মতামত

বিবেক কী পথ হারিয়েছে?

খুবই সহজ একটি প্রশ্ন। সবাই বুঝবেন। আবার অধিকাংশই বুঝবেন না। বিবেক কি পদার্থ? উহা খায় না, মাথায় দেয়? এরকম সাইজের মানুষও আছে। এদের অধিকাংশই হয়তো নিরক্ষর ও স্বল্প শিক্ষিত। কিন্তু কিছু নিরক্ষর ও স্বল্প শিক্ষিত লোকের বিবেক খুবই টনটনে অবস্থায় আছে। তারা জানে, বিবেক হচ্ছে এমন এক পদার্থহীন মানবিক ও নৈতিক বিষয়ের সমন্বয়, যা সমাজ ও কল্যাণ ন্যায়বোধে সজ্জিত। দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়, উপলব্ধি করা যায় এবং নিজেকে সেই স্তরে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস চালানো যায়। তখন সেই মানুষ, নিজেকে বিবেকবান ও ন্যায়বান মানুষ হিসেবে দাবি করতে পারেন। বিবেকবান মানুষই সমাজে সংসারে, সরকারে ও প্রশাসনে ন্যায় ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে। অবিবেকবান মানুষ কেবল দমন করতে চায় প্রতিবাদী মানুষকে, সমাজ-সংসারকে।

Advertisement

দুই.এ বিবেকের অভাব দেশের সর্বক্ষেত্রে আজ বিদ্যমান। যে সাংস্কৃতিক চেতনা আমাদের ন্যায় ও কল্যাণের যুক্তিগুলো নির্মাণ করে, সেই সাংস্কৃতিক চেতনাও আজ দ্বিধান্বিত ও দ্বিধাবিভক্ত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজে চলমান আন্দোলন ও সরকারের রিজিডিটি আমাদের এই শিক্ষাই দিচ্ছে যে, রিজিডিটি সমাজ সংসারের জন্য খুব ক্ষতিকর বোধ ও চেতনা। আমাদের সরকারের মধ্যে যে একচক্ষু দানবের মতো সিদ্ধান্ত অনড় হয়ে আছে, তাকে এবং বিরোধী পক্ষের মধ্যেও ঠিক একই ভাবে অকাট্য ও অনড় সিদ্ধান্ত, গোটা পরিস্থিতিকে নো-রিটার্নে গিয়ে স্থির হয়েছে। এটা গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য ক্ষতিকর। প্রশ্ন উঠতে পারে, দেশে আদপেই কী গণতন্ত্র আছে যে এই অনড় সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রকে দুর্বল ক্ষতিকর করে তুলবে? উত্তরটা প্রিয় পাঠকই নিজেকে করে নিজেই উত্তর তৈরি করুন।

তিন.বিবেকের বিষয়টি কঠোরভাবে প্রয়োগের কথা আমরা যখন ভাবি, তখন দেশের আপামর কৃষক ও শ্রমিকের মুখ ভেসে ওঠে চোখে। কৃষক ও শ্রমিকরা মূল প্রোডিউসার। জিডিপিতে কৃষকের অবদানের ধারে কাছেও নেই অন্য প্রডিউসারদের। মূলত কৃষকের পর শ্রমিকের উৎপাদনই প্রধান উৎস জিডিপির। সার্ভিস খাতের অবদান যৎসামান্যই বলতে হবে। কারণ তারা দেশের দেশজ উৎপাদনের সেক্টরে তেমনভাবে অবদান রাখতে পারেন না। তারা মূলত স্বর্ণলতার মতো পরজীবী সেক্টর, যারা কৃষক ও শ্রমিকের উৎপাদনের সহায়ক বা সহকারী হিসেবে কাজ করে।

আমরা কোনো পরিসংখ্যানে না গিয়েও এই সত্যে পৌঁছাতে পারি যে কৃষকের অবদান সবচেয়ে ভালো হওয়ার পরও, তারা অবহেলিত। তারা কেবল খাদাশস্যই উৎপাদন করে না, পুষ্টির প্রয়োজনীয় সব উপকরণই তারা উৎপাদন করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে। অথচ তাদের পরিকল্পিতভাবে উন্নয়নের দোরগোড়ায়ও আনা হয়নি। শুধু ধান উৎপাদন করলেই তাদের উন্নয়ন স্তরের মানুষ হিসেবে গণ্য করা যায় না। তাদের সাংবিধানিক অধিকারগুলোর বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত আমরা তাদের অবদানের স্বীকৃতি দিতে পারি না। উৎপাদনের সঙ্গে ওই সব অধিকারগুলো জড়িত।

Advertisement

একজন কৃষক যদি তার জন্য শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারে, যদি স্বাস্থ্যসেবা না পায়, যদি গৃহ না পায়, কাপড় না পায়, তাহলে কী তাকে উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে বর্ণনা করতে পারবো আমরা? তাদের জন্য চিকিৎসাসেবা অতীব সীমিত, গ্রামীণ স্তরে বলতে গেলে ওই সেবা নেই। শিক্ষার যে ধারা চলছে, তাকে একটি স্ট্যান্ডার্ড আছে বলে মানতে পারি না। এর সঙ্গে মতপ্রকাশের সার্বিক স্বাধীনতার বিষয়টি চিন্তায় আনলে দেখবো, তারাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত।

রাজনৈতিক সরকারের মেন ও প্রশাসনে বিবেক বলে কোনো কিছু নেই। অন্যায়, অপরাধমূলক আচরণ ও দুর্নীতি একটি প্রবহমান নদীর মতো বর্ষার ধারায় বহমান। বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে গত ১৪ বছরে ৯৯ লাখ কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে, যা মূলত দুর্নীতির উৎস। বিবেকহীন প্রশাসনের রাজনীতিকরণের ফলেও তা দগদগে ঘা হয়ে উঠেছে। এজন্যই মনের মধ্যে কোনো রকম বিকার সৃষ্টি হয় না ক্ষমতাসীন সরকারের লোকেদের মনে।

দুর্নীতি যেন রাজনৈতিক সরকারের অধিকারে পরিণত হয়েছে, এমন বিকারহীনভাবে তা তারা নিত্যই করছে। যে সরকারের সময় ক্যাসিনোর মতো ঘা তৈরি সৃষ্টি হতে পারে, কোভিডের নামে জাল সার্টিফিকেট বিক্রি করতে পারে, সেই সরকারের যে রাজনৈতিক অধিকারও বিক্রি হয়ে গেছে, তা বোঝা যায়। বিবেক তাই নির্বাসনে গেছে। তাকে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন প্রকৃত গণতন্ত্র, যেখানে প্রতিটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

চার.গার্মেন্টস শ্রমিকেরা তাদের বেতন বাড়ানোর আন্দোলন করছিলেন। তখন বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিও আন্দোলনে ছিলো। অনেকেই ভেবে বসেছিলেন বিএনপি এদের পুশ করেছে আন্দোলনে নামতে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে ৫ বছর আগে যে পরিমাণ বেতন বাড়ানো হয়েছিলো, এখন সেই বেতনে তারা চলতে পারে না। তারা সর্বনিম্ন বেতন চাইছে ২৩ হাজার টাকা। আর গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিকেরা তাদের জন্য সর্বনিম্ন বেতন বাড়িয়েছে ১২ হাজার টাকা। কিন্তু শ্রমিকেরা তা প্রত্যাখ্যান করেছে।

Advertisement

এখন প্রায় অচলাবস্থা চলছে। এই পরিস্থিতি গার্মেন্টস সেক্টরের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির ও ক্ষতির। এ-জন্য দেশীয় শ্রমিক সংগঠনের নেতারা তাদের দাবি অনুযায়ী বেতন কাঠামো নির্ধারণের লক্ষ্যে মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে ছিঠি দিয়েছে। সেই সংক্রান্ত ছিঠিরও ওপর লিখিত রিপোর্ট পড়ে নেয়া যাক।

সম্প্রতি ইন্ডাস্ট্রিাল গ্লোবাল কাউন্সিলের পক্ষ থেকে মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবরে চিঠি দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাপী ৫ কোটি শ্রমিকের প্রতিনিধিত্ব করে এই সংগঠন। চিঠিতে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এটলি হোয়ে বলেন, ‘শ্রমিকরা ২৩ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি দাবি করছে। দুঃখজনকভাবে যদি তাদের এ দাবি মানা না হয় তার অর্থ দাঁড়াবে কেবল মালিক পক্ষের প্রস্তাবই বিবেচনায় নিয়েছে মজুরি বোর্ড।’

এ নিয়ে ঘোষিত মজুরি পুনঃমূল্যায়নের জন্য বিভিন্ন পক্ষ থেকে ১৯৪টি চিঠি এসেছে ন্যূনতম মজুরি বোর্ডে। এসব চিঠির মধ্যে ১৬৮টি এসেছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। এসব সংগঠন ২৩ থেকে ২৫ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির সুপারিশ করেছে। অন্যদিকে ২৩টি কারখানার মালিকদের পক্ষ থেকে দেওয়া চিঠিতে ন্যূনতম মজুরি কমিয়ে ১০ হাজার টাকা নির্ধারণের সুপারশি করা হয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান মালিক পক্ষের দেওয়া প্রথম প্রস্তাব ১০ হাজার ৪০০ টাকায় ফিরে যাওয়ার সুপারিশ করেছে।

এর বাইরে নিরপেক্ষ সংস্থা হিসেবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ–টিআইবি এবং বাংলাদেশ লিগাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট–ব্লাস্ট চিঠি দেয়। জানতে চাইলে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ গণমাধ্যমকে বলেন, আজ রোববারও মজুরি বোর্ডের বৈঠক শুরুর আগ পর্যন্ত সুপারিশ জমা নেওয়া এবং বিবেচনার জন্য বোর্ডে উপস্থাপন করা হবে। (সমকাল,২৬ নভেম্বর, ২৩)

এই রিপোর্ট পড়ে বুঝলাম, গার্মেন্ট কারখানার মালিকেরা কতোটা অমানবিক ও বিবেকসর্বস্ব মানুষ। ২৩টি কারখানার মালিক কর্তৃপক্ষ মাসিক মজুরি ১০ হাজার ও ১০ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণের জন্য মজুরি বোর্ডকে চিঠি দিয়েছে। মাত্র তেইশটি গার্মেন্ট কারখানার মালিক যে চিঠি দিয়েছে তা সব কারখানার মালিকের মনোভাবকেই রিফ্লেক্ট করছে।

এটাই সত্য। এই সত্যের নাম স্বার্থ। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার নামে উৎপাদক শ্রমিকের বেতন যতো কম দেয়া যায়, সেই চেষ্টাই করে তারা। এটাই তাদের স্বাভাবিক চেতনা। আর শ্রমিকদের তরফে তারা যে মাসিক বেতন সর্বনিম্ন দাবি করেছে, তা বিবেচনায় নিলেই বোঝা যাবে মজুরি বোর্ডের কর্তাদের মধ্যে বিবেক আছে কি নেই।

চার সদস্যের এটি গার্মেন্ট শ্রমিকের পরিবারের প্রতিমাসের ২৩ হাজার বা ২৫ হাজার টাকা ন্যায় সঙ্গত কি না, তা বুঝতে হবে গার্মেন্ট মালিকদের। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, গার্মেন্ট মালিকেরা শুরুর দিক থেকেই শ্রমিক শোষণের ব্যাপারটি জানে এবং সেই ধারায়ই বেতনভাতাদি স্থির করে নিয়েছে। আজকে যখন তারা সর্বনিম্ন মাসিক বেতন ১২ হাজার স্থির করে তখন কতো পার্সেন্ট বাড়ানো হলো সেটা ফলাও করে জানায়। কিন্তু এটা বলে না যে তিরিশ টাকার চাউল ৬০/৭০ টাকা হয়েছে। শাক-সবজির দাম আকাশ ছোঁয়া।

পরিস্থিতি এতাটাই ভয়াবহ যে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে অনেক শ্রমজীবী মানুষ। শ্রমজীবী মানুষের এই গ্রামে ফিরে যাওয়া অব্যাহত থাকলে গার্মেন্ট সেক্টরে শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দিতে বাধ্য। উচিত ন্যায় সঙ্গত বেতন কাঠামো প্রস্তুত করা। প্রতি ছয়মাস অন্তর বেতনের ৫ টু ১০ শতাংশ বাড়াবার রীতি থাকা জরুরি।

যদি ৫ বছর অন্তর অন্তর বেতন কাঠামো সংস্কার করার নিয়ম করা হয় তাহলে, মালিকদের কাছে যাতে তা আর্থিক চাপ না হয়ে সহজ হয়, তাই এই রীতি করা যেতে পারে। দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে যাতে শ্রমিকেরা আর্থিক সংকটে না পড়ে সেই বিবেচনায় ওই সামান্য মাসিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গার্মেন্ট মালিকদের লাভের যে লোভ এবং তার বাস্তায়নের কল্পনারও রাশ টেনে ধরতে হবে।

অন্যদিকে মজুরি বোর্ডের কর্মকর্তাদের বিবেক ব্যবহার করে শ্রমিকের স্বার্থ হাসিল করতে হবে। মনে রাখতে হবে, তারা উৎপাদন করে বলেই তারা আজ ধনবান ও খ্যাতি অর্জন করেছেন। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান শক্তিই শ্রমিক। তাদেরকে সালাম জানানো মালিকদের উচিত।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস