আনজুম মাহিয়া
Advertisement
‘চিঠি পড়া শেষ হতেই উচ্চস্বরে হাসে অনন্ত। কী সহজ-সরল ভাষা। সাবলীল ভঙ্গি। সাহিত্যের মারপ্যাঁচ নেই। আবেগের আতিশয্য নেই। অথচ সবটুকু আবেগ যেন উপচে পড়ছে। দরদমাখা এই চিঠির মানুষটি আজ পাশে নেই। হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়েও সোনাবউ পায়নি অনন্তকে। তখন বাস্তবতার কাছে হেরে যায় ভালোবাসা। প্রতিষ্ঠা নামক কালো ছায়া তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয় এক মুহূর্তেই।’ অংশটুকু লেখক সালাহ উদ্দিন মাহমুদের ‘এখানে কয়েকটি জীবন’ গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া। মোট এগারোটি গল্পের সমাহার বইটি। যেখানে আছে জীবনের গল্প, হাসি-কান্নার গল্প এবং আশা-নিরাশার গল্প। প্রত্যেকটি গল্পে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন জীবনের গভীর বেদনা।
বইটির প্রথম গল্প ‘জীবন’। সাত বছরের বিবাহিত জীবনে সন্তানের মুখ দেখতে পারছে না আনিস-রিজিয়া দম্পতি। সমাজের নানা কথা শোনার পরেও তারা একে অপরের পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন। হঠাৎ একদিন বিদ্যুতের খুটিতে লাগানো বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যায় দুজনের। সেই বিজ্ঞাপনে অসহায় এক দম্পতি তাদের বাচ্চাকে বিক্রি করবে, যে কি না এখনও পৃথিবীতে আসেনি। আনিস-রিজিয়া সেই বাচ্চাকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য সব রকম সাহায্য করে যায়। কিন্তু সবশেষে নিজেদের বাচ্চার শখ পূরণ করতে আরেক মায়ের কোল খালি করার সাহস তাদের আর হয়ে ওঠেনি।
দ্বিতীয় গল্প ‘সোনাবউ’ নিঃসঙ্গ একাকী জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা অনন্ত একদিন তার জমানো সব চিঠি খুলে বসে। কেউ একজন তাকে হারিয়ে ফেলার তীব্র কষ্ট প্রকাশ করেছে একটা চিঠিতে, যেটা তার প্রেমিকার ছিল। বেকারত্বের কারণে সেই মানুষটাকে নিজের করে পায়নি অনন্ত। সেইদিন যদি সব কিছু উপেক্ষা করে সেই মানুষটার হাত ধরতো তাহলে আজ তার জীবন এত এলোমেলো হয়ে যেত না। আজ সবকিছু থাকলেও তার সোনাবউ নেই।
Advertisement
আরও পড়ুন: বাংলা সাহিত্যের একাল-সেকাল: প্রবন্ধগ্রন্থের আনন্দপঠন
সহজ-সরল-সাবলীল ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় তার প্রতিটি গল্প। ‘শাড়ি’ গল্পে দেখা যায়, বারোশ পঞ্চাশ টাকার শাড়ি আর ফতুয়া পেয়েই মহা আনন্দে ফেটে পড়ে আজমের মা মতিজন ও বাবা মকবুল। স্বল্প আয়ের বেতনেই তাদের পরিবারে আনন্দের শেষ নেই। অল্পতেই যেন তাদের ঈদের আনন্দ। এখানে লেখক অত্যন্ত নিখুতভাবে তাদের আনন্দকে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাঠককে উপলব্ধি করিয়েছেন টাকার মাঝেই সব সময় সুখ থাকে না। ভালোবাসা যেখানে পবিত্র ও গভীর হয় সেখানেই সুখ থাকে। ‘বিবস্ত্র’ গল্পে অসহায় পথশিশু রুবি। যার কোনো আবেগ নেই। কোনো অভিযোগ নেই। কোনো রাগ-অভিমান নেই। কখনো রাস্তার পাশে শুয়ে থাকে কখনোবা লম্পটের সামনে পড়ে। তাদের বিচার দেওয়ার মতো কেউ নেই। এই রুবির খুব কাছের একজন বন্ধু হয়ে ওঠে সুজন। সেও রুবির মতোই পথশিশু। কোনো একদিন রুবির কথায় অভিমানে লুকিয়ে থাকে সুজন। সারাদিন তাকে সারাশহরে খুঁজে না পেয়ে কিসের যেন একটা চাপা কষ্টে সে হাঁটতে থাকে। তখনই তিন অচেনা পুরুষের হাতে ধর্ষিত হয় রুবি। কিন্তু এই পথশিশুর বিচার কি কেউ করবে? তাদেরও তো মায়ের বুকে নিরাপদে ঘুমাবার অধিকার আছে। নিরাপত্তা নিয়ে জীবনে চলার অধিকার তাদেরও আছে।
বইয়ের বাকি গল্পগুলো হচ্ছে ‘দায়ী’, ‘জয়শ্রী’, ‘কুমারী’, ‘নাকফুল’, ‘কুকুর’, ‘গোলেয়া’, ‘মিঠু’। একটি লক্ষ্যণীয় যে, তার প্রতিটি গল্পের শিরোনাম এক শব্দে। মাত্র একটি শব্দে তিনি গল্পের মূল বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন। তার গল্পে প্রেম, কাম, অনাচার, অত্যাচার, মানবিকতা, জীবনের জটিলতা প্রভৃতি বিষয় ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই তো প্রতিটি গল্পের নামকরণে অবশ্যই সার্থকতা রয়েছে। এই এগারোটি গল্প মিলেই ‘এখানে কয়েকটি জীবন’কে তুলে ধরেছেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।
আরও পড়ুন: এখানে কয়েকটি জীবন: গল্পজুড়ে জীবনের বিস্তার
Advertisement
এখানে প্রত্যেকটি গল্প একেক মানুষের একেক রকম জীবনের আলোকে লেখা। পড়তে পড়তে কখনো আপনার চোখ ভিজে যাবে। কখনো আপনি হারিয়ে যাবেন তাদের নানা রকম জীবনের জটিলতার মাঝে। এককথায় বলা যায়, হৃদয় নাড়িয়ে দেওয়ার মতো সব গল্প। ধন্যবাদ সালাহ উদ্দিন মাহমুদকে আমাদের এত সুন্দর একটি বই উপহার দেওয়ার জন্য। আগামীতেও তার এরকম আরও বই প্রত্যাশা করি।
সবশেষে বলতে হয়, বইয়ের প্রচ্ছদ, বাইন্ডিং, পৃষ্ঠা বরাবরের মতোই দারুণ এবং উন্নতমানের। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে এমন প্রোডাকশন সত্যিই অকল্পনীয়। এজন্য ধন্যবাদ জানাই প্রকাশক অঞ্জন হাসান পবন এবং কিংবদন্তী পাবলিকেশনকে। আশা করি বইটি পড়ে আপনাদের ভালো লাগবে। আমি বইটির বহুল প্রচার ও পাঠ কামনা করছি।
বইয়ের নাম: এখানে কয়েকটি জীবনলেখক: সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ধরন: গল্পগ্রন্থপ্রকাশনী: কিংবদন্তী পাবলিকেশনপ্রচ্ছদ: আইয়ুব আল আমিনমূল্য: ২০০ টাকা
এসইউ/