মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ
Advertisement
প্রকৃতির অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টি প্রজাপতি। তাই তো দিনভর রঙিন ডানার নানা রঙের প্রজাপতি প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে ‘উড়লে আকাশে প্রজাপতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি’ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে ২৪ নভেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পালিত হলো প্রজাপতি মেলা। প্রজাপতি সংরক্ষণ ও প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রজাপতির গুরুত্ব সম্পর্কে গণসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১০ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে এ মেলা আয়োজিত হয়ে আসছে।
রঙে আর বৈচিত্র্যে প্রজাপতিকে তার নিজের সঙ্গেই তুলনা করতে হয়। নান্দনিকতার পাশাপাশি উদ্ভিদের পরাগায়নসহ প্রাকৃতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে প্রজাপতি। প্রজাপতির একেকটি ডানা যেন দক্ষ শিল্পীর তুলির পরশে আঁকা জীবন্ত ছবি। প্রজাপতি শুধু প্রকৃতির সুন্দরের প্রতীকই নয়, উদ্ভিদের পরাগায়ণ এবং পরিবেশের মানদণ্ড সূচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু দিনে দিনে কমছে রঙিন ডানার এই পতঙ্গের পরিমাণ।
শহরের যান্ত্রিকতা, কোলাহল থেকে থেকে একটুখানি হাফ ছেড়ে বাঁচতে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে অনেকেই প্রকৃতির কোলে রং ছড়ানো পতঙ্গটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে মেলায় আসেন। মেলা উপলক্ষে দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, বয়োবৃদ্ধসহ হাজার হাজার দর্শনার্থী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিখ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভিড় করেন। মেলায় জীবন্ত প্রজাপতি দেখেছেন কেউ, আবার কেউ শরীরে আঁকছেন প্রজাপতির ট্যাটু, কেউ দেখছেন প্রজাপতির রঙিন ছবি, কেউবা রংতুলিতে এঁকেছেন প্রজাপতি। এভাবেই দর্শনার্থীদের কোলাহলে প্রাণবন্ত ছিল দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক আয়োজিত প্রজাপতি মেলা।
Advertisement
মেলায় ছিল জীবন্ত প্রজাপতি প্রদর্শনী, প্রজাপতির হাট দর্শন, শিশু-কিশোরদের জন্য প্রজাপতি বিষয়ক ছবি আঁকা ও কুইজ প্রতিযোগিতা, প্রজাপতি বিষয়ক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনী, প্রজাপতি চেনা প্রতিযোগিতা, প্রজাপতির আদলে তৈরি ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা, বারোয়ারি বিতর্ক প্রতিযোগিতা, প্রজাপতি বিষয়ক তথ্যচিত্র প্রদর্শন ও পুরস্কার বিতরণ। এ বর্ণিল আয়োজন উপভোগ করতে কুয়াশার চাদরে মোড়ানো শীতের সকালের নিস্তব্ধতাকে উপেক্ষা করে মেলায় দর্শনার্থীদের দেখা মেলে।
আরও পড়ুন: লাল পিঁপড়ার ডিম বিক্রি করেই চলে সংসার
নগর জীবনের ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পেতে একটুখানি প্রশান্তির আশায় সাভারের নবীনগর থেকে প্রজাপতি মেলা উপভোগ করতে এসেছেন ইমতিয়াজ আহমেদ। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তার ছোট্ট দুটি মেয়েকে। মেলায় এসে মেয়েরা ভীষণ আনন্দিত। প্রজাপতির হাটে রং-বেরঙের প্রজাপতি দেখতে তারা ছোটাছুটি করছে এদিক-সেদিক। তিনি মেয়েদের বিভিন্ন প্রজাপতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘ইট-পাথরের শহুরে জীবনে প্রজাপতির দেখা পাওয়া দুর্লভ। ফেসবুকে প্রজাপতি মেলার কথা জানতে পেরে মেয়েদের নিয়ে ছুটে এসেছি। মেয়েরাও পাপেট শো, গান, ছবি আঁকায় চমৎকার সময় পার করেছে।’
প্রতিবারের মতো মেলায় ঘুরতে আসা মেহরাব হোসেন অপি বলেন, ‘প্রজাপতি মেলায় সব বয়সের মানুষের মিলনমেলা ঘটে। শিশু-কিশোররা বিভিন্ন স্টল ও অন্য কার্যক্রম থেকে প্রজাপতি সম্পর্কে জানতে পারে। সবাই প্রজাপতির বৈচিত্র্য, প্রকৃতিতে এদের গুরুত্ব এবং প্রজাপতি সংরক্ষণে ভূমিকা সম্পর্কে জানতে পারেন।’
Advertisement
ঢাকা থেকে প্রজাপতি মেলা দেখতে আসা শিশু তাইফা নূর বলে, ‘প্রজাপতি দেখতে খুবই ভালো লাগে। গ্রামে গেলে প্রজাপতি দেখতে পাই। কিন্তু ঢাকায় আর দেখা যায় না। আজকে এখানে এসে নানা রং-বেরঙের প্রজাপতি দেখছি। খুবই ভালো লাগছে।’
সাভার থেকে বাবার সঙ্গে মেলা দেখতে এসে ছোট ইনসিয়া বিচিত্র রকমের প্রজাপতি দেখে খুবই খুশি। এছাড়া ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পেরে এবং পাপেট শো দেখে খুবই উচ্ছ্বসিত দেখা যায় ছোট্ট ইনসিয়াকে। বাবার সঙ্গে কল্যাণপুর থেকে মেলা দেখতে আসা নার্সারি পড়ুয়া আইমান বিনয় বলেন, ‘বাবার সাথে মেলায় ঘুরতে এসেছি। অনেক রঙের প্রজাপতি দেখেছি, চিত্র এঁকেছি। মেলায় এসে আমার ভাল্লাগছে।’
আরও পড়ুন: সমুদ্রের অলস প্রাণী শাপলা পাতা মাছ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী ফারহান রাফি বলেন, ‘প্রজাপতি প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ। এরা পরিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্রের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি প্রাণী। প্রজাপতি মেলায় শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই উপস্থিত থাকেন। বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পুরস্কার ও প্রজাপতি নিয়ে বিভিন্ন কাজের অবদানস্বরূপ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। এতে কাজের যেমন স্বীকৃতি মেলে; তেমনই প্রজাপতি নিয়ে আরও বেশি কাজ করতে সবাই উদ্বুদ্ধ হয়।’
প্রজাপতি মেলায় এসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেচার স্ট্যাডি অ্যান্ড কনজারভেশন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক তানজিলুর রহমান বলেন, ‘প্রজাপতি আমাদের জীববৈচিত্র্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি দেখতে যেমন চমৎকার; ঠিক তেমনই বৈচিত্র্যময় তাদের জীবন চক্র। বাগানকে সুরক্ষিত রাখা, পরিবেশকে পরিষ্কার করা, জলবায়ু বুঝতে সাহায্য করায় এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রজাপতি সংরক্ষণে আমাদের এগিয়ে আসা উচিত।’
মেলার আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রজাপতি হলো একটি ছোট্ট নান্দনিক প্রাণী যা মানুষকে আনন্দ দেয়। দিনে দিনে প্রাণীটি প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১০ প্রজাতির প্রজাপতি পাওয়া যেত। এখন সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৭ প্রজাতিতে। গাছপালা বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রজাপতি রক্ষা করতে হবে। কেননা প্রজাপতির পরাগায়ণেই উদ্ভিদ ও গাছের সৃষ্টি। তাই মানুষের মাঝে প্রজাপতির গুরুত্ব বোঝানো এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আমাদের এই আয়োজন।’
মেলা পরিদর্শন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. নূরুল আলম বলেন, ‘প্রজাপতি মেলা সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। মেলায় প্রজাপতির আদলের প্রদর্শনীগুলো সবার মনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। দর্শনার্থীদের হাস্যোজ্জ্বল অংশগ্রহণই মেলার সার্থকতা। দর্শনার্থী, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণকারী ও প্রজাপতি বিশেষজ্ঞসহ সবাইকে প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।’
আরও পড়ুন: দেখতে শান্ত হলেও ভয়ংকর এই মাছ
এদিকে প্রজাপতি চেনা প্রতিযোগিতায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের নেচার স্ট্যাডি অ্যান্ড কনজারভেশন ক্লাবের সদস্য ফাহিমা আক্তার সুমি এবং আলী আকবর প্রথম স্থান, মোহাম্মদ সাব্বির আহমেদ এবং জয় বিশ্বাস দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন। প্রতিযোগিতায় প্রথম দল ১০টি এবং দ্বিতীয় দল ৭টি প্রজাতি চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। এছাড়া বারোয়ারি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন আমেনা আক্তার আনিকা।
এবারের আসরে বন্যপ্রাণী ও প্রজাপতি সংরক্ষণে বিশেষ অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলামকে বাটারফ্লাই অ্যাওয়ার্ড এবং প্রজাপতি নিয়ে গবেষণাকর্মের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. জহির রায়হানকে বাটারফ্লাই ইয়াং ইনথুসিয়াস্ট অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।
এ বছর প্রথম প্রিন্ট, অনলাইন ও ব্রডকাস্ট ক্যাটাগরিতে ৩ জনকে মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। প্রজাপতি সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য জাগো নিউজের সাভার প্রতিনিধি মাহফুজুর রহমান নিপু, বাংলা ট্রিবিউনের জাবি প্রতিবেদক ওয়াজহাতুল ইসলামসহ ৩ জন ‘বাটারফ্লাই মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড’ পান।
লেখক: ফিচার লেখক।
এসইউ/জেআইএম