করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী শ্রেণি-বর্ণ জাত-পাত ভেদে অনেক মানুষের প্রাণ দিতে হয়েছে, এটা যেমন সত্য ঠিক করোনার কারণে লং কোভিড ইফেক্ট অর্থাৎ করোনা জনিত নানান স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ে পরবর্তীতে মাসের পর মাস অর্থাৎ দীর্ঘদিন ভুগেছেও অসংখ্য মানুষ এটাও চরম সত্য।
Advertisement
কোভিড মহামারির মৃত্যুর সংখ্যাটাকে সরাসরি উল্লেখ না করে বলতে চাই ওয়ার্ডওমিটার এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০ কোটি মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় তার এক শতাংশ, প্রতি ১০ জনের টেস্ট করে একজনের করোনা ধরা পড়েছে, প্রতি এক হাজার করোনা টেস্ট এর বিপরীতে একজনের মৃত্যু হয়েছে, প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ৭০০ কোটিরও বেশি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে|
স্বাস্থ্য সেবা, জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসা সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে যারা কাজ করেন, এইসব কমিউনিটিতে সাম্প্রতিক সময় সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়টি হলো করোনা মহামারির কারণে অতিরিক্ত মৃত্যু| এই অতিরিক্ত মৃত্যু বলতে কি বোঝায়, সেটা আগে পরিষ্কার করি| করোনা মহামারিকালীন সংগঠিত মোট মৃত্যুর সংখ্যা থেকে একই সময়ে করোনা মহামারি অনুপস্থিত থাকলে প্রত্যাশিত মোট মৃত্যুর সংখ্যা যত হতো তা বাদ দিলে যে সংখ্যা পাওয়া যায় সেটাই অতিরিক্ত মৃত্যু| সরাসরি করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু এবং করোনাজনিত পরোক্ষ কোনো কারণঘটিত মৃত্যুর মোট সংখ্যাকেই অতিরিক্ত মৃত্যু বলা হচ্ছে|
১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারি থেকে যেকোনো মহামারি ক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত মৃত্যুর ধারণাটি মহামারির প্রভাব বুঝবার জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে| গবেষক এবং বিশেষজ্ঞ মহলে বর্তমানে এই অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যাকে করোনা মহামারি অভিঘাত বুঝবার অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একটি নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে| জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক অবস্থা, টিকা সংস্থান ইত্যাদির ক্ষেত্রে দেশগুলির ভিন্ন ভিন্ন সামর্থ্য এবং সক্ষমতা বিদ্যমান থাকায় এই অতিরিক্ত মৃত্যুর পরিমাপটি প্রতিটি দেশের মহামারির প্রভাব মাপার জন্য ব্যবহৃত হয়|
Advertisement
বিশ্বব্যাপী, ২০২০ এবং ২০২১ সালে করোনা মহামারির কারণে মোট মৃত্যু ঘটেছে ৫৪ লক্ষ| প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যার চাইতে এই সংখ্যাটি অনেক কম বলে মনে করা হয়| বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী উল্লেখিত দুই বছরে প্রায় এক কোটি ৫০ লক্ষ অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছে| যার ৪৫ লক্ষ ঘটেছে ২০২০ সালে এবং অবশিষ্ট এক কোটি পাঁচ লক্ষ ঘটেছে ২০২১ সালে| এই মোট মৃত্যুর আবার প্রায় ৮৬ শতাংশই ঘটেছে দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের দেশ গুলিতে|
শুধু ভারতেই করোনা মহামারির প্রভাবে ৩২ লক্ষ থেকে ৬৫ লক্ষ অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছে সবচেয়ে বেশি, এরপরে রয়েছে রাশিয়ান ফেডারেশন যেখানে প্রায় ১১ লক্ষ, ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় ১০ লক্ষ, যুক্তরাষ্ট্রে নয় লাখের বেশি| এরপরে রয়েছে ব্রাজিল, মেক্সিকো, পেরু, তুরস্ক, মিশর, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরান, পাকিস্তান ইত্যাদি| বাংলাদেশও প্রথম সারির দিক থেকে ২০ তম পজিশনে রয়েছে| ২০২২ সালে ইংল্যান্ডে প্রায় ৪৪ হাজার অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছে|
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে জনসংখ্যা বেশি থাকায় জনবহুল দেশগুলোতে এই অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যার পরিমাণটাও বেশি হয়|| তবে প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যাকে প্রত্যাশিত মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে ভাগ দিলে, যা পি-স্কোর নামে পরিচিত, কোন দেশে প্রকৃত অতিরিক্ত মৃত্যু বেশি ঘটেছে তা জানা যায়| পি-স্কোর পরিমাপের ভিত্তিতে সবচেয়ে বেশি করোনার অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পেরু, এর পরে রয়েছে যথাক্রমে ইকুয়েডর, বলিভিয়া, মেক্সিকো, আর্মেনিয়া, ওমান, আজারবাইজান, কলম্বিয়াবি, রাশিয়া, ইরান ইত্যাদি দেশ|
কয়েক মাস আগে নেচার কমিউনিকেশন জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যায় ভারতের একটি শহর মাদুরাই যেখানে মার্চ ২০২০ হতে জুলাই ২০২১ সালে সংগঠিত প্রতিটি মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উল্লেখ করে তথ্য নিবন্ধন করা হয়| নিবন্ধিত তথ্য হতে দেখা যায় যে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ওই সময়ের প্রত্যাশিত মৃত্যুর চেয়ে ত্রিশ শতাংশ বেশি ঘটেছে|
Advertisement
কাঠামো গত ভাবে জনসংখ্যার পরিবর্তনের প্রধান নির্ণায়ক মৃত্যু এবং জন্মের সঠিক তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের সঠিক ব্যবস্থা থাকে বলে উন্নত দেশগুলিতে সেই তথ্য ব্যবহার করে করোনা মহামারি কালীন সময়ে অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা হিসাব করাটাও সহজ হয়|
অন্যদিকে নিম্ন ও মধ্যম অথবা উচ্চ-মধ্যমের দেশগুলিতে মৃত্যুর সঠিক নিবন্ধিত ব্যবস্থা কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকলেও সার্বজনীনভাবে অনুপস্থিত থাকায় করোনাকালীন অতিরিক্ত মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা বের করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়| ফলে ইনডাইরেক্ট পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে এই সংখ্যাগুলি বের করা হয়| উভয়- ডাইরেক্ট এবং ইনডাইরেক্ট পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে খুব একটা প্রশ্ন দেখা যায় না|
সাম্প্রতিক সময়ে প্রাক করোনা ভাইরাস মহামারিতর অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা আশাতীতভাবে বেশি হওয়ায় তা বৈজ্ঞানিক সমাজকে ভাবিয়ে তুলছে| করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে প্রত্যাশিত মৃত্যুর সংখ্যার চাইতেও বেশি মৃত্যুর সংখ্যা ঘটার কারণ জানবার জন্য অনেকগুলি গবেষণা চলমান রয়েছে| এখনো বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন ২০-৩০ হাজার শনাক্ত হচ্ছে এবং প্রায় ২০০ মানুষ মারা যাচ্ছে|
২০১৯ সালের ডিসেম্বর হতে শুরু হওয়া এই মহামারির প্রায় যবনিকা পাত ঘটেছে মোটা দাগে বলা যায় ডিসেম্বর ২০২২ সালের মধ্যে, কিছু কিছু দেশে ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে| মহামারির অবসান ঘটলেও, পরবর্তীতে ২০২৩ সালে প্রত্যাশিত মৃত্যুর সংখ্যার চাইতে অতিরিক্ত অনেক মৃত্যুর খবর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে পাওয়া যাচ্ছে, যা গবেষক এবং নীতি নির্ধারকদের মধ্যে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে|
এ বছরের পহেলা ডিসেম্বর ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত কমেন্ট প্রবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে ইংল্যান্ডে ২৮ হাজার অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছে| এই অতিরিক্ত মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও আলোচনা হয়েছে| এবং এই মৃত্যুগুলি বয়সের বিভিন্ন শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী অসম হারে পরিলক্ষিত হয়|
তিন জুন ২০২২ থেকে ৩০ জুন ২০২৩ সংঘটিত অতিরিক্ত মৃত্যু বরণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে কার্ডিওভাসকুলার রোগের ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ, ইসকেমিক হার্ট ডিজিজের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, হার্ট ফেইলোর এর ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ, একুট রেসপিরেটরি রোগের ক্ষেত্রে ১৪ শতাংশ এবং ডায়াবেটিস রোগের ক্ষেত্রে ১৩ শতাংশ বেশি অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছে| মৃত্যুর স্থান হিসেবে নিজস্ব বাসা বাড়ির ক্ষেত্রে ২২ শতাংশ এবং হসপিটালে ১০ শতাংশ প্রত্যাশিত সংখ্যার চেয়ে বেশি ঘটেছে|
ইংল্যান্ডের বেশি বয়সি মৃত্যুবরণকারী মানুষদের ক্ষেত্রে এই হার গুলো বেশি বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে| যেমন বয়স ৫০ থেকে চৌষট্টি সীমার মধ্যে মৃত্যুবরণকারী মানুষদের ক্ষেত্রে কার্ডিওভাসকুলার রোগের ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ, ইসকেমিক হার্ট ডিজিজের ক্ষেত্রে ৪৪ শতাংশ, সেরিব্রো ভাস্কুলার রোগের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ, হার্ট ফেইলোর এর ক্ষেত্রে ৩৯ শতাংশ, একুট রেসপিরেটরি রোগের ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশ এবং ডায়াবেটিস রোগের ক্ষেত্রে ২৯ শতাংশ বেশি অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছে|
অস্ট্রেলিয়ার পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে ১০.৯ এবং ২০২৩ সালে ৯.১ শতাংশ অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছে| নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ডেনমার্ক, জার্মানি, আইসল্যান্ড, জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান দেশেও অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটেছে ২০২৩ সালে| ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এ বছরে ১৮ টি ইইউ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে যারা অতিরিক্ত মৃত্যুর রেকর্ড করেছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে সাইপ্রাস (১৩.৯%), ফিনল্যান্ড (১৩.৪%), নেদারল্যান্ডস (১২.৭%) এবং আয়ারল্যান্ডে (১২.৫%)। বিপরীত চিত্র দেখা গেছে কিছু দেশে যেখানে প্রত্যাশিত মৃত্যুর চেয়ে মৃত্যু কম হয়েছে এমন দেশগুলির মধ্যে এগিয়ে রোমানিয়া (-১২.৬%), লাটভিয়া (-৭.৩%) এবং স্লোভাকিয়া (-৬.৯%)।
ইউরোপে অতিরিক্ত মৃত্যুর হার বৃদ্ধিতে কোনো কোনো ফ্যাক্টর অবদান রাখতে পারে। একটা ফ্যাক্টর হতে পারে তিন বছর ধরে চলমান মহামারিটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে ব্যাহত করেছে, ফলে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত লোকেদের জন্য চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানকে কার্যত কঠিন করে তুলেছে। ফলে হৃদরোগ বা ক্যান্সারের মতো নন-কোভিড সম্পর্কিত রোগের কারণে বেশি মৃত্যু হতে পারে। এছাড়া জলবায়ু মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করতে পারে| ইউরোপের অনেক দেশ যেমন স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য, ২০২২ সালের গ্রীষ্মের ঐতিহাসিক চরম তাপ দাহের (৪০ ডিগ্রিরও ও বেশি) শিকার হয় এবং ফলশ্রুতিতে অনেক মৃত্যু ঘটে|
বিশ্বব্যাপী প্রশ্ন দেখা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্কসহ যে দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিন দেওয়া সত্ত্বেও সেখানে এত বেশি অতিরিক্ত মৃত্যু কেন ঘটছে| অন্যদিকে স্ক্যান্ডেভিনিয়ার দেশগুলিতে অপেক্ষাকৃত অনেক কম টিকা দেওয়া সত্ত্বেও সেখানে স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়েও অনেক কম মৃত্যু হয়েছে| তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয় করোনা ভ্যাকসিনের কিংবা বিভিন্ন ধরনের করোনা ভ্যাকসিনের সাথে এই অতিরিক্ত মৃত্যুর একটা কজাল রিলেশনশিপ কি ভিতরে ভিতরে রয়ে গেছে| সেটি নিয়ে গবেষণা করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য সত্ত্বেও আদৌ কি এর উত্তর মিলবে এটাই এখন বড় প্রশ্ন|
লেখক: অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান এবং ডেটা সায়েন্স, পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hasinur@du.ac.bd
এইচআর/