দেশজুড়ে

‘পা ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে মাথা পর্যন্ত পেটাতো, এখন শরীরজুড়ে ব্যথা’

পুরো শরীরজুড়েই নির্যাতনের চিহ্ন। লাঠির আঘাতে জায়গায়গুলো কালশিটে বর্ণ ধারণ করেছে। নির্যাতনের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছেন তারা।

Advertisement

বলছিলাম শরীয়তপুরের ফেরদৌস, আল-আমিন ও রাকিব নামের ৩ তরুণের কথা। যারা দালালের খপ্পরে পড়ে লিবিয়ার বন্দিশালায় দীর্ঘ ১১ মাস বন্দি থাকার পর অবশেষে সরকারি সহযোগিতায় দেশে ফিরেছেন। বর্তমানে তারা অসুস্থ অবস্থায় শরীয়তপুর জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

শরীয়তপুর সদর উপজেলার আংগারিয়া ইউনিয়নের উত্তর ভাষানচর এলাকার এনামুল মাদবরের ছেলে ফেরদৌস মাদবর (১৯), একই এলাকার খলিল ফকিরের ছেলে আল-আমিন ফকির (২০) ও নড়িয়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বাদশা খানের ছেলে রাকিব খান (১৯)।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৬ মার্চ উত্তর ভাষানচর এলাকার হাকিম বেপারীর ছেলে স্থানীয় দালাল হাবিবুর বেপারীর মাধ্যমে প্রত্যেকে ১১ লাখ টাকা চুক্তিতে ইতালির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। তবে লিবিয়া পৌঁছানোর পর হাবিবুর বেপারীর মাধ্যমে তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয় মুকুল ও মকবুল নামের আরও দুই দালালের কাছে। মুকুল আর মকবুল তাদের তিনজনকে কয়েক মাস লিবিয়ার জোয়ারা শহরে আটকে রাখেন। পরে ইতালি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে সাব্রাতা শহরে নিয়ে তুহিন নামের এক মাফিয়ার কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। এরপরই এ তিন তরুণের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার।

Advertisement

টাকা আদায়ের জন্য তাদের পা ওপরের দিকে রশিতে ঝুলিয়ে লোহা ও প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে সারা শরীরজুড়ে পেটানো হতো। পানির তৃষ্ণায় কাতর হয়ে গেলে তাদের খাওয়ানো হতো নোংরা আর লবণযুক্ত পানি। খাবার বলতে সারাদিনে শুধু এক টুকরা রুটি। এতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই তিন তরুণ। আর নির্যাতনের এসব দৃশ্য ভিডিওকলে পরিবারকে দেখিয়ে দাবি করা হয় জনপ্রতি ১৫ লাখ টাকা।

এ ঘটনায় ভুক্তভোগী আল-আমিন ফকিরের মা মঞ্জিলা বেগম ২০২২ সালের ৬ নভেম্বর বাদী হয়ে হাবিবুল বেপারীসহ তিনজনকে আসামি করে পালং মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ করেন।

পরে হাবিবুল বেপারী ও তার সঙ্গীরা গ্রেফতার হলে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন দালালরা। একপর্যায়ে নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে তিনটি পরিবার তাদের সন্তানদের বাঁচাতে সহায় সম্বল বিক্রি করে ৩৩ লাখ টাকা তুলে দেন দালালদের হাতে। তবে টাকা পেয়েও আরও টাকা দাবি করতে থাকেন দালালরা। একপর্যায়ে পরিবারগুলো আরও টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে বাধ্য হয়ে ১১ মাস নির্যাতন শেষে লিবিয়ার স্থানীয় একটি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয় ফেরদৌস, আল-আমিন ও রাকিবকে। পরে ত্রিপলী আলজারা শহরের একটি কারাগারে দুই মাস কাটানোর পর সরকারি সহায়তায় ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশে ফেরেন তারা।

ভুক্তভোগী ফেরদৌস মাদবর, আল-আমিন ফকির ও রাকিব খান বলেন, ‘হাবিবুল আমাদের ইতালি নেওয়ার কথা বলে অন্য দুই দালালের হাতে তুলে দেয়। তারা আমাদের তুহিন মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দেওয়ার পর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। তারা আমাদের পা ওপরের দিকে ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে পা থেকে মাথা পর্যন্ত লাঠি দিয়ে পেটাতো। তাদের হাত-পা ধরে অনুরোধ করলেও ছাড়তো না। সারাদিনে একটি শুকনা রুটি কয়েকজনে ভাগাভাগি করে খেয়েছি। কখনো ভাবিনি বেঁচে ফিরতে পারবো।’

Advertisement

তারা আরও বলেন, দালালরা আমাদের শরীরে নির্যাতন চালিয়ে এমন অবস্থা করেছে যে ভবিষ্যতে কোনো কাজও করতে পারবো না। সারা শরীরজুড়ে শুধু ব্যথা।

ফেরদৌস মাদবরের মা আসমা বেগম বলেন, ‘হাবিবুরের কথায় ভেবেছিলাম ছেলেকে ভালোভাবে ইতালি পৌঁছে দেবে। কিন্তু সে আমার ছেলেকে লিবিয়া নিয়ে মাফিয়াদের হাতে তুলে দেয়। মাফিয়ারা টাকার জন্য ছেলেকে অনেক অত্যাচার চালাতো। আমাদের ভিডিওকলে ফোন দিয়ে টাকা চাইতো। ছেলের জীবন বাঁচাতে সবকিছু বিক্রি করে তাদের ১১ লাখ টাকা নেই। আজ আমাদের আর কিছুই নেই।’

ভুক্তভোগী রাকিব খানের মা কমলা বেগম বলেন, ‘আমাগো ভিটিবাড়ি সব বিক্রি কইরা ২২ লাখ টাকা ক্যাশ দিছি। বাপের বাড়ির কতটুক জমিন আছিল, ছেলেরে ছাড়ানোর কথা বলে তাও হাবিবুল দলিল কইরা লইয়া গেছে। এখন আমাগো সন্তানগো অত্যাচার কইরা সব শ্যাষ কইরা দিছে। ওগো লইয়া কীভাবে বাঁচমু? অনেক কষ্টে দিন কাটতাছে। আমরা এর সঠিক বিচার চাই।’

এ বিষয়ে অভিযুক্ত হাবিবুর বেপারীর বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে এ বিষয়ে হাবিবুর বেপারীর বড় ভাইয়ের স্ত্রী সারু বিবি বলেন, ‘তাদের সঙ্গে কথা হয়েছিল আমার দেবর তাদের লিবিয়া পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। তাদের লিবিয়া পর্যন্ত ঠিকঠাক পৌঁছে দিয়েছে। সেখানে গিয়ে অন্য মাফিয়ার হাতে পড়ে আমার দেবরকে এসে ধরেছে।’

জানতে চাইলে পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, মামলাটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে। খুব শিগগির অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হবে।

এসআর/জিকেএস