প্রোডাক্টটিভিটি বা উৎপাদনশীলতা একজন মানুষের কর্মময় জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আপনি কোনো ইন্ডাস্ট্রিতে গেলে মালিকদের কাছে অভিযোগ শুনবেন যে, তাদের কর্মীরা ততটা প্রডাক্টিভ নয়। কোনো কর্পোরেট অফিসে গেলে সেখানেও একই অভিযোগ যে তাদের কর্মীরা তেমন প্রডাক্টিভ নয়।
Advertisement
আবার যদি আমরা নিজেদের দিকে খেয়াল করি তাও দেখবো, আসলেই যে পরিমাণ কাজ আমরা করতে চাই সারাদিন, সেই কাজ আমরা করতে পারছি না। তার মানে আমাদের প্রোডাক্টিভিটি আশানুরূপ হচ্ছে না। প্রতিদিন যদি প্রোডাক্টিভিটি কম থাকে বা প্রতিদিন যদি আশানুরূপ কাজ করা না হয়, যদি ১০টা কাজ করার থাকে আমি ৮টা করি, তাহলে প্রতিদিন আমি দুটো করে কাজ পেছাচ্ছি। এর পরের দিনও দুটা পেছাবো। এই করতে করতে একটা কাজের স্তূপ হয়ে যাবে।
যে কাজটা আপনার করা হয়নি, এটা আপনার আমার ব্যক্তিগত জীবনে যেমন সমস্যা তেমনি যে প্রতিষ্ঠানের জন্য আমরা কাজ করছি ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য ঠিক ততটাই ক্ষতিকর।
কাজের সময় শুধু কাজ। যখন খাওয়ার সময় হয় তখন শুধু খাওয়াই উচিত। আর হাঁটার সময় হাঁটাই শ্রেয়। যখন লিখতে বসবেন তখন খুব মনোযোগ দিয়ে লিখবেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা যে আপনি যখন যে কাজটি করছেন তখন সেই কাজটিই করুন, মনোযোগ বলতে শুধু এটেনশন নয় বরং কন্সন্ট্রেসন বুঝিয়েছি। পুরো মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে আপনি আপনার সর্বোত্তম আউটপুটটা পেয়ে যাবেন।
Advertisement
মূলত একজন মানুষ কীভাবে আরও বেশি প্রডাক্টিভ হয়ে উঠবেন, আরও বেশি কর্মক্ষম হয়ে উঠবেন, আরও বেশি দক্ষভাবে কাজে নিজের অবদান রাখতে পারবেন সে বিষয় নিয়ে আজ কথা বলব। নিজের প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর ৯টি উপায় আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয়।
এক.আপনি নিজেকে আরও প্রডাক্টিভ করতে চাইলে আপনার প্রথম যে কাজটা করতে হবে, সেটা হচ্ছে মাল্টিটাস্কিং বন্ধ করতে হবে। মাল্টিটাস্কিং হচ্ছে মূলত একসাথে অনেকগুলো কাজ করা। আসলে সারাদিন আমরা অনেক কাজ করি। কিন্তু আমাদের মন একসাথে অনেক ধরনের কাজ করার জন্য প্রস্তুত নয়। যখনই একসাথে ৩-৪টা কাজ করছেন, তখন কোনো কাজই আপনি সুচারুভাবে করতে পারছেন না।
আপনি হয়তো একটা চিঠি ড্রাফট করছেন। যদি একনাগাড়ে কাজটা করেন হয়তো এ ড্রাফটিংটা করতে আপনার ১৫ মিনিট সময় লাগবে। কিন্তু এর মধ্যেই আপনার মোবাইলে একটা নোটিফিকেশন চলে এলো, একটা শব্দ হলো বা কোনো একটা মেসেজ আসলো বা একটা কল এলো, ওইটাকে যখন আপনি রেসপন্ড করতে গেলেন তখন আপনার মনোযোগ হারিয়ে সেদিকে মনোযোগ দিলেন।
পরে যখন আপনি আপনার কাজে ফিরে আসছেন তখন আবার বেশ খানিকটা সময় লেগে যাচ্ছে ওই কাজে মনোযোগী হতে। ফলে ১০-১৫ মিনিটের যে কাজ, সেটা দেখবেন লম্বা হয়ে আধাঘণ্টা লেগে গেছে। যদি মাল্টিটাস্কিং আপনি করতে থাকেন, একটা কাজের মধ্যে অন্য কাজ করেন, তাহলে আপনার সময় অপচয় হবে এবং একটা কাজ করতে দীর্ঘ সময় লাগবে। ফলে সারা দিনে আপনার যে পরিমাণ কাজ করার কথা ছিল, সে পরিমাণ আপনি কোনোভাবেই করতে পারবেন না। এখানে একটা বুদ্ধি হচ্ছে যখন যে কাজটি করবেন একটি কাজ করুন। ওইটা শেষ হলে আর একটা কাজ করুন।
Advertisement
দুই.প্রত্যেক দিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আপনি পরের দিনের টু ডু লিস্ট ঠিক করে নিন। এটা করলে কি হবে? আপনি যখন মনোযোগের সাথে চিন্তা করবেন যে, কালকে আপনার কি কি কাজ করণীয় আছে, তখন এক, দুই, তিন, চার করতে করতে দেখবেন যে, ৮টা, ১০টা বা ২০টা হতে পারে। যখন এটা আপনি লিখে ফেলছেন, তখন আপনার মনে একটা ইম্প্রেশন পড়ছে যে এ কাজগুলো আপনার কালকে করতে হবে।
পরের দিন ওই কাজগুলো করার জন্য আপনার মনের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হবে। তখন দেখবেন আপনার অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে না এবং প্রতিটা কাজ আপনি সুচারুভাবে করতে পারছেন, মনোযোগের সাথে করতে পারছেন। কারণ আপনার মনের মধ্যে এটা কাজ করবে যে আমার ২০টা কাজের লিস্ট আছে, এখনও তো ৫টা বাকি বা এখনও তো ১০টা বাকি কিন্তু সময় তো লিমিটেড। ফলে এই টুডু লিস্টের কারণে আপনি কাজ করতে খানিকটা বাধ্য হবেন কারণ আপনি নিজের মনের মধ্যে একটা প্রেসার অনুভব করবেন। সুতরাং আপনি টু ডু লিস্ট করতে ভুলবেন না।
তিন.টু ডু লিস্ট একটা ডাইরিতে লিখুন। আপনি যখন একটা কাজ শেষ করবেন, তখন ওইটা কাটুন। এক নম্বর কাজ শেষ হলে ওটা কেটে দিন, দুই নম্বর কাজ শেষ হলে ওটা কেটে দিন, তিন নম্বর কাজ শেষ হলে, ওটা কেটে দিন। দেখবেন যে, আপনি মনের মধ্যে একটা আনন্দ অনুভব করছেন এবং দিনটাকে খুব মূল্যবান মনে হচ্ছে।
অথবা আপনি দিনের মধ্যবর্তী সময়ে দেখলেন যে আপনার অর্ধেক কাজ শেষ হয়নি। তখন আপনার মনে একটু তাড়া কাজ করবে। মনে হবে যে কাজ অনেক বাকি আছে সেটা শেষ করতে হবে। এ তাড়না আপনার কাজের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করবে, আপনাকে সচেতন রাখবে। আপনার মনের মধ্যে সব সময় একটা কাজ করার প্রেসার তৈরি করবে।
চার. প্রতিটি কাজ করার জন্য সময় নির্ধারণ করুন যে আপনি কত সময়ের মধ্যে কাজটি শেষ করবেন। যেহেতু আপনার অনেকগুলো কাজের টু ডু লিস্ট আছে, আপনার কাজের সময়কে ভাগ করে নিতে হবে। একটা কাজের জন্য আধা ঘণ্টা, আর একটা কাজের জন্য ১০ মিনিট এভাবে কাজ বুঝে সময়টা নির্ধারণ করে নিতে হবে। এই সময় যখন নির্ধারণ করে নিচ্ছেন তখন আপনি সময় ট্র্যাক করতে পারছেন। যদি আপনার কাজের মধ্যে কোনো বাধা চলে আসে, তখন তাড়াতাড়ি আবার কাজে ফিরে যাওয়ার জন্য নিজে মনোযোগী হন। মনোযোগী হয়ে কাজটা যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে ফেলুন।
পাঁচ.৯০ মিনিটের ব্যবধানে কাজ করুন। এটা একটা নতুন কথা হয়তোবা। ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা একটা গবেষণা করে দেখেছেন যারা ৯০ মিনিট ধরে কোনো একটা কাজ করেন তাদের যে দক্ষতা, তাদের যে গুণগত মান তার চাইতে যারা ৯০ মিনিটের বেশি সময় ধরে একনাগাড়ে কাজ করেন তাদের গুণগত মান কম। তার অর্থ হচ্ছে আপনি একটা কাজ লম্বা সময় ধরে করলে, শেষের দিকে আপনার উৎপাদনশীলতা কমতে থাকবে।
মূলত ৯০ মিনিট এক টানা কাজ করার পরে আমাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমতে থাকে। তাই নিজেকে আরও প্রডাক্টিভ করার জন্য আপনি ৯০ মিনিটের মাঝখানে পাঁচ মিনিটের একটা ব্রেক নিন। এখন এই ব্রেক নিয়ে আপনি কি করবেন? এই পাঁচ মিনিটের ব্রেক নিয়ে আপনি যদি মোবাইল ব্যবহার করেন তাহলে আপনার কর্মক্ষমতা আরও কমবে। এই সময়টা আপনার ব্রেনকে একটু রেস্ট দিন। আপনি চোখে মুখে পানি দিন, একটু হাঁটুন বা আপনার অন্য কাজ থাকলে করুন। মূলত ওই সময় ব্রেনকে একটু ফ্রি রাখার চেষ্টা করুন। চোখ হাতকে একটু অবসর দিন।
ছয়.কাজের মাঝে ব্রেক নিন। আরেকটা পদ্ধতি আছে যাকে বলে পোমোডোরো মেথড। এ পদ্ধতি বলছে, ২৫ মিনিট পরে আপনি ৫ মিনিটের একটা ব্রেক নিন, শর্ট ব্রেক। তাহলে যদি আপনি ১০০ মিনিট কাজ করেন, তাহলে আপনি ৪টা ৫ মিনিটের ব্রেক, মানে ২০ মিনিটের ব্রেক পাচ্ছেন। আপনি কাজ করছেন মূলত ৮০ মিনিট। এই ৮০ মিনিট হচ্ছে আপনার সুপার প্রোডাক্টিভ মিনিট, দারুণ উৎপাদনশীল সময়।
সাত.কাজের সময় শুধু কাজ। যখন খাওয়ার সময় হয় তখন শুধু খাওয়াই উচিত। আর হাঁটার সময় হাঁটাই শ্রেয়। যখন লিখতে বসবেন তখন খুব মনোযোগ শুধু লিখবেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা যে আপনি যখন যে কাজটি করছেন তখন সেই কাজটিই করুন, মনোযোগ বলতে শুধু এটেনশন নয় বরং কন্সান্ট্রেসন বুঝিয়েছি। পুরো মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে আপনি আপনার সর্বোত্তম আউটপুটটা পেয়ে যাবেন।
আট.নিজের কাজের রিভিউ নিন। আপনি আপনার নিজের শিক্ষক হয়ে উঠুন। একটা রিসার্চ আরটিক্যাল যখন রিভিউ করতে কারও কাছে পাঠানো হয়, তখন রিভিউয়ার খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা পড়েন। তার মধ্যে কোনো গ্যাপ থাকলে সেটা খুঁজে বের করে তা পূরণ করেন, ভুল ত্রুটিগুলো শুদ্ধ করেন। কখনো কখনো অনেক অংশ আবার লেখেন। কারণ এটার গুণগতমান যেন ভালো হয়, রিসার্চ ওয়ার্কটা যেন সুন্দর হয়। আপনি আপনার কাজকে রিভিউ করেন তাই যে কাজই করেন না কেন।
দেখুন, কোন কনটেন্ট রাইটার যদি লেখার আগে ভালোভাবে পড়েন, রিরাইট করেন, রিভিউ করেন, তাহলে তার লেখা আরও সুন্দর হয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ নিজের কাজের রিভিউ করেন না। আপনি যা করছেন সেই কাজের রিভিউ নিজে করবেন। দেখবেন, অনেক ভুলত্রুটি আপনার সামনে আসছে। আপনার কাজের গুণগত মান ভালো হচ্ছে। আপনি একজন দক্ষ কর্মী হয়ে উ্ঠছেন, আপনি আপনার বেস্ট ভার্সন হয়ে উঠছেন। সুতরাং, নিজের কাজের রিভিউ নিজে করুন।
নয়.আপনি পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান। এই ঘুম নিয়ে নানাজনের নানান মত আছে। কেউ বলেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮ ঘণ্টা ঘুম দরকার আবার কেউ বলেন যে ছয় ঘণ্টা ঘুমের দরকার। মূলত একেক জনের একেক রকম ঘুমের দরকার। কারণ যে প্রচুর খাওয়া দাওয়া করে, তার ঘুমও বেশি দরকার। যিনি কম খান তার কম ঘুমালেও চলে।
কাল মার্কস মাত্র দুই ঘণ্টা ঘুমাতেন। তারপরেও উনি সুস্থ জীবন কাটাতেন, কর্মক্ষম ছিলেন। আপনার ঘুম যেন ভালো হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সারাদিনের ক্লান্তি অবসাদ এগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আপনার একটা পরিপূর্ণ বিশ্রাম দরকার, পরিপূর্ণ ঘুম দরকার। যত দ্রুত ঘুমাতে যাওয়া যায় ততই ভালো। খুব ভোর থেকে আপনার দিন শুরু করুন, তাহলে আপনার দিন অনেক লম্বা হবে। আপনি প্রতিদিন বেশি বেশি প্রডাক্টিভ হয়ে উঠবেন।
লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।
এইচআর/ফারুক/এএসএম