যে ডলার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ওলটপালট করে দিয়েছিল— সেই ডলারের দাম কমতে শুরু করেছে। প্রায় দুই বছর ধরে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলা ডলারের দাম কমেছে। বৃহস্পতিবার থেকে বিক্রি-কেনা উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর ৫০ পয়সা কমেছে। একইসঙ্গে আন্তঃব্যাংক, রেমিট্যান্স সংগ্রহ ও রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রেও ডলারের দর ৫০ পয়সা করে কমছে।
Advertisement
এখন থেকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দাম কমবে। অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন ব্যাংকাররা।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি (৪.৭০ বিলিয়ন) ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাওয়া যাবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। তখন বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও বেশ খানিকটা বাড়বে।
এর মধ্যে যদি রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকে—তাহলে ডলার সংকট কেটে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতিতেও স্বস্তি ফিরে আসবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। জনগণও এই নতুন তথ্যে হাফ ছেড়ে বাঁচবে। একটু স্বস্তি জেনো মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করে সেজন্য বুধবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় যে হার ছিল ১১১ টাকা সেটা বৃহস্পতিবার থেকে করা হয়েছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা।
Advertisement
রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ডলারের দর ছিল ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। বৃহস্পতিবার থেকে এই দুই ক্ষেত্রেই ডলারের দর হলো ১১০ টাকা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে পর্যায়ক্রমে আরও কমানো হবে। আশা করছি ডলারের বাজার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
এদিকে অক্টোবরের পর নভেম্বরেও রেমিট্যান্সে সুবাতাস বইছে। রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক বৃদ্ধি, ডলার নিয়ে এ নতুন ব্যবস্থাপনা ও আইএমএফ এর আগামী ঋণের অর্থ মিলিয়ে আমরা বছরের শেষে এসে নতুন দিনের সন্ধান পাচ্ছি। অর্থনীতির চাকা ঘুরতে এরচেয়ে বড় সুখবর আর নেই। রিজার্ভের প্রধান উৎস হচ্ছে রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স।
গত সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ১৩৩ কোটি ৩৬ লাখ (১.৩৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। একক মাসের হিসাবে এই রেমিট্যান্স ছিল সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। কিন্তু অক্টোবর মাসে পাল্টে যায় সেই চিত্র; প্রায় ২ বিলিয়ন (১৯৮ কোটি) ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। চলতি নভেম্বর মাসেও সেই উল্লম্ফন অব্যাহত আছে। চলতি মাসের প্রথম ১৭ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ১১৯ কোটি (১.১৯ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ শতাংশ বেশি। গত বছর এই ১৭ দিনে এসেছিল ১০০ কোটি ডলার।
ভুলে গেলে চলবে না- এই যে অর্থনীতিকে সচল রাখা ও অর্থনীতিবিদদের নিরলস প্রচেষ্টায় নতুন নতুন উদ্যোগ নিতে চেষ্টা করা- এ লড়াই সবার। এই দেশকে যদি ভালোবাসি তাহলে এই সংকট মোকাবিলায় একসাথে শক্তহাতে দাঁড়াতে হবে।
Advertisement
এখন আমরা সবাই জানি, কেন অর্থনীতি বারবার পেছনের দিকে যেতে চাইছে। দুই বছরের করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। প্রধান সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরছিল। স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো ঘিরে দেশের উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগের ছক কষছিলেন।
কিন্তু পৌনে দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব ওলটপালট করে দেয়। পাল্টে যাচ্ছে সব হিসাব-নিকাশ। বিশ্বের ছোট-বড় সব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও তছনছ হয়ে যেতে থাকে। পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার।
দেড় বছর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর বাড়তে থাকে ডলারের দর; টানা বাড়তে বাড়তে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারেই ১১১ টাকায় ওঠে। ব্যাংকগুলো ১১৫/১১৬ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি করে; প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিটেন্স সংগ্রহে ১২৪ টাকা পর্যন্ত দেয় ব্যাংকগুলো। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ১২৮ টাকায় উঠে যায়। ‘অস্থির’ ডলারের বাজার ‘সুস্থির’ করতে নানা পরীক্ষা-নিরিক্ষা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। বেড়েই চলে ডলারের দর; দুর্বল হতে টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের অক্টোবরে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। অর্থাৎ দুই বছর আগে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে প্রতি ডলারের জন্য ৮৪ টাকা ৮০ খরচ করতে হতো। বৃহস্পতিবার লেগেছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই দুই বছরে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার মান কমেছে ৩০ দশমিক ৪১ শতাংশ।
দুই বছরের করোনা মহামারির পর বাড়তি চাহিদা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং হুন্ডি বেড়ে যাওয়ায় ডলারের ব্যাপক সংকটের সৃষ্টি হয়। ডলারের দর হুহু করে বাড়তে থাকে। টিকে থাকার কৌশল হিসেবে বুধবার সন্ধ্যায় বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) বৈঠকে দীর্ঘ দুই বছর পর টাকার বিপরীতে ডলারের দর কমানোর সিদ্ধান্ত হয়।
ভুলে গেলে চলবে না- এই যে অর্থনীতিকে সচল রাখা ও অর্থনীতিবিদদের নিরলস প্রচেষ্টায় নতুন নতুন উদ্যোগ নিতে চেষ্টা করা- এ লড়াই সকলের। এই দেশকে যদি ভালোবাসি তাহলে এই সঙ্কট মোকাবিলায় একসাথে শক্তহাতে দাঁড়াতে হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
এইচআর/জেআইএম