প্রবাস

কে প্রথম প্রেমে পড়লো?

অমিয় দাশ, যুক্তরাষ্ট্র

Advertisement

না, ও আমার থেকে এক বছরের সিনিয়র। অন্য বিভাগে পড়তো। বাঁধন আবার বলতে শুরু করলো, ‘এভাবে বেশ কিছুদিন ফেসবুকে কথোপকথন হওয়ার পর, সজীব আমাকে একদিন সরাসরি ফেসবুকে মেসেজ করলো প্রাইভেটলি। কয়েকদিন পর আমি জবাব দিলাম। এভাবে আবার বেশ কিছুদিন চললো।’

‘ছেলেটাকে আমারও বেশ ভালো লাগতে শুরু করলো একজন বন্ধু হিসেবে। হঠাৎ করেই একদিন ও আমাকে কফি খাওয়ার দওয়াত করলো। আমরা বনানীর একটি কফি হাউসে দেখা করলাম। অনেক কথা হলো, হাসি- ঠাট্টার মাঝে আমাদের প্রথম সামনাসামনি সাক্ষাৎ শেষ হলো। কিন্তু তার রেশ রয়ে গেলো আমার মাঝে। মনে হচ্ছিল আমি কি এতদিন এমনি কারো অপেক্ষাতে ছিলাম?’

‘তাই কি? এ রকম কাউকে কি তুমি মনে মনে কল্পনা করতে?’ অংশু সিরিয়াস হয়ে প্রশ্ন করলো।‘না, তা ঠিক না’।‘তাহলে?’

Advertisement

‘আমার লম্বা, ফর্সা ছেলেদের ভালো লাগে। তবে লম্বা ভুড়িওয়ালা লম্বা ছেলে না।’বলে একটু মুচকি হাসলো।

‘সজীব লম্বা হলেও গায়ের রঙ বাঙালি স্ট্যান্ডার্ড রঙ এর চেয়ে একটু চাপা। কিন্তু শ্যামলা মুখে হাসলে ওকে দারুণ স্মার্ট ও চকচকে মনে হয়। মাথায় কোকড়া চুল সুন্দর করে কাটা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাত দিয়ে দাঁড়িগুলো নাড়তে নাড়তে ও যখন কথা বলে, আমার মুখে সুড়সুড়ির মতো একটা কিছু অনুভূতি হতো’।

‘তার মানে তুমি তখন তার মুখে হাত বুলিয়েছ?’‘না না, কি বলেন?’ বলেই লাজুক ভঙ্গীতে হাত দিয়ে মুখ ঢাকলো। এরপর আবার কথা বলা শুরু করলো।‘এভাবেই আমাদের প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিন সহ সপ্তাহে দু-তিন দিন দেখা হতো। কখনো চায়ের দোকানে, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। তার পর মনের অজান্তেই একে অন্যকে ভালোবেসে ফেলেছি’।

‘কে প্রথম প্রেমে পড়লো?’‘সজীবই প্রথম আমাকে প্রস্তাব দেয়। যদিও আমরা দুজনই জানতাম যে এখানে প্রত্যাখ্যানের আর কোনো অবকাশ নেই’।অংশু মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাঁধনের মিষ্টি প্রেমের কথা শুনছিল। মনের অজান্তেই ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘বাঃ, সুন্দর একটা তারুণ্যের আর প্রেমের উপখ্যান শুনছি’। বলেই আরো শোনার আশায় চুপ করে গেলো।

Advertisement

‘হ্যাঁ, এভাবে আমাদের নয় মাস এ রকম চললো। তারপর একবার আমার বাড়ির সবাই কোনো এক কাজে গ্রামের বাড়িতে গেলে আমি সজীবকে আমাদের বাড়িতে দেখা করতে আসতে বলি। আমরা দুজন ভীষণ ভয়ে ভয়ে একে অন্যের সাথে একান্তে দেখা করি। এ রকম একটু সুযোগ পেলেই সজীব আর আমি আমাদের বাড়িতে দেখা করতাম। ক্রমাগতভাবে আমরা অনেক ঘনিষ্ঠ হলাম’।

একটু থামলো বাঁধন, যেন কোনো এক জড়তা তাকে গ্রাস করতে আসছে। অংশু কোনো কথা বললো না। যতটুকু তার বোধগম্য হলো তা বুঝে নিলো।

তৃতীয় পর্ব পড়ুন এখানে 

বাঁধন বলতে থাকলো, ‘তারপর সজীব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হলো ও একটি বীমা কোম্পানিতে চাকরি পেলো। চাকরির সুবাদে ঢাকার বাইরে পোস্টিং হলো। আমার সব কিছু কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। এরপর থেকে শুধু ছুটির দিনে ও ঢাকা আসতো। ঢাকা এলেই আমরা দুজনে রেস্টুরেন্টে খেতাম, কফি হাউসে কফি খেতাম, অনেক কথা অনেক গল্প করতাম, খুনসুটি করতাম।

‘অকারণে, উদ্দেশ্যহীনভাবে রিকশায় চড়ে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াতাম। ওর যেহেতু আর কোথাও থাকার ব্যবস্থা ছিল না, তাই আমরা এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে একান্ত সময় কাটাতাম’।

এভাবে আমাদের অনেক ভালোবাসা আর আনন্দে আরো বছর খানেক কাটলো।‘কিন্তু সমস্যাটা হলো কোথায়? সবইতো ঠিক আছে বা ছিল’।অংশু ফুট কাটলো।

‘একদিন আমি সজীবকে ফোন করলাম। ওপাশ থেকে, কোনো জবাব এলো না। কয়েক মিনিট পরে আবার ফোন করলাম। এবার দুটো রিং হবার পরে একজন নারীর গলা শুনলাম।

‘হ্যাঁলো কে বলছেন? আমি একটু ভড়কে গেলাম। বললাম-আমি বাঁধন, সজীবের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। বলেই আমি ইতস্তত করলাম’।

‘বাঁধন? বাঁধন নামে কোনো বান্ধবীর কথাতো সজীব কখনও বলেনি। আমি সজীবের মা। কিছু বলতে হবে?’ রাগতঃ স্বরে সজীবের মা বললেন।

‘সজীবের সাথে একটু দরকার ছিল’। ‘সজীব এখন গোসল করছে। বাথরুম থেকে বের হলে তোমার কথা বলবো। বলেই সজীবের মা ফোনের লাইনটা কেটে দিলেন’।‘তারপর?’ অংশু বাঁধনকে জিজ্ঞেস করলো।

‘তারপর সজীব পরেরদিন কল ব্যাক করলো। অনেক রাগারাগি তারপর গালিগালাজ করলো।খুব মন খারাপের স্বরে বাঁধন বলে চললো, কেনো ফোন করেছিলাম, মা যখন ফোন তুললো তখন লাইন কেটে দিলাম না কেনো বলে চিৎকার চেচামেচি শুরু করলো। ওইদিন আমি অনেক কাঁদলাম। রাতে মনটা আর মানছিল না। আমি আবার ফোন করলাম, কিন্তু সজীব আমাকে ফোনে, ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে ইত্যাদি সব জায়গায় ব্লক করে দিয়েছে।

এভাবে প্রতিদিন সজীবকে ফোন করে কথা বলার চেষ্টা করতাম। সপ্তাখানেক পরে ও আমাকে ফোন করে আবার অনেক বকাঝকা করলো। আর যেন কখনো ফোন না করি তাই বলে শাশালো। তারপর ছয় মাস আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ ছিলো না।

এই গত ছমাসে ওর মা ওকে বিয়ে দিয়েছে। আর ও সেটা মেনে নিয়ে বিয়ে করেছে। আর ওই বিয়েটা একুশ দিন টিকেছে’।‘তুমি কীভাবে জানলে?’ অংশু বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করলো।

‘একদিন একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো। আমি ভাবলাম কে না কে তাই ফোন ধরিনি। আবার কিছুক্ষণ পরে ফোন এলো। কৌতূহল বশতঃ ফোন ধরলাম। ওপাশ থেকে সজীব ফোন করেছে। সে জেলখানার জেল অফিসের ফোন থেকে কথা বলছে আমাকে খুব অনুনয় করে বললো যে সে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে অনুমতি পেয়েছে ফোন করার জন্য। আমি যেন লাইন কেটে না দেই’।

‘জেল থেকে ফোন করেছ কেন?’‘কারণ, সজীব তখন জেল খাটছে’।‘মানে কি?’

অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে অংশু প্রশ্ন করলো। তার কাছে সবই যেন অবিশ্বাস্য, বানানো একটি গল্পের প্লট মনে হলো। এতসব ব্যাপার অংশুর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল।

নীরবতা ভেঙে পানি গ্লাসের মধ্যে পানি নাড়াতে নাড়াতে বাঁধন বললো, ‘সজীবের নতুন বউ একুশ দিন এর মাথায় বাপের বাড়ি চলে গেছে। শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মামলা করেছে থানায়। আর ১০ লাখ টাকা দাবি করছে ক্ষতিপূরণ বাবদ’।

অংশু নড়েচড়ে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই মুহূর্তে তার নিজের বিয়ে করার ইচ্ছা বা শেরওয়ানি, পাগড়ি, ইত্যাদি কেনার আকাঙ্ক্ষা এক্কেবারে গরম কড়াইয়ে একফোটা পানির মতো ফুস্ করে উড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। নিজের কানকেও তার বিশ্বাস হচ্ছে না। তারপরেও বাঁধনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওদের কি ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে?’

‘না মামলা চলছে। তিনমাস জেল খেটে সজীব জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছে’।‘সেই বউয়ের কোনো পরিচয়, নাম-ধাম তুমি জানো?’

‘না। তবে শুনেছি সেই মেয়েটা আমার থেকে লম্বা ছিল। মালয়েশিয়া থেকে কি যেন একটা ডিপ্লোমা করে এসেছে ম্যাসাজ থেরাপীর ওপর’।

‘ইন্টারেস্টিং’।বলেই অংশু ঠোট কুঁচকে চোখ বন্ধ করে মাথাটা ডানে-বায়েঁ ঝাঁকালো।‘ইন্টারেস্টিং কেন?’

‘দ্যাখো, এক বিংশ শতকের এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সময়ে একটা চাকরিজীবী যুবককে মা বিয়ে দিয়ে বেঁধে দিয়ে দিলো। আর সেও চোখ বুজে নিরূপায় হয়ে নিঃশব্দে বিয়ে করে ফেললো। কেন জানি এটা ঠিক মিলছে না’।‘আমাকে সজীব তাই বলেছে’।

চলবে...

লেখক: অমিয় দাশ, ফার্মাসিস্ট, ওষুধ প্রস্তুতকারক। বোকা রেতন, যুক্তরাষ্ট্রamio7@yahoo.com

এমআরএম/জিকেএস