মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কারে আরেকবার সম্মানিত হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। জলবায়ুর বিরূপ ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বিশ্বকে মুক্ত রাখতে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ও নেতৃত্বদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ক্লাইমেট মোবিলিটি চ্যাম্পিয়ন লিডার’ অ্যাওয়ার্ড পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
Advertisement
গত ১ ডিসেম্বর দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ ২৮) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি রাষ্ট্রদূত ডেনিস ফ্রান্সিস এবং আইওএম মহাপরিচালক অ্যামি পোপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিনিধি তথ্যমন্ত্রী ড.হাসান মাহমুদের কাছে অ্যাওয়ার্ড হস্তান্তর করেন। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ' পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
১৯৯২ সালে শুরু হওয়া জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন ‘কপ’ এবারই প্রথম তেল সমৃদ্ধ দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে।ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যুক্তরাজ্যর প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসসহ বিশ্বের দুইশত রাষ্ট্রের সরকার প্রধান কিংবা তাদের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন।
এছাড়া জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা গুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার ৮৪ হাজারের বেশি অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আছেন সরকারি কর্মকর্তা,ব্যবসায়ী নেতা, বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ, আদিবাসীও এনজিও প্রতিনিধিরা।
Advertisement
এবারই বেশি সংখ্যক প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৯৫ সালে প্রথম কপ-১ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল মাত্র ৪ হাজার প্রতিনিধি। আর গতবছর কপ-২৭ এ অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার। এবারের সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ২২ টি রাষ্ট্র কার্বন নিঃসরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তেলের ব্যবহার কমিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুতের কার্যক্রম বর্তমানের চেয়ে তিন গুণ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। যা এবারের সম্মেলনের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সিন্ধান্ত। এখন দেখার বিষয় তারা কত দ্রুত তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে।
কপ-২৮ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। এজন্যই তাঁর মতামত নিবন্ধ আকারে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘নিউজউইক’-এ লিখেছেন। গত ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের সিইও প্যাট্রিক ভারকুইজেনের একটি নিবন্ধ নিউজউইক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটি এমন সময় প্রকাশিত হয়েছে, যখন দুবাইয়ে কপ-২৮ শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিবন্ধের মাধ্যমে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন হলো একটি বৈশ্বিক বিপর্যয়, যা গরীবের উপর ধনীরা চাপিয়ে দেয় এবং ক্রমবর্ধমান হারে এটি তাদের নিজেদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। দুবাইতে কোপ-২৮ জলবায়ু সম্মেলনের জন্য আমন্ত্রিত বিশ্বনেতাদের বুঝতে হবে যে তাদের টপ-ডাউন (উপর থেকে নিচে) পদ্ধতি কখনোই কাজ করতে পারেনা। বরং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার লড়াইয়ের জন্য আমাদের ক্ষতিগ্রস্তদেরকে দায়িত্ব দিতে হবে এবং এ লড়াইয়ে তাদের সমর্থন করতে হবে।
কপ-২৮ তখনই সফল হবে যখন এটি জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কমিউনিটির জন্য প্রকৃত সুবিধা অর্জন করবে। এবছরের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র সম্প্রদায়ের কাছে অর্থ প্রবাহ এবং স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব, উপযুক্ত এবং কার্যকর অভিযোজন নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যদি এটি অর্জন করতে পারি, তাহলে সেটি হবে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুতর অবিচার প্রতিকারের একটি বড় পদক্ষেপ।’
Advertisement
জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সংকট। বাংলাদেশ বিশ্বের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে সপ্তম। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে বেশকিছু পরিবর্তন ইতোমধ্যেই দেখা গেছে। ষড় ঋতুর বাংলাদেশ যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের কারণে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদী ভাঙ্গন, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা বেড়েই চলছে। যা কৃষি,অবকাঠামো ও জীবনযাত্রার উপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ২২ কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হবে। যার ৪ কোটি দক্ষিণ এশিয়ার। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিরাট সংখ্যক মানুষ সেই ঝুঁকিতে আছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষার জন্য জাতিসংঘে পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিভিন্ন কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক প্রায় প্রতিটি সংস্থা থেকে এক বা একাধিক বার পুরস্কার পেয়েছেন। পুরস্কার তাঁর জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি মহল যেভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে অপপ্রচার করে যাচ্ছে, ঠিক সেসময়ে জাতিসংঘ কর্তৃক এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার নিঃসন্দেহে অনেক গুরুত্ব বহন করে। দেশরত্ন শেখ হাসিনা শুধুমাত্র বাংলাদেশেরই নেতা নন, তিনি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
প্রথম প্রস্তাব: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো সহযোগিতা কামনা। দ্বিতীয় প্রস্তাব:বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা ও প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন।তৃতীয় প্রস্তাব:দুর্বল দেশগুলোকে তহবিল সরবরাহ করা।চতুর্থ প্রস্তাব:দূষণকারী দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় প্রশমন ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের এনডিসি (জাতীয় নির্ধারিত অবদান) বাড়ানো। পঞ্চম প্রস্তাব:জলবায়ু শরণার্থীদের পুনর্বাসন একটি বৈশ্বিক দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতি প্রমশনকে প্রাধান্য দিয়ে ১০০ বছর মেয়াদি ডেল্টা প্লান-২১০০ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস সম্প্রসারণ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন, উপকূলীয় বাঁধ তৈরি, বনায়নের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী, ১৪ হাজার সাইক্লোন সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধি ও দ্রুত পদক্ষেপের জন্য ৮৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়েছে। এসব কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম সতর্কতা গ্রহণের ফলে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় উদ্ভাবনী নীতি ও কৌশল প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল।
জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ৫৫ দেশের সংগঠন ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিডিএফ)।বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে এসব দেশের দায় শতকরা পাঁচ ভাগ হলেও জলবায়ু পরিবর্তনে এরাই সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন। সিডিএফ সংগঠনের সভাপতি হিসেবেও বাংলাদেশ দায়িত্ব পালন করেছে। সিডিএফ ভুক্ত দেশগুলোর প্রধান কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছেন শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনের জন্য শেখ হাসিনা নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেছেন,‘শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতাদের মধ্যে অন্যতম যিনি জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটা নিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর কারণেই জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনে বাংলাদেশ সেরা শিক্ষক।’
বিভিন্ন কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক প্রায় প্রতিটি সংস্থা থেকে এক বা একাধিক বার পুরস্কার পেয়েছেন। পুরস্কার তাঁর জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি মহল যেভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে অপপ্রচার করে যাচ্ছে, ঠিক সেসময়ে জাতিসংঘ কর্তৃক এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার নিঃসন্দেহে অনেক গুরুত্ব বহন করে। দেশরত্ন শেখ হাসিনা শুধুমাত্র বাংলাদেশেরই নেতা নন, তিনি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
এক্ষেত্রে তিনি বিশ্ব সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০১৯ সালে জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশন) ঢাকা বৈঠকে সেকথারই প্রতিফলন পাওয়া যায়। বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর কথাও জোরালো ভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি শুধু নিজের দেশ নিয়ে ভাবিনা। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে অনেক ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ হারিয়ে যাবে। তখন সেখানকার মানুষ কোথায় যাবে, সেকথাও আমাদের ভাবতে হবে।’
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
haldertapas80@gmail
এইচআর/জিকেএস