মতামত

পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো এখন অলীক নয় বাস্তব

বাংলাদেশ এখন পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনে বিশ্বে এক নম্বর। বিশ্বাস হচ্ছে না? চলুন তাহলে দেখি যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) কী বলছে। ইউএসজিবিসির মতে, বিশ্বের এক নম্বর পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে স্থান করে নেওয়া গ্রিন টেক্সটাইল লিমিটেডের অবস্থান ময়মনসিংহের ভালুকায়। শুধু তাই নয়, দেশের ১৮৩টি পোশাক কারখানা ও বস্ত্র কারখানা ইতোমধ্যে পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে কাজ করছে।

Advertisement

চলতি বছর আরও ১৭টি প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব কারখানায় যুক্ত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে শিপইয়ার্ড, জুতা ও ইলেকট্রনিক পণ্যের কারখানা। পরিবেশবান্ধব কারখানার সনদ দেয় ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল বা ইউএসজিবিসি। তারা ‘লিড’ বা লিডারশিপ ইন গ্রিন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট নামে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার যে সনদ দিয়ে থাকে, তা দেশের ২০০টি কারখানা পেয়েছে। ফলে পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণের রেকর্ডে বাংলাদেশ এখন অবশ্যই এগিয়ে।

বিজেএমই’র সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, বিশ্বের শীর্ষ ১৫টি লিড সনদ পাওয়া গ্রিন কারখানার প্রথম সারির ১৩টি এখন বাংলাদেশের। বিজেএমই’র তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে লিড সনদ পাওয়া ২০০ পোশাক ও বস্ত্র কারখানার মধ্যে ৭৩টি লিড প্লাটিনাম, ১১৩টি গোল্ড, ১০টি সিলভার ও চারটি সার্টিফায়েড সনদ পেয়েছে। তাদের তথ্যানুযায়ী লিড সনদে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বাংলাদেশের ময়মনসিংহের গ্রিন টেক্সটাইল লিমিটেড এখন বিশ্বের এক নম্বর পরিবেশবান্ধব কারখানা। লিডের ১১০ নম্বরের মধ্যে তারা পেয়েছে ১০৪ নম্বর। ২০১২ সালে উদ্যোক্তা সাজ্জাদুর রহমান মৃধা পাবনার ইপিজেডে প্রথম স্থাপন করেন পরিবেশবান্ধব কারখানা ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও। সেই শুরু। সেই থেকে এ পর্যন্ত ২০০টি কারখানা পেল ইউএসজিবিসির লিড সনদ।

লিড সনদ মূলত দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানের পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণের ওপর নম্বরের ভিত্তিতে। চার ক্যাটাগরিতে লিড সনদ দেওয়ার কাঠামো নিম্নে তুলে ধরা হলো:

Advertisement

প্রাপ্ত নম্বর প্রাপ্ত সনদের নাম

৮০ বা তদূর্ধ্ব     প্লাটিনাম

৬০ থেকে ৭৯   গোল্ড

৫০ থেকে ৫৯   সিলভার

Advertisement

৪০ থেকে ৪৯   সার্টিফায়েড

লিড সনদ হলো পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) দিয়ে থাকে। লিড বা লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন সনদটি পেতে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত সব বিষয়ে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়। এজন্য নতুন ভবন নির্মাণ কিংবা পুরোনো ভবন সংস্কার করেও আবেদন করা যায়।

মোটা দাগে পরিবেশবান্ধব স্থাপনা বলতে আমরা বুঝি, যেসব শক্তি বা স্থাপনা পরিবেশের ক্ষতি করে না বরং তা সংরক্ষণে সহায়তা করে, সেসব শক্তি বা অবকাঠামো। ইউএসজিবিসি কর্তৃক প্রদত্ত সনদ লিড পরিবেশবান্ধব স্থাপনার একটি বাস্তবমুখী সনদ। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করা বিশ্বের ১৯১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনা এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে প্রতিটি শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে নির্মাণাধীন অন্য সব স্থাপনা পরিবেশবান্ধব করে নির্মাণের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব ১০টি তৈরি পোশাক কারখানার মধ্যে সাতটিই বাংলাদেশে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার প্রতিটি প্রকল্পে পরিবেশ বিবেচনায় পদক্ষেপ নিচ্ছে।

শুধু পরিবেশবান্ধব কারখানাই নয়, সরকার এখন যে কোনো স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশ মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সব উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবেশবান্ধব (গ্রিন) স্থাপনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। মেট্রোরেল, এক্সপ্রেস ওয়ে থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে পরিবেশের বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছে। মেট্রোরেল একদিকে যেমন যানজট কমাতে সাহায্য করেছে, অন্যদিকে পরিবেশদূষণও রোধ করছে।

পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য যে কোনো এলাকার অন্তত ২৫ ভাগে গাছপালা থাকা আবশ্যক। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ঢাকা শহরে সবুজ যেন অলীক বস্তু। শহরের যেখানে এখনো কিছু গাছ রয়েছে, তা টিকিয়ে রাখা দুরূহ হয়ে পড়ছে। এমন অপরিকল্পিত নগরায়ণের নামে গাছ কাটার ফলে অসহনীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ঢাকাসহ সারাদেশে। স্থাপনাগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে যদি পরিকল্পিতভাবে বাড়ির ছাদে, রাস্তার দুপাশে, জলাধারের পাশে গাছ লাগানো যায়, তবে এ সমস্যা কিছুটা নিরসন করা সম্ভব।

 

বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব ১০টি তৈরি পোশাক কারখানার ৭টিই বাংলাদেশে হওয়ায় তা আমাদের সুস্থ নগরায়ণে আশাবাদী করে তুলেছে। ভবিষ্যতে এ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা কৃষির পাশাপাশি শিল্পায়নে আরও এগিয়ে যাব। গড়ে তুলব পরিকল্পিত ও আধুনিক নগরায়ণ।

 

রাজধানীর পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ২০২২-৩৫ প্রণয়ন করেছে সরকার। এছাড়া ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮-কে সংশোধন ও পরিমার্জন করে সময়োপযোগী করার প্রক্রিয়া চলমান।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, নগরে পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণের ওপর বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস জোর তাগিদ দিচ্ছেন। কারণ, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ না করলে নগর বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে উঠবে।

এসব কারণে রাস্তা, সেতু ও কালভার্ট, পার্ক, উন্মুক্ত খেলার মাঠসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে পরিবেশের ভারসাম্যের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে মান্ডা, শ্যামপুর, কালুনগর ও জিরানী খাল খনন প্রকল্প চালু রয়েছে। এতে নগরের পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক হবে এবং দূষণ রোধ করা সম্ভব হবে।

তার মতে, নগর পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে একটি নগর এলাকায় পরিকল্পিতভাবে সব সুবিধা দেওয়া সম্ভব। এ পদ্ধতিতে কিছু মালিকের জমি একসঙ্গে করে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সব সাধারণ সুবিধা দিয়ে তাদের জমির মালিকানা আবার ফেরতও দেওয়া হয়। সরকারের নগর পরিকল্পনায় এটি বিবেচনায় রয়েছে।

পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে বাড়ি, শিল্পকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট, বিদ্যুৎকেন্দ্র, উড়াল সড়ক, মেট্রোরেল, পাতাল রেল, নদী-সমুদ্রের তলদেশ কিংবা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে টানেল নির্মাণসহ অন্য সব স্থাপনা নির্মাণ করা অতীব জরুরি।

এসব স্থাপনা পরিবেশবান্ধব করে তুলতে পারলে একদিকে জীবনমান বেড়ে যাবে, অন্যদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। তবে বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব ১০টি তৈরি পোশাক কারখানার ৭টিই বাংলাদেশে হওয়ায় তা আমাদের সুস্থ নগরায়ণে আশাবাদী করে তুলেছে। ভবিষ্যতে এ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা কৃষির পাশাপাশি শিল্পায়নে আরও এগিয়ে যাব। গড়ে তুলব পরিকল্পিত ও আধুনিক নগরায়ণ।

লেখক: প্রতিবেদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

এইচআর/ফারুক