দুর্গম পাহাড়ের বাসিন্দাদের কেউ অসুস্থ হলে মাইলের পর মাইল হেঁটে অথবা রোগীকে কাঁধে তুলে নিতে হতো নিকটস্থ হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে। নিকটস্থ হাসপাতাল মানে সেটি অন্তত ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে। দুর্গম সেই পাহাড়ে পায়ে হেঁটে চলাই ছিল যাতায়াতের একমাত্র ব্যবস্থা। তবে পাহাড়ের সে চিত্র বদলে গেছে। এখন আর রোগীকে পায়ে হেঁটে যেতে হয় না বা কাঁধেও তুলতে হয় না। বরং চান্দের গাড়ি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা দিয়ে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে খুব সহজেই চিকিৎসকের কাছে নেওয়া যায়। এতে করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একদিকে যেমন দুর্ভোগ লাঘব হয়েছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন তারা।
Advertisement
পাহাড়ে কথা হয় রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার উদয়পুর গ্রামের তারুম চাকমার সঙ্গে। তারুম বলেন, বছর তিনেক আগের কথা। আমার স্ত্রীর প্রসব বেদনা ওঠে। সে সময় দুই দিকে বাঁশের সঙ্গে কাপড় বেঁধে তার ভেতরে শুইয়ে প্রায় ১০ মাইল হেঁটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ডাক্তারের কাছে। কিন্তু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগেই মারা যায় আমার স্ত্রী। তবে এখন আর কাউকে পায়ে হেঁটে ডাক্তার কিংবা হাসপাতালে যেতে হয় না। খুব সহজেই চান্দের গাড়িতে করে রোগীকে নিয়ে যাওয়া যায়।
তারুম চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, পাহাড়ে এখন দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়েছে। সড়ক ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় খুব সহজেই এক জায়গায় গিয়ে দিনের মধ্যেই আবার ফিরে আসা সম্ভব হচ্ছে। আগে যেখানে পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগতো ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা, সেখানে এখন গাড়িতে সময় লাগছে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট। এছাড়া পাহাড়িদের সবচেয়ে কঠিনতম সময় ছিল রোগী নিয়ে হাসপাতাল কিংবা ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি। এটি এখন সড়ক ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় দ্রুততার সঙ্গে রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে।
আরও পড়ুন>> বান্দরবানে সংকটে থাকা ১০৮ পরিবার পেলো খাদ্য সহায়তা
Advertisement
সরেজমিনে দেখা যায়, উঁচু-নিচু পাহাড়ের গা বেয়ে সরীসৃপের মতো নির্মিত শত শত কিলোমিটারের আঁকা-বাঁকা পিচঢালা মসৃণ পাহাড়ি সড়কগুলো অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। সড়কের পাশাপাশি বড় বড় ব্রিজ-কালভার্ট এক পাহাড়কে আরেক পাহাড়ের সঙ্গে যুক্ত করেছে। দুই-তিন দিনের গন্তব্যে এখন কয়েক ঘণ্টাতেই যাওয়া-আসা করা যায়। পাহাড়ি জনপদের মানুষগুলোর কাছে এটি স্বপ্নের মতো। মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, দেখতে পিকআপের মতো যাত্রীবাহী চান্দের গাড়ি, বাস, মাইক্রোবাস ও জিপ নিয়মিত চলাচল করছে সড়কগুলোতে। পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হওয়ায় বাড়ছে পর্যটকের সংখ্যাও।
এরই মধ্যে খাগড়াছড়ির বেতলিং, রাঙ্গামাটির মাঝিরপাড়া ও সাইচলে পাহাড়ের কোলঘেঁষে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ শেষ হয়েছে। এটিই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উঁচু সড়ক নির্মাণের কীর্তি। এ সড়কের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার ৮০০ ফুট
জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি হিসেবে পরিচিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর বেড়ে যায় উন্নয়নের গতি। ১৯৯৭ সালে চুক্তি সম্পাদনের পর পার্বত্যাঞ্চলকে দেশের মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য সরকার তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। গত ২৬ বছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প কারখানা, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পসহ অনেক খাতেই সরকার নানামুখী উন্নয়ন পদক্ষেপ নেয়।
১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির পর তিন পার্বত্য জেলায় অবকাঠামো খাতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। শান্তিচুক্তির পর থেকে এখন পর্যন্ত তিন পার্বত্যাঞ্চলে পাকা রাস্তা নির্মাণ হয়েছে ১ হাজার ২১২ কিলোমিটার। কাঁচা সড়ক ৭০০ কিলোমিটার, সড়ক সংস্কার ৬১৪ কিলোমিটার ও ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে ৯ হাজার ৮৩৯ মিটার। এছাড়া কালভার্ট হয়েছে ১৪১টি।
Advertisement
তিন পার্বত্য জেলায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শিশুপার্ক, বাস টার্মিনাল, ঈদগাহ, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, ক্যান্টনমেন্ট, বাঁধ, স্টেডিয়াম নির্মাণ, ফুড বেকারি, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পর্যটন কেন্দ্র, সোলার প্যানেল বিতরণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলমান রয়েছে।
আরও পড়ুন>> ভূমিহীন খুঁজতে গ্রামে গ্রামে ছুটছেন ইউএনও
স্থানীয়রা বলছেন, তিন পার্বত্য জেলায় এমন চোখ ধাঁধানো সড়ক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে, স্বপ্নেও ভাবেননি তারা। সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির ফলে এখন তারা অনেক খুশি। চুক্তির কতটুকু কী হলো, সেটি নিয়েও এখন আর তাদের জানার আগ্রহ নেই। তাদের চোখ এখন উন্নয়নের দিকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার যত উন্নতি হবে, তত জীবনমান উন্নত হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার। ২০৩৬ সালের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত প্রথম ধাপে ২০৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ শেষ হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে। পুরো কাজ শেষ হলে এটি হবে দীর্ঘ সড়ক নেটওয়ার্ক। এরই মধ্যে খাগড়াছড়ির বেতলিং, রাঙ্গামাটির মাঝিরপাড়া ও সাইচলে পাহাড়ের কোলঘেঁষে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ শেষ হয়েছে। এটিই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উঁচু সড়ক নির্মাণের কীর্তি।
দুই-তিন দিনের গন্তব্যে এখন কয়েক ঘণ্টাতেই যাওয়া-আসা করা যায়। পাহাড়ি জনপদের মানুষগুলোর কাছে এটি স্বপ্নের মতো। মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, দেখতে পিকআপের মতো যাত্রীবাহী চান্দের গাড়ি, বাস, মাইক্রোবাস ও জিপ নিয়মিত চলাচল করছে সড়কগুলোতে
এ সড়কের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার ৮০০ ফুট। এর আগে দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক ছিল বান্দরবানে পাহাড়ের ওপর দিয়ে নির্মিত থানচি-আলীকদম সড়কটি। সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় আড়াই হাজার ফুট ওপরে। ২০১৫ সালে নির্মিত হয়েছিল সড়কটি।
আরও পড়ুন>> রাজনৈতিক অস্থিরতায় পর্যটকশূন্য রাঙ্গামাটি
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীনে ২০, ২৬ ও ১৭ ইসিবি সীমান্ত সড়ক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ফেনী সংলগ্ন খাগড়াছড়ির রামগড় থেকে শুরু হয়ে বান্দরবানের আলীকদমের পোয়ামুহুরিতে গিয়ে শেষ হবে সড়কটি। পুরো রাস্তাটি সীমান্ত সংলগ্ন পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নির্মিত হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা থিয়াং ত্রিপুরা জাগো নিউজকে বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এ এলাকার মানুষ পাহাড়ের ফলমূল, শাকসবজি শহরে পাঠাতে পারে সহজে। আগে কেউ অসুস্থ হলে রাস্তার কারণে কোথাও নেওয়া যেত না। দুর্গম এলাকার মানুষের কষ্টের শেষ ছিল না। কিন্তু রাস্তা করে দেওয়ায় তাদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। বেশ কয়েকটি দুর্গম এলাকায় বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গেছে।
পার্বত্যাঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, দুর্গম পাহাড় আর দুর্গম থাকছে না। সীমান্তের এপার-ওপারকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। বর্ডার আউট পোস্টে (বিওপি) দায়িত্বরত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত এ সড়ক ব্যবহার করে টহল জোরদার করতে পারবেন। এ করে পর্যটকরা যাতায়াত করবেন নির্ভয়ে। ফলে ঘটবে অর্থনৈতিক বিপ্লব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ এই সড়ক পার্বত্য জেলাগুলোর সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাবে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, সীমান্ত এলাকার কৃষিপণ্য দেশের মূল ভূখণ্ডে পরিবহনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। বিশেষ করে অদূর ভবিষ্যতে ভারতের মিজোরাম-ত্রিপুরা এবং মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের সঙ্গে সড়ক নেওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার পথ প্রশস্ত করবে এটি।
যে জায়গায় আগে নৌপথে যেতে দিন ফুরিয়ে যেত, সেখানে এখন সড়ক পথে দুই-তিন ঘণ্টায় যাওয়া-আসা করা যায়। এমন উন্নত সড়ক ব্যবস্থা হবে তারা স্বপ্নেও ভাবেননি। এছাড়াও পাহাড়ে কৃষি সম্ভাবনার কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে।
গবেষণার কাজে পার্বত্য অঞ্চল পরিদর্শন করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম ডি আব্দুর রহিম জাগো নিউজকে বলেন, যে জায়গায় আগে নৌপথে যেতে দিন ফুরিয়ে যেত, সেখানে এখন সড়ক পথে দুই-তিন ঘণ্টায় যাওয়া-আসা করা যায়। এমন উন্নত সড়ক ব্যবস্থা হবে তারা স্বপ্নেও ভাবেননি। এছাড়াও পাহাড়ে কৃষি সম্ভাবনার কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। যার ফলে স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালিদের কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, তেমন স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক পরিবর্তনও ঘটবে।
সীমান্ত সড়কের প্রকল্প কর্মকর্তা মেজর এইচ এম ইকরামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, দুর্গম পাহাড়ে সড়ক নির্মাণ ছিল চ্যালেঞ্জিং। সেটি এখন বাস্তবায়নের পথে। সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে গহীন পাহাড়ের অরক্ষিত এলাকাও পুরোপুরি নজরদারির মধ্যে চলে আসবে। বিস্তৃত এলাকার নিরাপত্তাসহ পর্যটন শিল্প বিকাশের পথ প্রশস্ত হবে। বেতলিং, মাঝিরপাড়া ও সাইচলে দেশের সবচেয়ে উঁচু সড়কের রেকর্ড তৈরি হয়েছে।
জানতে চাইলে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, শান্তিচুক্তি সম্পাদনের ফলে পার্বত্যাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক উন্নত সাধিত হয়। সেই সঙ্গে পর্যটন শিল্প ও স্থানীয় মানুষের জনজীবনে গতিসঞ্চার হয়। পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বিরাজ করে। যার ফলে উন্নয়ন তরান্বিত হচ্ছে। এছাড়া সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে। তারা এখন নির্দ্বিধায় ব্যবাসা-বাণিজ্য করতে পারছেন। অন্যদিকে পার্বত্যাঞ্চলে বেড়েছে পর্যটকের সংখ্যাও।
টিটি/এমএইচআর/এমএস