দফায় দফায় চলছে হরতাল-অবরোধ। চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কঠিন সময় পার করছেন ব্যবসায়ীরা। হোসিয়ারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, সারা বছর তারা মুখিয়ে থাকেন শীতের মৌসুমে ব্যবসা করার জন্য। প্রতি বছর শীত আসার আগের সময়টা হচ্ছে তাদের ব্যবসার মূল মৌসুম। এসময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা নারায়ণগঞ্জে আসেন শিশুদের শীতের পোশাক কিনতে। এবার যানবাহন চলাচল কম থাকায় হোসিয়ারি ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না।
Advertisement
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার অবরোধের কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা নারায়ণগঞ্জের মার্কেটগুলোতে আসতে পারছেন না। ফলে নারায়ণগঞ্জের হোসিয়ারি ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। এভাবে অবরোধ চলতে থাকলে শতকোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়বেন। সেই সঙ্গে হোসিয়ারি ব্যবসায় সম্পৃক্ত লক্ষাধিক মানুষের জীবিকাও পড়বে অনিশ্চয়তায়।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গার্মেন্টসের ওয়েস্টেজ কাপড় কাটিং করে শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের শীতের পোশাক তৈরি করে এ এলাকার কারখানাগুলো। এসব শীতের পোশাক নারায়ণগঞ্জ শহরের নয়ামাটি, উকিলপাড়া, দেওভোগ, থানা পুকুরপাড় ও রিভারভিউ মার্কেটে বেচাকেনা হয়। সেখান থেকে পোশাক যায় রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের প্রায় সব জেলায়।
নারায়ণগঞ্জ শহরের সব মার্কেট মিলিয়ে এসব কাপড় কেনাবেচার প্রায় ১০ হাজার দোকান রয়েছে। এ ১০ হাজার দোকানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ২০ থেকে ২৫ হাজার ছোট ছোট কারখানা। সেই সঙ্গে দোকান ও কারখানার সঙ্গে লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান সংযুক্ত রয়েছে। প্রতি বছর সব মার্কেট মিলিয়ে একশ থেকে দেড়শ কোটি টাকার বেচাকেনা হয় এ মৌসুমে। কোনো কোনো সময় এরচেয়ে বেশিও হয়। কিন্তু এবছর পর্যাপ্ত পরিমাণে মাল থাকার পরও বিক্রি হচ্ছে না। মূলত পাইকাররা আসতেই পারছেন না কাপড় কিনতে।
Advertisement
আরও পড়ুন>> বেনাপোলে রাজস্ব আদায়ে ধস: ৪ মাসে ঘাটতি ৩২৮ কোটি টাকা
এনিয়ে নাহিদ হোসিয়ারির মালিক নাহিদ বলেন, আমাদের ব্যবসার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। অবরোধের কারণে পাইকাররা মফস্বল থেকে আসতে পারছে না। আমাদের ক্রেতা পাইকাররা। তারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসে। প্রতিটি মার্কেটই পাইকারশূন্য। আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে মাল রয়েছে। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বেচাকেনা একেবারে নেই বললেই চলে। সামনে কী হয় জানি না। আমরা এ সমস্যার সমাধান চাই।
তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জে প্রায় ১০ হাজার দোকান রয়েছে যারা হোসিয়ারি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমাদের একেকটা দোকানের সঙ্গে ৫০ থেকে ৬০ জন মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। আমাদের ২০ থেকে ২৫ হাজার কারখানা আছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রতি বছর একশ থেকে দেড়শ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। কোনো কোনো বছর এরচেয়ে বেশিও হয়।
শুভ হোসিয়ারি অ্যান্ড গার্মেন্টসের মালিক নিমাই সরকার বলেন, এখন আমরা করুণ অবস্থায় আছি। কিছুদিন পরপর অবরোধ দেওয়ায় শীতের পোষাক বিক্রি করতে পারছি না। আমাদের ব্যবসায়ী ভাইয়েরা লোন নিয়ে ব্যবসা করেন। সবারই আশা থাকে নভেম্বর-ডিসেম্বরে ব্যবসা করে জানুয়ারির মধ্যে সব টাকা পরিশোধ করবেন। কিন্তু এবার অবরোধের কারণে আমাদের সমস্যা হয়েছে। ব্যাংক, কিস্তিওয়ালারা এগুলো বুঝবে না। তারা বলবে টাকা দাও।
Advertisement
আরও পড়ুন>> শীতের বেচাকেনা নিয়ে শঙ্কায় কেরানীগঞ্জের ব্যবসায়ীরা
শহরের নয়ামাটি মার্কেটের অর্চনা প্রোডাক্টসের প্রোপ্রাইটর হরেকৃষ্ণ ঘোষ বলেন, মফস্বল মার্কেটের অনেক ব্যবসায়ী এখানে আসতে পারছে না। যেদিন অবরোধ থাকে না সেদিন ব্যবসায়ীদের ভিড় দেখা যায়। কিন্তু সেদিন ছুটি থাকে। আমরা ছুটির দিন থাকি না, কর্মচারীরা থাকে না। সব মিলিয়ে ব্যবসার পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না।
কল্যাণ টেক্সটাইলসের মালিক লিটন কুমার সাহা বলেন, অবরোধের কারণে দূরের ব্যবসায়ীরা মার্কেটে আসতে পারছে না। যে কারণে আমাদের বেচাকেনার অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছে।
তবে এ পরিস্থিতিতেও দু-একজন ক্রেতা আসছেন মার্কেটে। তারাও বলছেন, জীবনের ঝুঁকি কেউ নিতে চায় না। এ কারণে সারাদেশেই বিক্রি কম।
কুড়িগ্রাম থেকে আসা মো. জাফরুল ইসলাম বাবু নামে এক পাইকার বলেন, মোকামে এসে দেখছি লোকজন কম। এখানকার মহাজনদের ব্যবসা ঢিলেঢালা। প্রতি বছর শীতের শুরুতে এখানে অনেক পাইকার থাকতো। কিন্তু সে তুলনায় এবছর পাইকার নেই। অবরোধের কারণে ঝুঁকি নিয়ে আসতে হয়। যে পাইকাররা আসেন তাদের সঙ্গে টাকা-পয়সা থাকে। ফলে কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না।
আরও পড়ুন>> অবরোধে ‘প্রায় ফাঁকা’ নিউমার্কেট, চিন্তিত ব্যবসায়ীরা
তিনি আরও বলেন, আমাদের ওখানে (কুড়িগ্রাম) মাফলার-টুপি তৈরি হয়। ওখান থেকে সারাদেশে বিক্রি হয়। ওখানেও একই অবস্থা। পাইকার ঢুকতে পারছে না। যেদিন অবরোধ না থাকে সেদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ পাইকার থাকে। প্রতিটি মার্কেটেই পর্যাপ্ত পরিমাণ মাল রয়েছে, কিন্তু বেচাকেনা নেই।
শহরের থানা পুকুরপাড় মার্কেটের তত্ত্বাবধায়ক ও ফিহা হোসিয়ারির মালিক মো. হাবিবুর রহমান বাবুল বলেন, আশা করেছিলাম ব্যবসা হবে। কিন্তু অবরোধের কারণে আমরা পেছনে পড়ে গেছি। আমাদের অনেক মাল আটকে গেছে। সামনে কী হবে জানি না। মাল বিক্রি করার সময় যদি বিক্রি করতে না পারি তাহলে অনেক লোকসান হবে। প্রত্যেক দোকানে ন্যূনতম ১০ লাখ টাকার মালামাল আটকে রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা মাল বিক্রি করে শেষ করতে পারবো না।
তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত আমাদের একটা টার্গেট থাকে। সেই টার্গেট অনুযায়ী মালামাল বিক্রি করতে না পারলে পরে আর বিক্রি হবে না। বাংলাদেশের সব জেলার লোক এখানে আসে। কিন্তু এখন পাইকাররা আসতেই ভয় পাচ্ছে।
দেওভোগ মার্কেটের পোশাক প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সভাপতি জিএম আরাফাত জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি বছরই যারা শীতের বাজার ধরে তাদের বেচাকেনা শুরু হয়েছে নভেম্বর থেকে। কিন্তু এভাবে একের পর এক অবরোধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। যদিও দোকাটপাট খোলা রয়েছে। কিন্তু যারা শিশুদের শীতের পোশাক বিক্রি করে তাদের ১ টাকাও বিক্রি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ হোসিয়ারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ নাজমুল আলম সজল জাগো নিউজকে বলেন, স্বাভাবিকভাবেই একের পর এক চলমান অবরোধের কারণে আমাদের হোরিয়ারি ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। প্রতি বছরই তারা এ সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন। শীত আগমনের পূর্ব-মুহূর্তে বেচাকেনা করে তারা সারা বছরের আয় অর্জন করেন।
মোবাশ্বির শ্রাবণ/এমএইচআর/এএসএম