ওয়ার্কশপে ডান হাত হারানো শিশু নাঈম হাসান নাহিদের চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত বিষয়ে জারি করা রুলের শুনানি শেষ হয়েছে। এ বিষয়ে আদেশ দেওয়ার জন্য (সিএবি) অপেক্ষমাণ রেখেছেন হাইকোর্ট। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাস গুপ্ত বিষয়টি জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেন।
Advertisement
মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে রুলের শুনানি হয়। শুনানি শেষে আদালত বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন।
রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার অনিক আর হক। তাকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ বাকীর উদ্দিন ভূঁইয়া। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী তামজিদ হাসান।
অন্যদিকে নুর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুল বারেক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্ত। শুনানি থাকায় শিশুটি তার মায়ের সঙ্গে আদালতে আসে।
Advertisement
ওয়ার্কশপে কাজ করতে গিয়ে তিন বছর আগে হাত হারায় শিশু নাঈম হাসান। এ ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট করা হয়। রিটের শুনানিতে মায়ের সঙ্গে আদালতে আসে শিশুটি।
এসময় আদালত শিশুর কাছে জানতে চান, পড়াশোনা করো? উত্তরে সে জানায়, পড়ালেখা করে।
আদালত বলেন, কোথায় এসেছ, জান? তখন শিশুটি বলে, কোর্টে এসেছি।
আদালত বলেন, কেন এসেছ? শিশুটি বলে বিচার চাইতে এসেছি।
Advertisement
তখন আদালত কক্ষে এক ধরনের আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। এসময় শিশুটিকে চকলেট দেন আদালত।
‘ভৈরবে শিশুশ্রমের করুণ পরিণতি’ শিরোনামে ২০২০ সালের ১ নভেম্বর পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, তখন নাঈম হাসানের বয়স ১০ বছর। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তো। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার আড়াইসিধা গ্রামে। তার বাবা আনোয়ার হোসেন পেশায় জুতা ব্যবসায়ী। করোনার সময় কর্মহীন হয়ে পড়েন আনোয়ার। এসময় সংসারের চাপ সামলাতে নাঈমকে তার মা-বাবা কিশোরগঞ্জের ভৈরবে একটি ওয়ার্কশপে কাজে দেন। ওই ওয়ার্কশপে কাজ করতে গিয়েই তার ডান হাত মেশিনে ঢুকে যায়। শেষে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কনুই থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় ডান হাত।
প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে ক্ষতিপূরণের নির্দেশনা চেয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শিশুর বাবা হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২৭ ডিসেম্বর রুল দেন হাইকোর্ট। রুলে শিশুটিকে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। চার সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
একই সঙ্গে ঘটনাটি নিজ কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা দিয়ে অনুসন্ধান করতে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে আইনজীবী ব্যারিস্টার অনীক আর হক বলেন, জেলা প্রশাসক সবার বক্তব্য উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেন। তবে মতামতে অসঙ্গতি রয়েছে। ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে রুলের ওপর শুনানি শেষে আদালত বিষয়টি রায়ের জন্য রেখেছেন। এর আগে শিশুর বক্তব্যও শোনেন আদালত।
রিট আবেদনকারীপক্ষ জানায়, ওই ঘটনায় নাঈমের চাচা শাহ পরান বাদী হয়ে জবরদস্তিমূলক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগিয়ে আহত করার অভিযোগে ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর ভৈরব থানায় মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় ওয়ার্কশপের মালিক ইয়াকুব হোসেন, ওয়ার্কশপের মিস্ত্রি স্বপন মিয়া, জুম্মান মিয়া, সোহাগ মিয়া ও ব্যবস্থাপক রাজু মিয়াকে। এ মামলায় ২০২১ সালের ৩০ মে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নাঈমের পরিবার যে ভবনে ভাড়া থাকত, সেই ভবনের মালিক ওই এলাকার ইয়াকুব হোসেন (৫০) নামের এক ব্যক্তি। ওই এলাকায়ই ইয়াকুবের নুর ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি ওয়ার্কশপ রয়েছে। ভাড়াটিয়া আনোয়ার হোসেনের পরিবারের দুরবস্থা দেখে নাঈমকে তার ওয়ার্কশপে কাজে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তিনি কথা দেন, নাঈমকে দিয়ে ভারী কাজ করাবেন না। শুধু চা আনা আর ঝাড়পোছের মতো হালকা কাজ করানোর প্রস্তাব দেওয়ায় রাজি হন আনোয়ার-মনোয়ারা দম্পতি। প্রথম রমজানে কাজে যোগ দেয় নাঈম।
নাঈমের পরিবারের দাবি, শুরুর দুই মাস তাকে দিয়ে হালকা কাজই করানো হতো। দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ আগে থেকে নাঈমকে ড্রিল মেশিন চালানোর কাজে যোগ দিতে বলেন ইয়াকুব। রাজি না হওয়ায় তাকে মারধর করা হয়। পরে বাধ্য হয়ে ড্রিল মেশিনের কাজে হাত লাগায় নাঈম। ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে দুর্ঘটনার শিকার হয় নাঈম। তখন মোটা পাইপ কাটার সময় ড্রিল মেশিনে তার ডান হাত ঢুকে যায়। শেষে শিশুটিকে বাঁচাতে চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কনুই থেকে ডান হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।
এফএইচ/জেডএইচ/জেআইএম