বিবিধ

মানবতার সেবক সায়মা ওয়াজেদ

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল একজন খ্যাতিমান বাংলাদেশী মনোবিজ্ঞানী। নিজ কর্মগুণে বিশ্বদরবারে করে নিয়েছেন নিজের অবস্থান। একই সাথে দেশকে করেছেন সম্মানিত। আজ স্বমহিমায় উদ্ভাসিত তারুণ্যদীপ্ত বঙ্গকন্যার ৫২তম জন্মদিন। মানবতা, মেধা আর পরিশীলিত বুদ্ধিদীপ্ততার সঙ্গে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য কাজ করে যাওয়া এক অনন্য নাম সায়মা ওয়াজেদ। পারিবারিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের বাইরে নিজেকে মেলে ধরেছেন সম্পূর্ণ নিজস্ব আলোয়। বাবা পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ও মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তনয়া এবং জাতির পিতার দৌহিত্রী হয়েও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রায়।

Advertisement

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ১৯৭২ সালের আজকের দিনে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন । পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর মা-বাবা ও একমাত্র ভাইয়ের সঙ্গে অনিরাপদ ও দুর্বিষহ নির্বাসিত জীবনও কাটিয়েছেন। প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে উঠলেও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ। শিক্ষাজীবনে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে স্নাতক এবং ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ২০০৪ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্কুল সাইকোলজির ওপর বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি লাভ করেন। ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া নারীদের উন্নয়নের ওপর গবেষণা করেন। তাঁর গবেষণাকর্ম ফ্লোরিডার অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সায়েন্টিফিক উপস্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ২০০৮ সাল থেকে শিশুদের অটিজম ও স্নায়ুবিক জটিলতাসংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজ শুরু করেন। প্রথমে নিজের দেশ বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের উদ্যোগেই ২০১১ সালের ২৫ জুলাই ঢাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো অটিজমের মতো বিষয় নিয়ে-‘Autism Spectrum disorders and developmental disabilities in Bangladesh and South Asian’ এর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১১ দেশের অংশগ্রহণে ঢাকা ঘোষণা’ গৃহীত হয়।

এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে- ‘South Asian Autism Network’ (SAAN) গঠিত হয়। যার সদর দফতর করা হয় বাংলাদেশে। এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আগে বাংলাদেশের মানুষ ‘অটিজম’ শব্দটির সঙ্গে তেমন একটা পরিচিত ছিলো না। যদিও কিছু উচ্চ শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের অটিজম নিয়ে কিঞ্চিৎ ধারণা ছিল, তবে তাদের সচেতনতার ও জানার পরিধি বৃদ্ধি হয় ঢাকার এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে।

Advertisement

অটিস্টিক বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের নিয়ে একটা ভ্রান্ত ধারণা ছিলো বাংলাদেশের জনগণের। একসময় অটিস্টিক শিশুদের দেখলে নানা ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতো, এখন সমাজে সেটা প্রশমিত হয়েছে। অটিজমকে এখন মানুষ রোগ হিসেবেই চিহ্নিত করে। তবে সঠিক চিকিৎসায় জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়। অটিজম কখনো সম্পূর্ণ নিরাময় হয় না। তবে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।

এছাড়া স্বল্পমাত্রার অটিজমের ক্ষেত্রে যথাযথ সহযোগিতা, সমর্থন ও শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের পরিণত বয়সে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অটিজম বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক কিছু আচরণ দেখে শিশু অটিজম আক্রান্ত কিনা তা নির্ধারণ করতে পারেন। যেমন- শিশুর চোখে চোখ রাখা, নাম ধরে ডাকলে কোনো সাড়া-শব্দ না পাওয়া, দুলতে থাকা, বারবার একই কথা বলা এমন কিছু বিষয় প্রতীয়মান। বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে যে ভুল ধারণা ছিলো তা সচেতন করতে নিরলস কাজ করে যাওয়া মানুষটি হলেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের ১০০ জনের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন তিনি। পারিবারিক ও সামাজিক গ্ল্যামারের বাইরে বেরিয়ে নিজের আলোয় আলোকিত নাম সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। মেধা, মনন, প্রজ্ঞা দিয়ে বিশ্ব মঞ্চে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তাঁর সাফল্যে পুরো জাতি গৌরবান্বিত। মানবতার সেবক হিসেবে অটিজম নিয়ে কাজ করতে পারেন বঙ্গকন্যার জন্মদিনে সেই কামনা করি।

তিনি ২০১২ সাল থেকে জাতিসংঘের অটিজম সচেতনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে আসছেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশ সরকার ‘নিউরোডেভলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি ট্রাস্ট অ্যাক্ট ২০১৩’ পাস করে। এরপর তিনি ২০১৩ সালের জুনে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১৪ সালে সায়মা ওয়াজেদকে অটিজম ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘এক্সেলেন্স ইন পাবলিক হেলথ অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। এছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ডিজিটাল ক্ষমতায়নের জন্য ২০১৬ সালে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।

Advertisement

২০১৬ সালের ২১ আগস্ট তাঁর উদ্যোগে বাংলাদেশ থেকে অটিজম দূর করতে ৪৫টি লক্ষ্য নির্ধারণ করে ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক ফর নিউরো ডেভলপমেন্ট ডিজঅর্ডার ২০১৬-২০২১’ পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপনা করা হয়েছিল। যে পরিকল্পনায় অটিজম নিয়ে সচেতনতা, পরামর্শ, পরিবারে অটিস্টিক শিশুর স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা, কমিউনিটিসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এবং পরিকল্পনামাফিক কাজ করা হয়েছে। অটিজম নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করার জন্য সায়মা ওয়াজেদ পুতুল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে অটিজম বিষয়ক ‘শুভেচ্ছা দূত’ হিসেবে কাজ করছেন।

প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যা প্রতিবন্ধী শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ক্লাইমেট ভলনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) ‘থিম্যাটিক দূত’ হন। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য গঠিত ফোরামের কাজে তাঁর সম্পৃক্ততা করোনা মহামারিতে প্রশংসিত হয়েছে। স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যেও সারাবিশ্বে তিনি অটিস্টিক শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। এবছরের নভেম্বরে সায়মা ওয়াজেদ পাঁচ বছরের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন।

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের ১০০ জনের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন তিনি। পারিবারিক ও সামাজিক গ্ল্যামারের বাইরে বেরিয়ে নিজের আলোয় আলোকিত নাম সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। মেধা, মনন, প্রজ্ঞা দিয়ে বিশ্ব মঞ্চে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তাঁর সাফল্যে পুরো জাতি গৌরবান্বিত। মানবতার সেবক হিসেবে অটিজম নিয়ে কাজ করতে পারেন বঙ্গকন্যার জন্মদিনে সেই কামনা করি।

লেখক : প্রতিবেদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

এইচআর/জেআইএম