মতামত

কাজের মেয়ে না গৃহকর্মী?

গৃহকর্মী শব্দটি বই-পুস্তকের ক্ষেত্রে, একটু ভদ্রভাবে বলার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মূলত এতখানি সম্মান গৃহকর্মীদের ভাগ্যে জোটেনা। `কাজের মেয়ে` শব্দটিই যেন ওদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। `কাজের মেয়ে` শব্দটি শুনলে আপনার চোখে কী ভেসে ওঠে? কমদামী ও অপরিচ্ছন্ন পোশাক-আশাক, পুষ্টিহীনতার শিকার কোনো মেয়ের ছবি, তাই না? কিন্তু যারা গৃহকর্মী রাখার মতো সামর্থ্যবান, গৃহকর্মীকে পরিষ্কার পোশাক ও ভালো কিছু খাবার দেয়ার মতো সামর্থ্য কি তারা রাখেন না? এতো গেল শুধু পোশাক ও খাবারের কথা। ভয়ঙ্কর যে ঘটনাগুলো ঘটছে আমাদের চারপাশে, তারমধ্যে গৃহকর্মী নির্যাতন একটি পরিচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। শুধু নির্যাতনই নয়, কখনো কখনো ঘটছে হত্যা কিংবা নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যার ঘটনাও! বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন থেকে শুরু করে সর্বশেষ কণ্ঠশিল্পী কৃষ্ণকলি ইসলাম, দেশের এইসব তারকাদের কাছেও নিরাপদ নয় তাদের গৃহকর্মীরা। কেন? দুবেলা দুমুঠো ভাতের জন্য, একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যই তো তারা কাজ করতে আসে। মা-বাবা, প্রিয়জন ছেড়ে শুধু পেটের দায়েই যে মেয়েটি আপনার বাসায় কাজ করতে এসেছে তাকে একটু ভালোবাসা দেয়া যায় না? তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তাটুকু দেয়া যায় না? নিরাপত্তা তো দূরে থাক, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রক্ষকই যেন ভক্ষক হয়ে উঠছে! রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা বা না থাকা নিয়ে আপনারা ভাষণ, বিবৃতি, আলোচনায় মুখর থাকেন। অথচ নব্বইভাগ মুসলমানের এই দেশে গৃহকর্মীরাই নিরাপদ নয়! যেখানে বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) চারটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন, তারমধ্যে একটি হলো গৃহকর্মীদের অধিকার। সবার আগে যার যার বাসার গৃহকর্মীর অধিকারটুকু নিশ্চিত করুন, নয়তো নিজেকে মুসলমান দাবি করা থেকে বিরত থাকুন। জান্নাত নামের মেয়েটির কী অপরাধ ছিল? কেন সে আত্মহত্যা করলো (অথবা আত্মহত্যায় বাধ্য করা হলো)? একজন প্রখ্যাত তারকা, নানা ক্ষেত্রে সমাজের প্রতি যার দায়বদ্ধতা অনেক বেশি, তার বাসাতেই যদি গৃহকর্মী নিরাপদ না থাকে, তাহলে আর কোথায় থাকবে! আমাদের মানবাধিকার সংস্থাগুলো কেন এখন চুপ করে আছে! তবে কি গৃহকর্মীদের মানবাধিকার থাকতে নেই, না কি তারা মানুষই নয়! সবদিক থেকে বঞ্চিত এই মানুষগুলো কোথাও ন্যায়বিচার পায় না। হোক না তা ধর্ষণ কিংবা খুন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে মানবাধিকার কর্মী, সবাই ব্যস্ত থাকেন খুনি কিংবা অপরাধীদের বাঁচাতে, আড়ালে রাখতে। যেন গৃহকর্মীরা দরিদ্র ও অসহায় বলে, ওদের বাঁচার অধিকার নেই। যেন ওদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে গৃহকর্তা-গৃহকত্রীর মেজাজ-মর্জির ওপর! মন চাইলো, মেরে ফেলো, ব্যস! গৃহকর্মীদের ওপর এমন অন্যায় নির্যাতন ও খুনের ঘটনা, এবং ঘটনার পরে খুনিদের বাঁচাতে ক্ষমতাবানদের এইসব নির্লজ্জ প্রচেষ্টা ধীরে ধীরে একটি জবাবদিহিতাহীন উগ্র সমাজব্যবস্থা তৈরি করছে। যাদের বাসায় গৃহকর্মী আছে, বেশিরভাগ বাসাতেই দেখবেন গৃহকর্মীর জন্য আলাদা কোনো কক্ষ নেই। রান্নাঘরে অথবা ডাইনিংয়ের খাবার টেবিলের নিচে শোয়ার জায়গা হয় গৃহকর্মী মেয়েটির। যেসব বাসায় যুবক পুরুষ সদস্য আছেন, সেখানে গৃহকর্মীরা কতটুকু নিরাপদ? গভীর রাতে অথবা সুযোগ বুঝে গৃহকর্মী মেয়েটির উপর যে তারা হামলে পড়বেন না, পুরুষ থেকে পশুতে রূপান্তরিত হবেন না, তার নিশ্চয়তা কতোটুকু? যারা এই লেখাটি পড়ছেন, একটু খেয়াল করে দেখুন তো, আপনাদের বাসায় গৃহকর্মীর সঙ্গে কেমন আচরণ করা হয়। আপনারা যা খান, যেমন পোশাক পরেন, যেখানটাতে বসেন, যেমন বিছানায় ঘুমাতে যান, সেরকম সুযোগ-সুবিধা আপনার গৃহকর্মীও কি পাচ্ছে? না পেলে কেন পাচ্ছে না? কেন তার ন্যায্য অধিকারটুকু তাকে দিচ্ছেন না? যখন সে আপনার বাসায় সবধরনের কাজে সহায়তা করছে, তখন সে তো আপনার পরিবারেরই একজন সদস্য। একটু খেয়াল করে দেখুন তো, টিভি দেখতে বসলে আপনি সোফায় বসে তাকে পায়ের কাছে বসিয়ে রাখেন কি না? মানুষ কেন মানুষের পায়ের কাছে বসে থাকবে! সমতার বিচারই যদি আপনি না করতে পারেন, তবে মানুষের কাতার থেকে সরে দাঁড়ান। আমার মা একজন উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের রোগী। তবু সে নিজের ওষুধ ঠিকমতো মনে করে খায় না। সেদিকে নজর রাখতে হয় আমার বাবাকেই। নিজের প্রতি যিনি এতটা উদাসীন, কখনো আমাদের বাসায় গেলে তাকেও দেখবেন প্লেটভরা খাবার, ফলমূল সাজিয়ে গৃহকর্মী মেয়েটিকে খেতে ডাকছে। কখনো খাবারে টান পড়লে নিজের ভাগ তুলে গৃহকর্মীর পাতে দেন। বলেন, আমি তো জীবনে প্রচুর খেয়েছি, ওরা কী খায়! একবার ঈদে আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে আমাকে নতুন পোশাক কিনে দেয়া হলো না, আমাদের গৃহকর্মী মেয়েটিকে বেশ দামী একটি পোশাক, সঙ্গে ম্যাচিং অলঙ্কার ও জুতো কিনে দেয়া হলো। আমি কিন্তু তখন একটুও মন খারাপ করিনি। বরং এমন একটি পরিবারে বড় হয়েছি, ভাবলেই গর্ব ও শ্রদ্ধায় চোখে আনন্দ অশ্রু টলমল করে ওঠে। গৃহকর্মীদের জন্য খসড়া নীতিমালা করা হয়েছে। সেখানে তাদের কাজের স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই আইনের বাস্তবায়ন কবে হবে?  আইনের প্রয়োগ না থাকলে অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তবে সবার আগে সচেতন হতে হবে আপনাকেই। নিজ থেকে সচেতন না হলে শুধু আইন করেও অপরাধ দমন করা যাবে না। তাই একটি অপরের প্রতি সহনশীল ও শ্রদ্ধাশীল জাতি গড়তে চাইলে এগিয়ে আসতে হবে আপনাকেই। গৃহকর্মীদের যার যার নাম ধরে ডাকুন। গৃহকর্মীরা যেন `কাজের মেয়ে` নামের আড়ালে হারিয়ে না যায়। তাদেরকে পরিবারের একজন ভেবে সবরকম সুযোগ সুবিধা দিন। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। আর নয়তো নিজের কাজ নিজেই করুন। হাতের কাজে অগৌরবের কিছু নেই।লেখক : কবি, সাংবাদিকএইচআর/এমএস

Advertisement