দু’মুঠো ভাত ও সন্তানদের পড়াশোনার খরচ মেটাতে চায়ের দোকানের পাশাপাশি অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন নাসিমা আক্তার (৪৫)। স্বামী মারা যাওয়ার পর আর কোনো আপনজন না থাকায় জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে দীর্ঘদিন ধরেই এই কষ্টসাধ্য কাজ করে আসছেন তিনি।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বামীর মৃত্যু হয়। তখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন তিনি। এছাড়াও ছিল আরও দুই মেয়ে। তখন জীবন চালাতে বেছে নেন চায়ের দোকান। কিন্তু ছোট্ট এই দোকান চালিয়ে সংসারের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। তাই বর্তমানে দোকানের পাশাপাশি বেছে নিয়েছেন অটোরিকশা চালানোর মতো কাজ।
একজন নারীকে অটোচালক হিসেবে দেখে প্রতিনিয়ত অবাক হন যাত্রীরা। অনেকে যেমন তাকে কাজ করার সাহস যোগাচ্ছেন, আবার অনেকেই নানা কটুকথা শোনান তাকে। তবে এগুলো তোয়াক্কা করেন না নাসিমা আক্তার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ব্যস্ততম পয়েন্ট শিমরাইল মোড় এলাকায় ডেমরা সড়কে অটোরিকশা চালাচ্ছেন নাসিমা। দিনে অটোরিকশা চালান ও রাতে দোকানে চা বিক্রি করেন তিনি। বসবাস করেন ডেমরার শুকুরসী এলাকায়। বিধবা নাছিমার সংসারে তিন মেয়ে। এভাবে কাজ করেই বড় মেয়ে জোসনার (২০) বিয়ে দিয়েছেন। মেজ মেয়ে ফারজানা (১৫) ও ছোট মেয়ে ফারিয়াকে (১০) একটি মাদরাসায় রেখে পড়াচ্ছেন।
Advertisement
নাসিমার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিলেটের কামারপাড়ায় তার জন্ম। সেখান থেকে বাবা মায়ের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন তিনি। এক সময় আব্দুর বারেকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পেশায় তিনি ট্রাকচালক ছিলেন। সুখের সংসারই ছিল তার। হঠাৎ একদিন তার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। বর্তমানে তার বাবা-মাও বেঁচে নেই। তিন মেয়েকে নিয়ে বাঁচার তাগিদে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ডেমরা সড়কের গলাকাটা পুলের পাশে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান দেন তিনি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাসিমা আক্তার বলেন, আমি গরিব মানুষ। এখনো আমার দুই মেয়ের পড়াশোনার খরচ মেটাতে হয়। তাদের পেছনে মাসে অনেক টাকা খরচ হয়। আগে ঘরভাড়া দিয়ে থাকতাম। কিন্তু পড়াশোনার খরচ দিতে গিয়ে এখন ঘরভাড়া দিতে পারি না। তাই রাস্তার পাশে কোনোরকম একটা বাসা তৈরি করে বসবাস করি।
তিনি বলেন, বর্তমানে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখি। পরে সকাল ১০টা থেকে বিকেল পর্যন্ত অটোরিকশা চালাই। এভাবেই কোনোরকমে বেঁচে আছি। অনেকেই আমাকে নিয়ে খারাপ কথা বলে। কে কী বললো তা শুনে আমার লাভ নেই। আমি আমার মতো চলি। মানুষ আমাকে খারাপ মনে করে। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। শুধু আল্লাহকে বিশ্বাস করি।
অনেক জায়গায় চাকরি চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক জায়গায় আমি চাকরি করতে গিয়েছিলাম। আমি মোটা বলে আমাকে চাকরিতে নেয় না। এরপর আমি অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে একটি চায়ের দোকান দিই। কিন্তু ওই দোকান দিয়ে যে ইনকাম হয় তা দিয়ে আমার সংসার চলে না। তাই পরবর্তীতে একটি অটোরিকশা কিনতে বাধ্য হই। এই দুইটা দিয়ে কোনোরকম বেঁচে আছি।
Advertisement
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আমি নারী বলে অনেকেই আমার অটোরিকশায় উঠতে চায় না। আমি অটোরিকশা চালাই, অনেকেই বিষয়টা ভালোভাবে নেয় না।
বুকভরা আশা নিয়ে সরকারের সহযোগিতা চেয়ে নাসিমা আক্তার বলেন, আমাকে যদি সরকার সহযোগিতা করতো কিংবা আমাকে যদি অন্তত একটা থাকার ঘর তৈরি করে দিতো তাহলে আমি একটু ভালো করে চলতে পারতাম। তাহলেই আমি খুশি থাকবো। অনেক কষ্টের মধ্যেও আমি আজ পর্যন্ত কারো কাছে কখনো হাত পাতিনি। বয়স হয়ে যাওয়ায় অটোরিকশা চালাতে গিয়ে আমার শরীর অনেক ব্যথা করে। তারপরও গাড়ি চালাতে বাধ্য হই। আবার টানা দোকানদারিও করতে পারি না। পা ফুলে যায়। আমার পাশেতো কেউ দাঁড়ানোর নেই। আমার মা-বাবা, ভাই-বোন কেউই নেই। আমি অনেক কষ্টে আছি।
তিনি বলেন, এভাবে আর কতদিন কষ্ট করে যাবো তা আল্লাহই ভালো জানেন। বড় মেয়ের মতো আমার বাকি দুই মেয়েকেও মানুষের মতো মানুষ বানিয়ে বিয়ে দিতে পারলেই আমার জীবনে আর কোনো চাওয়া পাওয়ার কিছু থাকবে না।
নাসিমার দোকানে চা খেতে আসা এক ক্রেতা বলেন, আমার নিয়মিত তার দোকানে চা খেতে আসা হয়। তিনি তার দুই মেয়েকে নিয়ে খুব কষ্টে আছেন। মাঝেমধ্যে তাকে দোকান চালানোর পাশাপাশি অটোরিকশা চালাতে দেখি। তিনি নারী হয়েও যেভাবে কষ্ট করে টাকা উপার্জন করেন তা দেখে নিজেদের কাছেও খুব খারাপ লাগে।
আবুল কালাম নামে ওই এলাকার এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, দীর্ঘদিন ধরেই তাকে ডেমরা-শিমরাইল সড়কে অটোরিকশা চালাতে দেখি। বয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রে অটোরিকশা চালানোটা খুবই কষ্টসাধ্য। তার পাশে যদি সরকার দাঁড়াতো তাহলে তার এই কষ্ট লাঘব হতো।
নারায়ণগঞ্জ সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান সরদার বলেন, আমরা এই ধরনের নারীকে সাধুবাদ জানাই। তিনি প্রতিকূলতা জয় করে কারো কাছে হাত না পেতে যেভাবে জীবিকা নির্বাহ করছেন, পাশাপাশি দুই মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন তাতে তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এছাড়া কোনো কাজেই নারী পুরুষের ভেদাভেদ নেই তা তিনি প্রমাণ করলেন। তাকে দেখে অনেক নারী এভাবে প্রতিকূলতা জয় করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। আমাদের পক্ষ থেকে তাকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করবো।
এফএ/এমএস