দেশজুড়ে

শামছুন নেহার এখন ভিক্ষা করেন না, অন্যকে দেন

ক্ষুধার তাড়নায় হাত পাততে বাধ্য হন মানুষের দ্বারে দ্বারে। ভিক্ষাবৃত্তির নামে অভিশপ্ত জীবনের সূচনা হয় শামসুন নেহারের। মেয়ের বিয়ের বয়স হওয়ায় মাথা গোজার একমাত্র অবলম্বন ঘরভিটা বন্ধক রাখেন। তবে বন্ধকের টাকা পরিশোধ করার আগেই শামসুন নেহারের স্বামী মারা যান।

Advertisement

৫ বছর আগেও শামছুন নেহার ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালাতেন। সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে যা পেতেন তা দিয়ে অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা ও সংসারের খরচ চলতো। এখন তিনি আর ভিক্ষা করেন না। নিজেকে সম্মানিত করতে শুরু করেছেন ব্যবসা।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ১নং করেরহাট ইউনিয়নের গেড়ামারা গ্রামে দরিদ্র পাহাড়ি দিনমজুর বাবার ঘরে জন্ম নেন শামছুন নেহার। বাবার অভাবের সংসারে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে না খেয়ে সংগ্রামী জীবন পার করেন ১৬ বছর পর্যন্ত। অভাবের সংসারে বাবার মৃত্যুর পর মানবেতর জীবনযাপন শুরু হয়। মা ও চাচার পীড়াপীড়িতে ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় নিত্য অভাবি দিনমজুর আলী মিয়ার সঙ্গে। আলী মিয়া পাহাড় থেকে কাঠ কেটে এনে লাকড়ি হিসেবে বাজারে বিক্রয় করে সংসার চালাতেন। অভাব অনটন লেগেই থাকতো তাদের সংসারে। এক মেয়ে, তিন ছেলে মিলে ছয় জনের ভরণপোষণ চালানো আলী মিয়ার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছিল।

এর মধ্যে স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়ের শ্বশুরবাড়ির চাহিদা মোতাবেক যৌতুক দিতে না পারায় মেয়েকে পাঠিয়ে দেয় বাপের বাড়ি। এতে আরও বেড়ে যায় জটিলতা। সংসার চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে তার পক্ষে। তিনি অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে লাগলেন। ক্ষুধার জ্বালায় অন্যের বাড়িতে কাজ করেও শান্তি নেই, এক বেলা খেতে দিলে অন্য বেলা খেতে দেয় না। শেষ পর্যন্ত ছেলে-মেয়ে নিয়ে নিরুপায় হয়ে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করতে লাগলেন।

Advertisement

ভিক্ষা করতে গিয়েও দুঃখ লাঘব হয় না শামসুন নেহারের। মানুষের অবহেলা আর তিরষ্কার নিয়ে সব সময় চিন্তায় থাকতেন তিনি। এরইমধ্যে ভিক্ষা করা অবস্থায় কাটাগাং গ্রামের অপকার কর্মকর্তা মো. শফির (শিক্ষা সুপারভাইজার) সঙ্গে দেখা হয় তার। জানতে পারেন অপকা কর্তৃক বাস্তবায়িত পল্লি-কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর আর্থিক সহযোগিতায় সমৃদ্ধি কর্মসূচির আওতায় উদ্যোমী সদস্যদের পুনর্বাসন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

পিকেএসএফের’র অনুমোদন সাপেক্ষে এক লাখ টাকার অনুদান পাওয়ার সুযোগ হয় শামসুন নেহারের। এরপর বদলে যায় শামছুন নেহারের জীবনের গল্প।

শামছুন নেহার বলেন, আমার স্বামী অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আমি ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য হই। স্বামীর চিকিৎসা, ৩ ছেলে ও ১ মেয়েকে পড়ালেখা করিয়েছি। কোনো মতে সংসার চলতো। এভাবেই একদিন ভিক্ষা করতে গিয়ে ভালুকিয়া এলাকায় অপকার একজন স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তখন স্যার আমার স্বামী ও ছেলে-মেয়ে সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। আমি সবকিছু বলি এবং এটাও বলি যে আমার ভিক্ষা করতে কষ্ট হয়। তবুও পেটের দায়ে করতে হতো। যদি আপনারা আমাকে একটু সহযোগিতা করেন তাহলে আমি আর ভিক্ষা করবো না।

এর কিছুদিন পর অপকার স্যার আমাকে ১ লাখ টাকা দিয়েছেন। ১ লাখ টাকার মধ্যে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে দুটি গরু কিনে দিয়েছেন। বাকি ৫০ হাজার টাকার ২০ হাজার টাকা দিয়ে একটি দোকান ঘর করে দিয়েছেন। বাকি ৩০ হাজারের মধ্যে ১৫ হাজার করে দুই ভাগে আমার দোকানের জিনিসপত্র তুলে দিয়েছেন। প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও আমার এক ছেলে বেলালকে একটা গরু বিক্রি করে বিদেশে পাঠিয়েছি। আরেকটি গরু বিক্রি করে নাতিনের বিয়ের জন্য দিয়েছি। অপকার কারণে আমি এখন ভালো আছি এবং সম্মানজকভাবে চলাফেরা করছি।

Advertisement

অপকার সমাজ উন্নয়ন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান বলেন, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের ভালুকিয়া গ্রামের একটি সমাজ উন্নয়ন অনুষ্ঠানে দেখা হয় ঘেড়ামারার শামছুন নেহারের সঙ্গে। দেখি তিনি অনেক কষ্ট করে ভিক্ষাবৃত্তি করছেন। তিনি আমাদেরকে জানান, ভিক্ষাবৃত্তি করতে তার ভালো লাগে না, যদি তাকে সহযোগিতা করি তাহলে তিনি ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দেবেন। তখন আমাদের সমাজের অবহেলিতদের একটা প্রজেক্ট ছিল। ওই প্রজেক্ট থেকে তাকে ১ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

অপকার নির্বাহী পরিচালক মো. আলমগীর বলেন, ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে শামছুন নেহার এখন সফল ব্যবসায়ী। দোকান ও গরু পালন থেকে আয় দিয়ে তিনি ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছেন, নাতনির বিয়ে দিয়েছেন। ভিক্ষার মতো ঘৃণিত কাজ করতে এখন অন্যকে নিরুৎসাহিত করেন তিনি। শামছুন নেহার এখন ভিক্ষা করেন না বরং অন্যকে ভিক্ষা দেন। করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন বলেন, ২০১৭ সালে আমিসহ অপকার পক্ষ থেকে শামছুন নেহারের হাতে ১ লাখ টাকা তুলে দিয়েছি। তখন থেকে পাল্টে গেছে তার জীবনচিত্র। এখন তিনি সমাজের অন্যদের মতো স্বাবলম্বী নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

এফএ/এএসএম