প্রবাস

বিষয়টি এভাবে ভেবে দেখিনি

অমিয় দাশ, যুক্তরাষ্ট্র

Advertisement

তাইতো, বাঁধনের কথা অন্য আর কেউতো শোনেনি। মনে মনে ভাবলো ওরা শুনলে নিশ্চয়ই অংশুর মতোই মজা পেতো।‘অনেক জোরে হাসলে আপনার চোখ জাপানি বাচ্চাদের মতো দেখায়’। বলেই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কুটিকুটি হেসে টেবিলের দিকে ঝুঁকে পড়লো। মাঝে টেবিল না থাকলে হয়তো অংশুর গায়ের ওপরই আছড়ে পড়তো। অংশু ছেলেদের চোখের এ রকম আজব বর্ণনা জীবনে কখনো শোনেনি।

আজ অংশু ও বাঁধন ইউনিভার্সিটির পাশে একটা ক্যাফেতে একটা টেবিল নিয়ে সামনা সামনি বসে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীদের আড্ডাখানা এই ক্যাফেটা। অংশু একটি সংস্কৃতি সংঘের সদস্য। ও মাঝে মাঝে এখানে আসে, সবার সঙ্গে দেখা করতে বা আড্ডা মারতে। ওদের নাটকের কোনো রিহারসেল থাকলে এখানে সবাই সমবেত হয়ে তারপর রিহারসেল স্থানের দিকে রওয়ানা হয়।

অংশু দুটো কফির অর্ডার দিয়ে স্থির হয়ে বসলো। আজ বাঁধনের মনটা অন্যান্য দিনের মতো ফুরফুরা না। সঙ্গে ওর বোনটাও নেই। অংশুর একটু খটকা লাগলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘কি বাঁধন সব ঠিকঠাক?’

Advertisement

‘হ্যাঁ, সব ঠিকঠাক’। নরম সুরে বাঁধন বললো। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বাঁধন অংশুকে জিজ্ঞেস করলো, ‘অংশু ভাই, আপনাকে একটা প্রশ্ন করব?‘হ্যাঁ। কি প্রশ্ন?’‘একটা মানুষের প্রাইস বা মূল্য কত?’

হঠাৎ এ রকম একটা জটিল প্রশ্ন শুনে অংশু আশ্চর্য হয়। বলে, ‘এটা একটা খুব দামি এবং আপেক্ষিক প্রশ্ন। যদি সত্যিই জানতে চাও তাহলে আমার মতে এ রকম হবে…’ একটু থেমে আবার বলে, ‘প্রথমে আমার নিজের কত মূল্য সেটা দিয়ে শুরু করি।

‘আপনার মূল্য কত?’ ‘আমার মূল্য আমার মায়ের কাছে এক রকম, আবার তোমার কাছে এক রকম’। বলেই একটু মুচকি হাসলো।বাঁধন জিজ্ঞেস করে, ‘হুম, তাহলে সন্তানের কাছে বাবা বা মায়ের মূল্য কত?’

‘বাবা মায়ের কাছে প্রতিটা সন্তান অমূল্য। অর্থাৎ, একটি মা তার গর্ভে ধারণ করা একটি সন্তানকে সে যে মূল্য দেবে, প্রতিটি মা ঠিক একই মূল্য দেবে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটার পরিমাণ বের করা যাবে না। অন্যভাবে বললে, তোমার কাছে তোমার মা-বাবার যে মূল্য, আমার কাছেও আমার মা-বাবার একই মূল্য’।

Advertisement

একটু থেমে আবার বললো, ‘প্রত্যেকটা জিনিসের মূল্য আবার স্থান, কাল, পাত্র ভেদে বিভিন্ন রকম হয়। একটা চেয়ার যদি একটি লবণাক্ত, আদ্র জায়গায় বা দেশে যা দাম হবে, সেই একই চেয়ার কোনো শুষ্ক মরুভূমি এলাকায় তার দাম ভিন্ন হবে। কারণ, ঐ নির্দিষ্ট প্রকারের কাঠের চেয়ারের স্থায়িত্ব কম বা বেশি হবে আদ্রতা, তাপমাত্রা ইত্যাদির প্রভাবে। তাই একই জিনিসের মূল্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হবে।

প্রথম পর্ব পড়ুন এখানে

একটি জিনিসের মূল্য হচ্ছে যে ওই জিনিসের কাছ থেকে ক্রেতা বা মূল্য নির্ধারণকারী কতটুকু উপযোগিতা পাচ্ছে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা জিনিসের একটা মূল্য আছে। মূল্য হলো একটি বস্তু পেতে গেলে কি পরিমাণ স্যাক্রিফাইস বা ত্যাগের সম্মুখীন হবে তার সমতুল্য। যদি স্যাস্ক্রিফাইসের চেয়ে মূল্য বেশি হয় তবে সেই বস্তুটা হবে মাত্রাতিরিক্ত দামী বা ওভারপ্রাইছ্ড’।

অংশু ইতস্তত করলো। আজকাল বখাটে ছেলেরা সুন্দরী মেয়েদের টিজিং করার সময় ‘জিনিস’ বলে। তবুও বলে চললো, কোনো জিনিস ক্রয় করার আগে তুমি সবসময় মূল্যের কথা চিন্তা করো। মূল্যটা যদি তোমার স্যাস্ক্রিফাইসের চেয়ে বেশি হয় তবে ওই জিনিস কিনে তুমি খুশি হবে। আবার মূল্য যদি বেনেফিট বা উপযোগিতার চেয়ে কম হয় তবে সেটা কিনে তুমি মনে করবে যে তুমি ঠকেছো’।

‘হ্যাঁ, বিষয়টা এভাবে ভেবে দেখিনি’।বাধঁন আগ্রহ ভরে বললো। ‘মনে করো আমি একটা শাড়ি কিনে তোমাকে উপহার দেব। ধরো সেই শাড়িটির মূল্য ১০০ টাকা’।‘মাত্র ১০০ টাকার শাড়ি?’ বলেই বাধঁন অংশুকে থামিয়ে দিলো।

‘তুমি কি আমার এতক্ষণের বকবক শুনেছিলে, নাকি হাওয়া হয়ে গিয়েছিলে?’বলেই অংশু বাধঁনের দিকে আবার তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ‘শুনছিলাম আর ভাবছিলাম’। ‘কি ভাবছিলে’? একি গোলক ধাধাঁ? মূল্যের সাথে উপযোগিতার সম্পর্কের কথা। মানুষের যদি উপযোগিতা থাকে তবে সজীবের কাছে আমার উপযোগিতা কি তাই ভাবছিলাম’। সজীব বাধঁন এর প্রেমিক, তবে এখন একটু মন কষাকষি চলছে।

‘হুম, সেটা একটা ভাবার বিষয় বটে। যেমন বললাম, মূল্য নির্ধারিত হয় স্থান, কাল, পাত্র ভেদে। এখানে রাজীব হলো পাত্র বা দামদরকারী কিন্তু এর সাথে স্থান ও কাল জড়িত আছে।

তবে সজীব সম্পর্কে আমি তেমন বিশেষ কিছু জানি না। জানলে হয়তো বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করে দেখতে পারতাম’। ‘সজীবের সম্পর্কে দেখি বলবো আপনাকে’। বলেই বাধঁন অন্য মনস্কের মতো অংশুর দিকে তাকিয়ে আবার তাড়া দিলো, ‘আপনি কিন্তু আমার মূল্যায়ন শেষ করলেন না’।

‘হ্যা, যা বলছিলাম, বলেই বিজ্ঞের মতো বর্ণনা শুরু করলো। মনে করো একটি শাড়ির মূল্য তাহলে ১০ হাজার টাকা। যেটা আমি দোকানে কিনতে গিয়েছি তোমাকে উপহার দেওয়ার জন্য। এখন ওই শাড়িটার বিনিময় মূল্য হলো ১০ হাজার টাকা। তার মানে আমার পকেট থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে শাড়ি কিনে উপহার দেব। এখন ওই শাড়িটি ক্রয়ের ফলে আমি কি উপযোগীতা পাবো’?

‘হ্যাঁ, ১০ হাজার টাকার শাড়ি কিন্তু দেখতে সুন্দর হবে। কিন্তু আমার কাছ থেকে আপনি কি উপযোগিতা পাবেন বলে আপনার মনে হয়?’

‘এখানে উপযোগিতা বলতে, শাড়িটা পেয়ে তুমি খুশি হবে। শাড়িটা কি উপলক্ষে পরা যায় তা নিয়ে চিন্তা করবে। এটির সাথে রং মিলিয়ে ব্লাউজ বানাবে, চুড়ি কিংবা মাটির মালা কিনবে। হয়তো জুতা বা হিল স্যান্ডেল কিনবে। এসব চিন্তা করে তোমার কিছু ভালো সময় কাটবে। এসব ভালো সময় কাটানোরও কিছু মূল্য আছে’।

‘আর এক্ষেত্রে আপনার উপযোগিতা?’‘আমার উপযোগিতা হলো তুমি আরো বেশি করে খিল খিল করে প্রাণ খুলে হাসবে। তোমার গায়ে শাড়িটি তোমাকে আরো উজ্জল করবে, এই আর কি‘।

বাধঁন ভাবে এভাবে তাকে কেউ কখনো বলেনি। এ রকম কারো ভাবনা হতে পারে, তা একটু উদ্ভট। যাজ্ঞে।‘হ্যাঁ, এবার বলুন শাড়ির বিষয়টা’।

‘মূল্য হচ্ছে, ওই শাড়িটা কতটুকু উপযোগিতা দিতে সক্ষম হবে। যদি বিনিময় মূল্য উপযোগিতার চেয়ে কম হয়, তবে দোকানি আমার কাছ থেকে বেশি দাম নিয়েছে’।‘তা কি করে হবে? ‘বাধঁন জিজ্ঞেস করে।

‘ধরো শাড়িটি উপহার হিসেবে পেয়ে তুমি বললে, রঙটা কচি কলাপাতার রং না হয়ে গাঢ় নীল হলে ভালো হতো। অথবা পাড় আঁচল গোলাপী না হয়ে মেরুন হলে ভালো হতো তাহলে আমি বুঝতাম শাড়িটি তোমার পছন্দ হয় নি। তার মানে শাড়িটার উপযোগিতা ১০হাজার টাকার সমান নয়। আমি ঠকেছি শাড়িটা কিনে’।

‘আরে কি বলেন? কচি কলাপাতা রঙ আমার খুব পছন্দ। তার ওপর গোলাপি পাড়, আচঁল হলে তো সোনায় সোহাগা!’ বলেই বাধঁন মিটমিট করে হাসলো। বললো, ‘তাহলে না হয় কচি কলাপাতা রং এর শাড়িটা পেলাম। কিন্তু ওটাতো বস্তু। প্রশ্নটা হচ্ছে আমার মূল্য নিয়ে, মানুষের মূল্য নিয়ে। মানুষের মূল্য তাহলে কীভাবে নির্ধারণ করবেন?’ ‘হ্যাঁ, সেটাই বলতে চাচ্ছি যে, প্রতিটি মানুষের একটি নির্দিষ্ট মূল্য আছে’!বলেই অংশু বাধঁন এর মুখের দিকে তাকালো।

বাধঁনের মুখটা বেশ শুকিয়ে গেলো। এতক্ষণ সে যেভাবে অংশুর দিকে তাকিয়ে ছিল, সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে তার হাত ব্যাগের ফিতা আঙ্গুল দিয়ে খুঁটতে লাগলো। অংশু ক্ষণিকের জন্যে চুপ হয়ে গেলো। নিঃসঙ্গতা ভেঙে বাধঁন বলল, ‘কি থেমে গেলেন যে?’।

চলবে...

লেখক: অমিয় দাশ, ফার্মাসিস্ট, ওষুধ প্রস্তুতকারক। বোকা রেতন, যুক্তরাষ্ট্রamio7@yahoo.com

এমআরএম/এএসএম