ফারজানা অনন্যা
Advertisement
‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথাতোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতাতুমি মিশেছ মোর দেহের সনেতুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনেতোমার ওই শ্যামলবরণ কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা’(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)প্রকৃতি ও মানব জীবনের মধ্যে যে যাপনপ্রভাব থাকে; সেই প্রভাবের পথে আবিষ্কৃত হয় বিশ্বভুবনের মহিমা! মাটি, মা, মায়া—আশ্রয়েরই যেন তিন সমার্থক শব্দ। মাটি বিশ্ব প্রকৃতির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সমগ্র পৃথিবী ও পৃথিবীর বুকে বেড়ে ওঠা যাবতীয় বিষয়বস্তুকে জননীর মতো ধারণ করে আছে সর্বংসহা মৃত্তিকা।
পৃথিবী নামক এ গ্রহকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে রেখে যাওয়ার অঙ্গীকারের প্রেক্ষাপটে মাটি ও পানির গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানে যেসব বস্তুর প্রয়োজন হয়, তার সবগুলোরই উৎস মাটি। এমনকি আমাদেরে বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রকৃতির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ উদ্ভিদের প্রধান আশ্রয় মাটি। আমরা মাটিকে আমাদের জীবনের একটি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে মনে করে থাকি। তবে মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে এ মাটির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে, তথা মাটি দূষিত হচ্ছে। মাটির মৃত্যু ঘটছে!
মাটিদূষণ বলতে বোঝায় মাটির প্রয়োজনীয় উপাদান হ্রাস ও অবাঞ্ছিত পদার্থসমূহের সঞ্চয়, যা বর্তমান প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের জন্য ক্ষতিকর। অবাঞ্ছিত পদার্থ বলতে সেসব উপাদানকে বোঝায়, যা মাটির নেতিবাচক রূপান্তর ঘটায়। প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বস লিখেছে, ‘পৃথিবীতে খুব দ্রুত মাটির গুণ নষ্ট হওয়ার সংবাদ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য নিঃসন্দেহে দুঃসংবাদ।’
Advertisement
আরও পড়ুন: দৃষ্টিহীন তরিকুলের বিস্ময়কর সাফল্য
মাটির উর্বরতা নষ্ট হওয়া, কার্বন ধারণের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া ও মাটির জীববৈচিত্র্য কমে যাওয়ায় বাস্তুতন্ত্রে তৈরি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা। বর্তমানে স্বাস্থ্যকর মাটির আকাল দেখা দিয়েছে। আমাদের খাদ্যের শতকরা ৯৫ ভাগ উৎপাদিত হয় ভূমিতে, যেখানে মাটি ও পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
এশিয়া-প্যাসিফিকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মাটিতে জৈব পদার্থের উপস্থিতি ২%-এর নিচে নেমে এসেছে। যেখানে ৫% জৈব পদার্থের উপস্থিতি মাটির জন্য সবচেয়ে ভালো এবং ন্যূনতম ২% থাকা আবশ্যক। মাটি সার পুনর্ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু শিল্পবর্জ্য পুনর্ব্যবহার করতে পারে না। এভাবে শিল্পদূষণের কারণে ওপর দিককার মাটি প্রাণহীন হয়ে পড়ছে। ইটভাটাগুলো আরও একটি বড় দূষণের কারণ, যা সরাসরি মাটিকে ধ্বংস করে থাকে। মাটি, পানি এবং বায়ুদূষণ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং একটি চক্রের মতো দূষিত হয়। দূষিত বায়ু এবং জল শেষ পর্যন্ত মাটিতে জমা হয়। এ ধরনের ক্ষতি শুধু কৃষির জন্যই নয়, অন্য গাছপালা এবং জীবাণুরও ব্যাপক ক্ষতি করে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে প্ল্যাস্টিকও মাটি দূষণের উৎস হয়ে উঠেছে।
এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ৩৯ থেকে ৫২ শতাংশ এলাকায় মাটির উর্বরতা কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ধান চাষের জন্য প্রয়োজনীয় দুটি উপাদান গন্ধক ও দস্তার পরিমাণও দেশের ৪০ শতাংশ এলাকায় কম। মাটিতে পাঁচ মিলিমিটার থেকেও কম দৈর্ঘের ক্ষুদ্র প্ল্যাস্টিক কণার (মাইক্রোপ্ল্যাস্টিক) অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। এসব ক্ষুদ্র প্ল্যাস্টিক কণা মাটিতে বসবাসকারী জীবকুলের জন্য ক্ষতিকর।
Advertisement
আরও পড়ুন: মণিপুরীদের রাস উৎসব যেভাবে এলো
মাটি দূষণের প্রধান কারণগুলো হলো—জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ভূমি ক্ষয়, কলকারখানার বর্জ্য, অত্যধিক রাসায়নিক সার ব্যবহার, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষনিধন, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, প্ল্যাস্টিকের ব্যবহার, চিংড়ি চাষ, অনিয়ন্ত্রিত কৃষি কাজ ইত্যাদি।
মাটিদূষণ রোধ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ‘World Soil Day’ প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর উদযাপন করা হয়। ডিসেম্বর ২০১৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৫ ডিসেম্বর ২০১৪ কে প্রথম বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে মনোনীত করে। মৃত্তিকা সম্পদের লক্ষ্য টেকসই ব্যবস্থাপনার প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য প্রতি বছর আলাদা আলাদা প্রতিপাদ্য ব্যবহার করা হয়। বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২৩-এর প্রতিপাদ্য হলো—‘Soil and Water: a source of life’ যার বাংলা ভাবার্থ—‘মাটি ও পানি: জীবনের উৎস’। মাটি এবং পানির গুরুত্ব সর্বমহলে অনুধাবনের জন্য এ বছরের প্রতিপাদ্যটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী হয়েছে বলে মনে করি।
মা, মাটি আর দেশমাতৃকার ব্যবহার দেখা যায় বাংলা সাহিত্যের পরতে পরতে। কৃষিভিত্তিক আমাদের এই বাংলাদেশের জনমানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন কৃষিকাজ। তাই মাটির অনুষঙ্গ বারবার উপস্থাপিত সাহিত্যের সব শাখায়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ও ছোটগল্পের মূল বিষয়বস্তু মাটি ও মাটিঘেঁষা মানুষ। হাসান আজিজুল হকের ‘জীবন ঘষে আগুন’ ছোটগল্পে মাটি বিষয়টি এসেছে বিশেষ ব্যঞ্জনা নিয়ে।
আরও পড়ুন: অবহেলিত রেলের লাল পোশাকের শ্রমিকরা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে মাটির রূপায়ণ দেশমাতৃকার রূপকে—‘বাংলার মাটি, বাংলার জল,বাংলার বায়ু, বাংলার ফলপুণ্য হউক পুণ্য হউকপুণ্য হউক হে ভগবান’মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের গানে মাটি এসেছে দেশমাতৃকার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায়—‘আমার দেশের মাটির গন্ধেভরে আছে সারা মনশ্যামল কোমল পরশ ছাড়া যেনেই কিছু প্রয়োজন’জসীম উদ্দীনের কবিতায় ‘মাটি’ কবির কাছে পরমাত্মীয় হিসেবে পরিগণিত। কারণ তার প্রিয় মানুষেরা শায়িত মাটির কোলে—‘এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক,আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।"
পৃথিবীকে সুস্থ ও স্বাভাবিক বসবাস উপযোগী করার জন্য মাটিদূষণ রোধ জরুরি। বাংলাদেশকে অবশ্যই শিল্প এলাকায় বর্জ্য শোধনাগারের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে প্রচলিত ক্ষতিকর ইটভাটায় মাটির ব্যবহার বন্ধ করে পরিবেশবান্ধব ইটের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা জরুরি। সুস্থ মাটির জন্য মাটিতে জৈব ও অজৈব পদার্থের পরিমাণ নির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গে জীববৈচিত্র্য শনাক্ত ও তাদের প্রাচুর্য নির্ণয় করতে হবে।
পরিবেশবান্ধব মাটির জন্য সহায়ক প্রযুক্তি ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। ভবিষ্যতের হুমকি এড়াতে এবং মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অতি শিগগির আমাদের সোচ্চার হওয়া উচিত।
লেখক: প্রভাষক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি।
এসইউ/জেআইএম