স্বাস্থ্য

৪ চিকিৎসক আউটডোরে দেখেন ৮ শতাধিক রোগী, অপ্রতুল শয্যা

# প্রতিদিন গড়ে ১৫টি অস্ত্রোপচার # নাক, কান ও গলার এই বিশেষায়িত হাসপাতালে শয্যা মাত্র ১৩৫টি# চারজন চিকিৎসক প্রতিদিন আউটডোরে রোগী দেখেন ৮শ থেকে এক হাজার

Advertisement

শীত মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া অনেকটা আরামদায়ক হলেও অস্বস্তি ঠান্ডাজনিত রোগ নিয়ে। এসময় প্রকোপ বাড়ে ঠান্ডাজনিত নানান রোগের। সাইনোসাইটিস বা অ্যালার্জিজনিত কোনো অসুস্থতা থাকলে এসময় তা প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে শীতের এ সময় নাক, কান ও গলার নানান অসুস্থতা নিয়ে আসা রোগী বাড়ে হাসপাতালে।

রাজধানীর জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ রোগী আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসছেন। আউটডোরে মাত্র চারজন চিকিৎসক বিপুল এ সংখ্যক রোগীর সেবা দিচ্ছেন। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এই পাঁচ ঘণ্টায় এত রোগী মাত্র চারজন চিকিৎসক সেবা দিয়ে থাকেন। ফলে দেখা যাচ্ছে একজন চিকিৎসক একজন রোগী দেখতে সময় পাচ্ছেন এক থেকে দেড় মিনিট। এছাড়া বিশেষায়িত এই হাসপাতালে রয়েছে শয্যা সংকট। ফলে জটিল রোগের চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে রোগীদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়।

আরও পড়ুন: টানা অবরোধে ঢাকায় কমেছে বাইরের রোগী

Advertisement

গত মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল ৮টা থেকেই রোগীদের ভিড়। হাসপাতালের প্রধান ফটকের বাম পাশে থাকা টিকিট কাউন্টারে রোগী বা রোগীর স্বজনরা টিকিট নিতে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। এর পাশেই চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে থাকা আসনগুলোতে গাদাগাদি করে বসে ছিলেন অনেক রোগী। আবার অনেকেই বসার আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

চিকিৎসকরা জানান, দেশের বিশাল জনসংখ্যার নাক, কান ও গলার চিকিৎসায় এই একটিমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল। তবে এত বিশাল জনসংখ্যার বিপরীতে এখানে শয্যা সংখ্যা মাত্র ১৩৫টি, যা নিতান্তই অপ্রতুল।

জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ রোগী আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসছেন। আউটডোরে মাত্র চারজন চিকিৎসক বিপুল এ সংখ্যক রোগীর সেবা দিচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে একজন চিকিৎসক একজন রোগী দেখতে সময় পাচ্ছেন মাত্র এক থেকে দেড় মিনিট।

হাসপাতালের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, গত মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে আউটডোরে চিকিৎসা নিতে টিকিট কাটেন ৫৭৭ জন। এছাড়া ওই সময় হাসপাতালের ৩ নম্বর কক্ষে নানান ধরনের টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন অনেকেই। মূলত এসব রোগীর অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। হাসপাতালে বেড খালি না থাকায় অস্ত্রোপচারের তারিখ নিতে অপেক্ষা করছিলেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।

Advertisement

আরও পড়ুন: যেভাবে মিলবে বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের সেবা

এসব বিষয়ে কথা হয় হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাকারিয়া সরকারের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে, এদেশের যে চাহিদা তা (একটি হাসপাতাল থেকে) পূরণ করা সহজ নয়। আউটডোরে চারজন চিকিৎসক বসেন, কিন্তু প্রতিদিন তাদের দেখতে হয় প্রায় এক হাজার রোগী। তার মানে একজন চিকিৎসককে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত প্রায় আড়াইশ রোগী দেখতে হয়। এটাও আমাদের সম্ভব করতে হচ্ছে। অনেক রোগী দূর থেকে আসেন, তাদের তো আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি না।’

হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, এখানে আউটডোরের রোগীই বেশি। এসব রোগীর বিশাল একটা অংশকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ে না। ওষুধেই সেরে যায়। তবে যাদের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়, তারাই হাসপাতালে ভর্তি হন।

মাদারীপুর থেকে এসেছেন পারভেজ হোসেন। তার মা পারভিন বেগমের (৪০) নাকে মাংস বেড়ে যাওয়ায় এই ঠান্ডায় সর্দি ও হাঁচি-কাশির সমস্যা বেড়ে গেছে। মায়ের চিকিৎসায় কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। এরপর প্রতিবেশীর পরামর্শে আসেন জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে। এখানে প্রথমে আউটডোরে ১০ টাকার টিকিট নিয়ে চিকিৎসক দেখিয়েছেন। এখন অপেক্ষায় আছেন অস্ত্রোপচারের তারিখের।

জাগো নিউজকে পারভীন বেগম বলেন, ‘হাসপাতালের চিকিৎসক জানিয়েছেন নাকে সমস্যা হয়েছে, এখন অস্ত্রোপচার করতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই। আরও কিছু টেস্ট বাকি আছে, সেগুলো করা হলে তারপর অস্ত্রোপচারের তারিখ দেবে। হাসপাতালে বেড খালি নেই বলে ভর্তি হতে পারছি না।’

আরও পড়ুন: গবেষণা করে ডেঙ্গুর টিকা তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে বিএসএমএমইউ

হাসপাতালের তিন তলায় অপারেশন থিয়েটারের বাইরে বেঞ্চে চিন্তিত মুখ নিয়ে বসে ছিলেন রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা। এদের একজন রোমান। অক্টোবরের শুরুতে চিকিৎসার জন্য খালাকে (৩৫) নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। তখন হাসপাতালে শয্যা খালি না থাকায় পরে আসার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। তবে এখন অসুস্থতা বাড়ায় আবার এসেছেন। এবার আসলে তিনদিন পর অস্ত্রোপচারের তারিখ দেওয়া হয়। এরপরও শয্যা খালি না থাকায় অনেক চেষ্টায় হাসপাতালে ভর্তি করেন খালাকে। পরে মঙ্গলবার সকালে তার অস্ত্রোপচার হয়।

এখানে আউটডোরের রোগীই বেশি। এসব রোগীর বিশাল একটা অংশকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ে না। ওষুধেই সেরে যায়। তবে যাদের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়, তারাই হাসপাতালে ভর্তি হন।

হাসপাতালের ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম তলার বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, সব ওয়ার্ডই রোগীতে পরিপূর্ণ। কোনো শয্যা ফাঁকা নেই। চিকিৎসা শেষে কোনো রোগী চলে যেতে না যেতেই সেখানে ভর্তি হন নতুন কেউ।

হাসপাতালের ষষ্ঠ তলায় ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা নার্স (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, এই তলায় ৪৪টি শয্যা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ফ্রি বেড (বিনামূল্যের শয্যা) ৩৬টি, পেয়িং বেড ৪টি ও কেবিন ৪টি। সব বেডেই এখন রোগী ভর্তি।

সপ্তম তলায়ও দেখা যায় একই চিত্র। সব শয্যাই রোগীতে পরিপূর্ণ। এখানে ৪৪টি শয্যার মধ্যে ২১টি বিনামূল্যে, ১৭টি পেয়িং, কেবিন ২টি ও ৪টি বেড কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্টের (শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের কানে শোনা এবং কথা বলার সর্বাধুনিক চিকিৎসা) জন্য।

অধ্যাপক ডা. মো. জাকারিয়া সরকার বলেন, ‘২০১৩ সালের ১৯ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই হাসপাতাল উদ্বোধন করেন। এরপর আমরা ১০ বছর পার করেছি। প্রধানমন্ত্রী সেসময় বলেছিলেন এই হাসপাতালকে তিনি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল হিসেবে দেখতে চান। সেই থেকে আমরা ওই নির্দেশনা আদেশ মনে করে এই ১০ বছরে এই হাসপাতালকে সারাদেশের মানুষের অন্যতম ভরসাস্থলে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি।’

আরও পড়ুন: ‘শিশু হাসপাতাল সরকারি হলেও খরচ বেসরকারির মতোই’

তিনি বলেন, ‘এই হাসপাতালের নিচতলা থেকে ৮ম তলা পর্যন্ত রোগীতে পরিপূর্ণ। প্রতিদিন ৮০০ থেকে এক হাজার রোগী আউটডোরে দেখতে হয়। এছাড়া অনেক রোগী ভর্তির জন্য অপেক্ষায় থাকেন। তবে এখানে শুধু সাধারণ রোগী আসেন এমন নয়। সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নাক, কান, গলার যেসব রোগীর চিকিৎসা সম্ভব হয় না- সেসব রোগী এই হাসপাতালে রেফার করা হয়। জটিল ও চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ- এমন রোগী এই হাসপাতালে রেফার হচ্ছে। আর এসব রোগীর চিকিৎসা এখানে না করতে পারলে দেশের অন্য কোথাও এই রোগীর চিকিৎসা সম্ভব হবে না। এসব রোগীর চিকিৎসার সক্ষমতা আমাদের আছে।’

‘জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে চিকিৎসার পাশাপাশি পাঠদানও চালু আছে। এমএস কোর্স, এফসিপিএস কোর্স চালু আছে এখানে। এছাড়া সরকার আমাদের সুনজরে রেখেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয় থেকেও রোগীদের এখানে পাঠান।’

হাসপাতালের পরিচালক আরও বলেন, ‘আগে দৈনিক ৫টা অস্ত্রোপচার হতো। তখন অ্যানেসথেসিস্ট ছিলেন তিনজন। বর্তমানে এখানে অ্যানেসথেসিস্ট ১০ জন। ফলে আগে যে সংখ্যক অস্ত্রোপচার হতো এখন তা অনেক বেড়েছে। একসময় বৃহস্পতিবার অস্ত্রোপচার বন্ধ থাকতো, এখন সেদিনও হচ্ছে। আগে প্রতিদিন ৩টা অস্ত্রোপচার টেবিল রেডি হতো, এখন ৬টা টেবিল থাকে। আমাদের চিকিৎসকরাও অনেক কাজ করছেন। প্রতিদিন ২টা ইউনিট ৪টা টেবিলে কাজ করে। এখন প্রতিদিন গড়ে ১৫টার মতো অস্ত্রোপচার হয় এখানে।’

এএএম/কেএসআর/জেআইএম