার মগজ তুলে নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের জঘন্য হত্যাকাণ্ড পৃথিবীতে আর কখনো দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, পাকিস্তানের জেল থেকে কারামুক্ত হয়ে আমি যখন বাংলাদেশে আসি, আমি অনেক মানুষকে দেখতে পাচ্ছি না। এরমধ্যে আমার সহপাঠীরা ছিল, যাদের সঙ্গে আমি লেখাপড়া করেছি। আমার সঙ্গে যারা রাজনীতি করতেন তারাও অনেকে ছিলেন না। যাদের লেখা পড়ে উজ্জীবিত হয়েছি, সাড়ে সাত কোটি মানুষ উজ্জীবিত হতো তাদের আমি দেখতে পাচ্ছি না।
জাগো নিউজ: বুদ্ধিজীবীদের দেশপ্রেম নতুন প্রজন্মকে কতটুকু উদ্বুদ্ধ করে?
আরেফিন সিদ্দিক: বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন, এদেশের মানুষকে ভালবাসতেন। দেশপ্রেমের কারণেই তারা হত্যাকাণ্ডের শিকার। আমরা যদি এই দেশপ্রেম সাধারণ মানুষের মধ্যে, নবীন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে না পারি তাহলে চলবে কি করে? শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এটি মূলত নবীন প্রজন্মের কাছে বিষয়টি তুলে ধরা। যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম কোনো গ্যাপ না হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম যা দেখেছে সেগুলো যদি তারা বলে যান, তাহলে নবীন প্রজন্ম সেগুলো ধারণ করে তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে উত্থাপন করতে পারবে। বাঙালি জীবন চেতনাই হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনার প্রদীপ অব্যাহতভাবে জ্বালিয়ে রাখতে হবে।
জাগো নিউজ: বুদ্ধিজীবীদের হত্যা না হলে দেশের রূপরেখা কেমন হতো?
আরেফিন সিদ্দিক: আমাদের বুদ্ধিজীবী যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তারা ছিলেন খুবই আদর্শবান শিক্ষক। একই সঙ্গে এদেশের বুদ্ধিভিত্তিক যে নেতৃত্ব, সেটাতে তারা শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করতেন। ফলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, তারা যদি স্বাধীন বাংলাদেশে কিছুদিন বেঁচে থাকতেন, তাদের যেই অবদান সেটি আমাদের বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথকে মসৃণ করতো। আরও বেশি দ্রুত এগিয়ে যেতে পারতাম। বঙ্গবন্ধু এসে কাদের ওপর আস্থা রাখবেন, যাদের ওপর আস্থা রাখবেন তারাই তো নাই। দেশ স্বাধীনের পর সাড়ে তিন বছর বেঁচে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি যেদিন হত্যার শিকার হন, সেদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এটা আরও এগিয়ে যেত যদি আমাদের এই শহীদ বুদ্ধিজীবীরা যদি বেঁচে থাকতেন। কিন্তু তাদের তো একেবারে পরিকল্পনামাফিক হত্যা করা হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বরের আগে ডিসেম্বর মাসে প্রতিদিন আমাদের বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে হত্যা করা হয়। সিরাজ উদ্দিন, সাংবাদিক সৈয়দ নিজামুল হককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বরের আগে আমরা জানতামই না তাদের নিয়ে এভাবে হত্যা করা হয়। বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা জানা যায়নি। ১৬ ডিসেম্বরের পর অনেকের বিকৃত মরদেহ পাওয়া গেলো মিরপুরে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।
জাগো নিউজ: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, তবে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারের কোনো সুযোগ রয়েছে কি না।
আরেফিন সিদ্দিক: মানবতাবিরোধী অপরাধের যেই বিচার হয়েছে, সেখানে বুদ্ধিজীবীদের কিছু হত্যাকারীকে চিহ্নিত করা গেছে। চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান তাদের বিরুদ্ধে বিচারের রায়ও আছে। তারা দেশের বাইরে আশ্রয় নিয়ে আছেন। তাদের ফিরিয়ে আনা হবে এটিই বাংলাদেশের মানুষের বড় দাবি। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পেছনে তাদের একটি বড় ভূমিকা ছিল। তাদের ধরে এনে বিচারের রায় বাস্তবায়ন করা দেশের মানুষের প্রাণের দাবি।
‘বুদ্ধিজীবী, জাতীয় স্মৃতিসৌধ এ জাতীয় প্রতীকগুলো রক্ষণাবেক্ষণই শুধু নয়, এ স্থানগুলোতে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের ব্যাখ্যা করে বোঝানো স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের সবারই দায়িত্ব।’
জাগো নিউজ: শুধু দিবস এলেই তাদের মনে পড়ে। তরুণ প্রজন্মকে এর তাৎপর্য অনুধাবন ও বিস্তারের জন্য দিবস পালন যথেষ্ট কি না?
আরেফিন সিদ্দিক: তরুণ সমাজের সঙ্গে আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, তার নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য এ বিষয়গুলো নবীন প্রজন্মের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। ১৯৭১ আর ২০২৩ এর মধ্যে একটা সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে এর বিস্তার করতে হবে। যখন যে প্রজন্ম আসবে তাদের সঙ্গে ৭১ কে সংযুক্ত করা, বুদ্ধিজীবীদের যুক্ত করা এটাতো আমাদের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব আমরা কীভাবে পালন করবো। সেই দায়িত্ব পালন করার জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মাঝে এই বিষয়গুলো যুক্ত করা এবং বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে যুক্ত করা। শিক্ষকরাও শ্রেণিকক্ষে এই বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বলবেন। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, জাতীয় স্মৃতিসৌধ এই যে জাতীয় প্রতীকগুলো রয়েছে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণই নয়, এই স্থানগুলোতে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের ব্যাখ্যা করে বোঝানো স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের সবারই দায়িত্ব রয়েছে। আমরা যদি এই দায়িত্ব পালন করি তাহলে আমার মনে হয় এই নবীন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের যেই চেতনা সেটা ধারণ করেই এগিয়ে যাবে।
জাগো নিউজ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আরেফিন সিদ্দিক: আপনাকে এবং জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ।
আরএসএম/জেডএইচ/জেআইএম