জাতীয়

২৫ দিনের হরতাল-অবরোধে গণপরিবহন খাতে ক্ষতি ১৭ হাজার কোটি

সরকারের পতন ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন চলছে দীর্ঘদিন। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে যা রূপ নিয়েছে হরতাল-অবরোধে। প্রতিটি হরতাল-অবরোধে ঘটছে যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। এর মধ্যেও সড়কে নিয়মিত চলছে গণপরিবহন। যেটা অনেকটা ব্যর্থ করে দিয়েছে কর্মসূচি। যদিও পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরা আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের দাবি অনুযায়ী, এ ক্ষতির পরিমাণ ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।

Advertisement

পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবি, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধে ঢাকাসহ সারাদেশে ৪৮৭টি বাস-ট্রাকে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। এতে আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে ৪৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এই সময়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় গণপরিবহন ও ট্রাক-কাভার্ডভ্যান কম চলায় পরিবহন খাতে ক্ষতি হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।

আরও পড়ুন>> হরতাল-অবরোধ/দাবি মেনেও গণপরিবহনে মামলা দিচ্ছে তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগ 

আগামী মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) থেকে আবার টানা ৩৬ ঘণ্টার অবরোধ ডেকেছে বিএনপি-জামায়াত। এ কর্মসূচি মঙ্গলবার ভোর ৬টা থেকে বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলবে। বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো এ কর্মসূচি পালন করবে। তবে এ কর্মসূচিতেও ঢাকাসহ সারাদেশে গণপরিবহন চলাচল অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন পরিবহন মালিকরা।

Advertisement

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সূত্র জানায়, গত ২৮ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে ঢাকায় মহাসমাবেশ করে বিএনপি ও জামায়াত। ওইদিন এ সমাবেশ কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত (৭ ডিসেম্বর) সারাদেশে ৪ দিন হরতাল ও ২০ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি-জামায়াত।

 

একটি বাসে চালকসহ তিনজন স্টাফ থাকে। তাদের আলাদা তিনটি পরিবার রয়েছে। গণপরিবহনে আগুন বা ভাঙচুর করলে সবাইকে না খেয়ে থাকতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ধরনের জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।–পরিবহন চালক

 

এই কর্মসূচি চলাকালে ঢাকায় ১০৬টি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২১ কোটি ২০ লাখ টাকা। একই সময়ে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ৫৩টি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন>> দাবি ডিবি প্রধানের/অগ্নিকাণ্ড-ভাঙচুরের দায় স্বীকার করেছেন বিএনপি নেতারা 

Advertisement

এছাড়া ঢাকার বাইরে ৩৩টি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে ক্ষতি হয়েছে ৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। সব মিলে ১৯২ বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৪২ কোটি ৫০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। একই সময় ঢাকাসহ সারাদেশে ২৯৫টি বাস ভাঙচুর করা হয়েছে, যার আর্থিকমূল্য পাঁচ কোটি ৯০ লাখ টাকা। সব মিলে ৪৮৭টি বাসে আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনায় ক্ষতি ৪৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।

কীসের ভিত্তিতে এই পরিমাণ ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছে, তা জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় আগুনে পুড়ে যাওয়া এবং ভাঙচুর করা যানবাহনের ক্ষতির পরিমাণ আলাদাভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার বাইরের বাসগুলো যেহেতু বড়, সেজন্য সেগুলো আগুনে পুড়লে ৩০ লাখ টাকা ক্ষতি ধরা হয়েছে। আর ঢাকা শহরে ছোট বাস চলাচল করায় এগুলো পুড়লে ২০ লাখ টাকা ক্ষতি ধরা হয়। এছাড়া ট্রাক বা কাভার্ডভ্যান ভাঙচুর করলে ক্ষতি ধরা হয় পাঁচ লাখ টাকা। আর বাস ভাঙা হলে দুই লাখ টাকা ক্ষতি ধরে এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক সামদানী খন্দকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘হরতাল-অবরোধ চলাকালে প্রতিদিনই আগুনে পুড়ে যাওয়া বাসের কাগজপত্র নিয়ে সমিতির কার্যালয়ে আসছেন মালিকরা। তখন তাদের কাগজপত্র ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়। কোনো কাগজ কম থাকলে তাদের ক্ষতিপূরণের আবেদন গ্রহণ করা হয় না।’

আরও পড়ুন>> এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ব্যবহার/বাসে আগুন লাগাতে মাদকসেবী-ভবঘুরেদের ফাঁসাচ্ছেন রাজনীতিকরা 

তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে নির্বাচনের সময়ও এভাবে গণহারে গণপরিবহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছিল। তখন নির্বাচনের পর ক্ষতিগ্রস্ত বাস মালিকদের একটি তালিকা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়। এবার নির্বাচনের পরেও এমন একটি তালিকা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে চাওয়া হবে আর্থিক সহযোগিতা।

হরতাল-অবরোধে যানবাহন কম চলায় ক্ষতি

গত ২৮ অক্টোবর থেকে গত ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের একদিনের সমাবেশ, চারদিনের হরতাল ও ২০ দিনের অবরোধে ঢাকাসহ সারাদেশে যান চলাচল কিছুটা কম ছিল। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির হিসাবে এই সময়ে ঢাকায় ২০ শতাংশ গণপরিবহন বন্ধ ছিল। এতে ৪২২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর একই সময়ে ঢাকার বাইরে ৬০ শতাংশ বাসে যাত্রী পরিবহন বন্ধ ছিল। এতে ক্ষতি হয় ১০ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। এছাড়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরে গড়ে ৪০ শতাংশ ট্রাক, কাভার্ডভ্যান চলাচল বন্ধ থাকায় ৬ হাজার ২৫১ কোটি ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সব মিলে ঢাকাসহ সারাদেশে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ১৭ হাজার ১১৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

ঢাকার আব্দুল্লাপুর থেকে মহাখালী হয়ে সায়েদাবাদে যাত্রী পরিবহন করে বলাকা পরিবহন। এই পরিবহনের চালক খোরশেদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘২৮ অক্টোবরের পর যখন হরতাল-অবরোধ শুরু হলো, তখন প্রথম কয়েকদিন যাত্রী পরিবহন বন্ধ রেখেছিলাম। কিন্তু বাস বন্ধ থাকলে তো পেটে ভাত জোটে না। তাই ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছি। পরে ক্রমান্বয়ে সড়কে বাস বেড়েছে। যাত্রী সংখ্যাও বাড়ছে।’

 

এখন হরতাল-অবরোধে যাত্রীরা ঘরে বসে থাকেন না। জীবিকার তাগিদে অফিস-আদালত বা কর্মস্থলে যান। তাদের সেবা দিতেই ঢাকাসহ সারাদেশে সড়কে যাত্রী পরিবহন স্বাভাবিক রেখেছে মালিক সমিতি। কিন্তু এ সেবা দিতে গিয়ে গণপরিবহনকে টার্গেট করেছে বিএনপি-জামায়াত। তারা রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিচ্ছে। তাদের দেওয়া আগুন থেকে যাত্রী, পরিবহন শ্রমিক কেউ রেহাই পাচ্ছে না।- খন্দকার এনায়েত উল্যাহ

তিনি বলেন, ‘একটি বাসে চালকসহ তিনজন স্টাফ থাকে। তাদের আলাদা তিনটি পরিবার রয়েছে। গণপরিবহনে আগুন বা ভাঙচুর করলে সবাইকে না খেয়ে থাকতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ধরনের জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন হরতাল-অবরোধে যাত্রীরা ঘরে বসে থাকে না। জীবিকার তাগিদে অফিস-আদালত বা কর্মস্থলে যান। তাদের সেবা দিতেই ঢাকাসহ সারাদেশে সড়কে যাত্রী পরিবহন স্বাভাবিক রেখেছে মালিক সমিতি। কিন্তু এ সেবা দিতে গিয়ে গণপরিবহনকে টার্গেট করেছে বিএনপি-জামায়াত। তারা রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিচ্ছে। তাদের দেওয়া আগুন থেকে যাত্রী, পরিবহন শ্রমিক কেউ রেহাই পাচ্ছে না।’

এমএমএ/এএসএ/জিকেএস