দেশজুড়ে

পরিবারের ১৩ সদস্য জন্মান্ধ, বাউল গানই তাদের বেঁচে থাকার সম্বল

জন্ম থেকে অন্ধ হওয়ার অজানা এক ব্যাধি বয়ে বেড়াচ্ছেন মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার একটি পরিবারের সদস্যরা। পাঁচ প্রজন্ম ধরে উপজেলার আউটশাহী ইউনিয়নের মামাদুল গ্রামের মৃত বক্তার ফকিরের পরিবারের অধিকাংশ সদস্য জন্ম নিয়েছেন অন্ধ হয়ে। তালিকায় যেমন আছেন পরিবারের প্রবীণরা, তেমনি আছেন নবীন সদস্যরাও।

Advertisement

তবে নানা প্রতিবন্ধকতায় তাদের জীবন কাটলেও দমে জাননি কেউ। রপ্ত করেছেন ভিন্ন এক প্রতিভা। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সদস্যদের কেউ পারেন বাউল গান গাইতে, আবার কেউ বাজাতে পারেন বাদ্যযন্ত্র। বাউল গানই তাদের জীবিকার একমাত্র মাধ্যম। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে কোনোমতে জীবনযাপন করা পরিবারের সদস্যদের দাবি একটু সহযোগিতা।

সরজমিনে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে দরাজকণ্ঠে গান গেয়ে চলেছেন নজরুল ইসলাম। স্থানীয়দের কাছে যিনি পরিচিত নজরুল বাউল নামে। তার সঙ্গে আছেন বংশের ছোট বড় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ১০ সদস্য। নজরুল যখন গান করছেন তার সঙ্গে নিপুণ হাতে তাল মিলিয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন বাকিরা। সঙ্গে ছোট শিশুরা শিখছে গানের সুর। পৃথিবীর রঙ দেখতে না পারলেও যেন সঙ্গীতের ভবনে তাদের আলোকিত ছুটে চলা।

স্থানীয়রা জানান, পরিবারটির সদস্যদের জন্মান্ধ হওয়ার সূত্রপাত হয় বহু আগে। প্রায় দেড়শ বছরেরও বেশি আগে মামাদুল গ্রামে বাস করতেন বক্তার ফকির নামে এক ব্যক্তি। তিনি অন্ধ ছিলেন। বিয়েও করেন এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়েকে। বক্তার বাউল গান রপ্ত করেন। তাদের ছেলে খোদাবক্স ফকির জন্ম নেন অন্ধ হয়ে। তার স্ত্রী আকলিমা বেগমও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন। তারাও বাউল শিল্পী ছিলেন।

Advertisement

খোদাবক্স ও আকলিমার ছেলে কাদের ফকিরও জন্ম থেকে অন্ধ। প্রায় ৮০ বছর আগে ১২০ বছর বয়সে মারা গেছেন তিনি। মৃত্যুর সময় কাদের ফকির চার ছেলে রেখে যান। তারা হলেন- জাফর আলী, মারফত আলী, সবুজ আলী ও কুদরত আলী। এদের মধ্যে মারফত আলী অন্ধ ছিলেন। তার মৃত্যুকালে চার ছেলে ও চার মেয়ে রেখে যান। এদের মধ্যে পাঁচজন সুস্থ হলেও ছেলে আমির হোসেন বয়াতি, নজরুল ইসলাম বাউল (৫০) ও মেয়ে নাসিমা বেগম (৫০) অন্ধ হয়ে জন্ম নিয়েছেন।

আমির হোসেন বয়াতি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। তিনিও ভালো গান করতেন। কয়েক মাস আগে মারা যান। তার ঘরে তিন ছেলে সেন্টু (৪০), মিন্টু (৩৫) ও হৃদয় (৩২) এবং এক মেয়ে হাসিনা (৪০)। তারা চারজনই অন্ধ। এদের মধ্যে সেন্টু বাউলের এক ছেলে আব্দুর রহমান (৫), মিন্টুর মেয়ে মধুমালা (৪), হৃদয়ের ছেলে সোয়াদ (৩) ও হাসিনার ছেলে রিয়াদ (১৪) চোখে দেখে না। অগ্রজদের সঙ্গে গানের আসরে বসেন তারা।

আমির বয়াতির ভাই ভাই নজরুল বাউলের চার মেয়ের মধ্যে বড়জন সুবর্না (২৫) অন্ধ। তার মেয়ে ফাতিহাও (২) অন্ধ হয়ে জন্ম নেয়। আমির বয়াতির বোন নাসিমা বেগমেরও এক ছেলে জোয়াদ (১২) অন্ধ।

নজরুল ইসলাম বাউল বলেন, বহু চিকিৎসার চেষ্টা করেছি। ভারতেও গিয়েছিলাম। কিন্তু কাজ হয়নি। তাই আশা ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের তো পাঠশালার শিক্ষা নাই, অন্ধ মানুষ কী করে চলুম। বাপ-দাদার কাছ থেকে গান শিখেছি। পালা-গান, বাউল-বিচার গান করি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, গানের আসরে গান করে দিন চলে। পাঁচ প্রজন্ম ধরে এভাবেই চলছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানরাও এমন হচ্ছে। গানের সময় সন্তানদের আমাদের সঙ্গে রাখি, যেন তারাও গান শিখতে পারে।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, দিন দিন তো বাউল গান, পালা গানে কদর কমছে। আমাদেরও চাহিদা কমছে। করোনার সময় অনেক কষ্টে দিন কাটছে। সামান্য কিছু প্রতিবন্ধী ভাতা পাই। এ দিয়ে ছেলে সন্তানদের নিয়ে কোনোমতে দিন চলা। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা মনে করেন আমরা বড়লোক। গান গেয়ে অনেক টাকা পাই। তাই সব সুযোগ আমাদের দেওয়া হয় না। আমাদের একটু সহযোগিতা করলে একটা সংস্থা বা স্কুলের মতো করে পুরানো দিনের বাউল গানের চর্চার জায়গা করতাম। এতে গানের সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মের কাছেও টিকে থাকতো।

গৃহবধূ জান্নাত বলেন, ওর বাবা অন্ধ, আমার ছেলেও অন্ধ হয়েছে। কী চিকিৎসা করাবো এটা জানি না। আর আমাদের তো সামর্থ্যই নেই চিকিৎসা করানোর। সরকার যদি একটু এগিয়ে আসতো হয়তো চেষ্টা করা যেত।

অন্ধ শিল্পী সেন্টু বলেন, আমরা তো দেখি না, শুনে শুনে গান মুখস্থ করা লাগে। আর বাদ্যযন্ত্রগুলো হাতে দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, আমরা অনুভব করে সেগুলো বাজাতে পারি। বহু গান মুখস্থ আছে, এগুলো আমরা পরের যারা আছে তাদেরও মুখে মুখে বলে শিখিয়ে দেই। বর্তমানে ১৩ জন সদস্য অন্ধ আছে। এর আগে আরও সাত সদস্য অন্ধ হয়ে মারা গেছেন।

স্থানীয় মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, দরিদ্র অন্ধ ব্যক্তিদের অনেককে ভিক্ষাবৃত্তি করতে দেখা যায়। তবে ছোটবেলা থেকেই দেখছি নজরুল বাউলের পরিবারের সবাই কর্ম করে খান। বিষয়টি আমাদের ভালো লাগে। তারা গান-বাজনা করলে আমরা শুনতে আসি। দূর-দূরান্তে তাদের দাওয়াত করেও নেওয়া হয়। তবে অনেক সময় অর্থ সংকটে খুব কষ্টে তাদের দিন কাটে। সমাজের বিত্তবানদের উচিত কিছুটা সহযোগিতা করা।

এক পরিবারে এতো সদস্য জন্মান্ধ হওয়ার বিষয়ে চক্ষু ও মাথা ব্যথা রোগ চিকিৎসক ডা. মো. জাবের হাসান জাগো নিউজকে বলেন, সাধারণত বাবা-মা কারো মধ্যে রোগ থাকলে সেটি সন্তানদের মধ্যে প্রবাহিত হতে পারে। পরিবারটির যেহেতু বংশ পরম্পরায় রোগটি আছে, তাই বলা যায় এটি জেনেটিক সমস্যা। পৃথিবীতে জেনেটিক বা জন্মগত অধিকাংশ রোগেই প্রতিকার আবিষ্কৃত হয়নি। তবে ডিএনএ মডিফিকেশন অথবা থেরাপির মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পারে পরবর্তী প্রজন্মের সুস্থতা। সেটি নিয়ে কাজ করতে হবে, চোখের রেটিনা কিংবা অন্য কোথায় তাদের সমস্যা দেখতে হবে।

জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ফয়জুল বারি জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা আছে। পরিবারটির বিষয়ে খোঁজ নিয়েছি। তাদের ১৩ জনের মধ্যে ১০জন ভাতা পান। বাকি তিনজন এখনো প্রতিবন্ধী শনাক্ত জরিপের আওতায় আসতে পারেননি। আওতায় এলে তাদেরও ভাতার ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যায় ভুগছে। আমাদের পক্ষ থেকে তাদের বিশেষ সহযোগিতার ব্যবস্থা থাকবে।

এসজে/এএসএম