ফিচার

দৃষ্টিহীন তরিকুলের বিস্ময়কর সাফল্য

তরিকুল ইসলাম নাজিম। নারায়ণগঞ্জের বন্দরে জন্ম নেওয়া দৃষ্টিহীন এক মেধাবী বালক। গতকাল প্রকাশিত উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলে মানবিক বিভাগ থেকে ৪.৯২ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তবে দৃষ্টিহীন তরিকুলের চলার পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। পাড় করেছেন নানা প্রতিকূল পরিবেশ।

Advertisement

শৈশবে মায়ের থেকে লুকিয়ে গিয়েছেন স্কুলে, সেখানেও বাধে বিপত্তি। পড়েছেন ব্রেইল বই। তারপর নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেড়িয়ে স্বপ্ন দেখছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির। জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি তার জীবনের চড়াই-উতরাই, বাধা-বিপত্তি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মামুনূর রহমান হৃদয়।

জাগো নিউজ: জন্ম থেকে দৃষ্টিহীন তবুও পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক কীভাবে এলো?তরিকুল ইসলাম নাজিম: আমি ছোটবেলায় মক্তবে পড়েছি, স্থানীয় গণশিক্ষায় পড়েছি তখন থেকেই পড়াশোনার প্রতি একটা ঝোঁক ছিল। এমনও হয়েছে আমি মায়ের থেকে লুকিয়ে কুড়িপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে চলে যেতাম। তখন ওরা বলতো কীভাবে পড়াব ওকে, তখন মা স্কুল থেকে আমাকে নিয়ে আসে। তারপর স্থানীয় মাদরাসায়ও পড়েছি। এরপর আমার বাবা একজনের মাধ্যমে জানতে পারে বরিশালে একটা স্কুল আছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। সেখান থেকেই মূলত আমার যাত্রা শুরু। এর এক বছর পর রাজধানীর মিরপুরে ‘ব্লাইন্ড এডুকেশন অ্যান্ড রিহেবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনে (বার্ডো)’ ভর্তি হই। আর সেখান থেকেই পিএসসি শেষ করি।

আরও পড়ুন: অন্যের বিরুদ্ধে মামলা করেই আয় করেন কোটি টাকা

Advertisement

জাগো নিউজ: মাধ্যমিক জয়ের গল্পটা শুনতে চাই।তরিকুল ইসলাম নাজিম: পিএসসি শেষে আমি গাজীপুরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত, সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত; নীলেরপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ভর্তি হই। এখানের একটা সুবিধা হলো সরকার ব্রেইল বই দেয়। এছাড়া দশজন করে দৃষ্টিহীনকে থাকা-খাওয়ার খরচও সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। তাই আমি সুযোগটি কাজে লাগাই। আর এখান থেকেই মানবিক বিভাগে ৪.৩৯ পয়েন্ট পেয়ে মাধ্যমিক শেষ করি।

জাগো নিউজ: উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনার কেমন পরিবেশ পেয়েছেন?তরিকুল ইসলাম নাজিম: দৃষ্টিহীনরাও পড়াশোনা করতে পারে, এমন একটা সচেতনতা তৈরি করতে চেয়েছি। তাই মাধ্যমিক শেষে চিন্তা করলাম আমি এমন একটা জায়গায় পড়ব যেখানে দৃষ্টিহীনদের সম্পর্কে তেমন কেউ জানে না। তারপর আমি ভর্তি হলাম রাজধানীর সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে। এখানে আমি একাই দৃষ্টিহীন ছিলাম। আর তখন থেকেই আমার ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু। কোনো ব্রেইল বই ছিল না। সরকার কলেজ পর্যায়ে ব্রেইল বই দেয় না। আর দামি হওয়ায় ব্রেইল বই কেনার মতো অর্থ আমার ছিল না। অডিও শুনে শুনে পড়তাম। বন্ধুদের কাছে পড়ার বিষয় অডিও রেকর্ড করে পাঠাতে বলতাম। কাছের যারা ছিল, তারা আমাকে রেকর্ড করে পাঠাতো। তবে সব রেকর্ডতো করে দেওয়া সম্ভব না। তাই আমি দ্বাদশ শ্রেণিতে এসেও আমার সম্পূর্ণ সিলেবাস শেষ করতে পারিনি। এরপরে আমি একটা ল্যাপটপ কিনে ফেলি। ল্যাপটপ থেকে পিডিএফ ডাউনলোড করে যতটুকু সম্ভব পড়েছি। পাশাপাশি ইউটিউবে কিছু শিক্ষামূলক কনটেন্ট শুনেছি। এভাবে পড়ে আমি উচ্চ মাধ্যমিকের বোর্ড পরীক্ষায় মানবিকে ৪.৯২ পেয়ে উত্তীর্ণ হই।

জাগো নিউজ: দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে আপনার প্রতি শিক্ষকদের সহানুভূতি কেমন ছিল?তরিকুল ইসলাম নাজিম: স্কুল পর্যায়ে কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছি। তবে উচ্চ মাধ্যমিকে ওঠার পর আমি যাদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি তার মধ্যে অন্যতম ইসলামের ইতিহাস বিভাগের কাম্রুন নাহার ম্যাডাম ও অধ্যক্ষ অধ্যাপক মহসিন কবির স্যার খুবই সহায়ক ছিলেন। এছাড়াও প্রত্যেকেই খুব সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন।

জাগো নিউজ: দৃষ্টিহীন হওয়া সত্ত্বেও পরীক্ষার হলে খাতায় কীভাবে লেখেন?তরিকুল ইসলাম নাজিম: বিশেষ একটি পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। আমাকে শ্রুতি লেখক নিয়ে পরীক্ষার হলে যেতে হয়। আমি বলব, আর শ্রুতি লেখক শুনে শুনে লিখবে। তবে শ্রুতি লেখককে অবশ্যই আমার জুনিয়র হতে হবে। আর গোটা বিষয়ের অনুমতি শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রদান করে। যেমন-আমি যখন উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার হলে বসি তখন আমাকে দশম শ্রেণির এক ছাত্রকে সহায়ক হিসেবে নিতে হয়েছে। তেমনি ভাবে মাধ্যমিকের বোর্ড পরীক্ষায় অষ্টম শ্রেণির একজনকে সঙ্গে নিয়েছি।

Advertisement

আরও পড়ুন: অবহেলিত রেলের লাল পোশাকের শ্রমিকরা

জাগো নিউজ: উচ্চ মাধ্যমিক শেষ, এখন কোথায় ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা?তরিকুল ইসলাম নাজিম: আমার প্রথম লক্ষ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে চেষ্টা করব ভর্তি হতে। যদি হতে পারি হবো নাহলে আফসোস থাকবে না। আমি আসলে জীবনে কোনো কিছু না পেলে হতাশ হইনা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সাত কলেজ আছে আশা করি যে কোনো একটায় হয়ে যাবে।

জাগো নিউজ: আপনার মতো অনেকেই আছেন যারা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের জন্য কী বার্তা দেবেন?তরিকুল ইসলাম নাজিম: বার্তা দেওয়ার মতো আমি এখনো কিছুই হতে পারিনি। তবে বিনয়ের সঙ্গে একটা কথা বলতে চাই , প্রত্যেকেরই উচিত আলস্যতা দূর করে সামনে এগিয়ে যাওয়া। আমি জীবনে কিছু করতে পারব না, এটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সাহসী ও উদ্যমী হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াই আমাদের জন্য কল্যাণকর। যেহেতু আমার একটা জায়গায় দুর্বলতা আছে, এই জায়গা থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমি যে কাজটা করতে পারি এটা আমাকে প্রমাণ করতে হবে। আমার মতো যারা আছে তাদের বলতে চাই, ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’।

কেএসকে/জেআইএম