রাজনীতি

বিএনপির ‘ব্যর্থতায়’ সফল আওয়ামী লীগ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি মাস দেড়েক। ঘোষণা হয়ে গেছে তফসিল। এখনো সেই অর্থে আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি বিএনপি। বিদেশনির্ভরতা, দলনেতার অভাব ও মিত্রদের নিষ্ক্রিয়তায় শেষ পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে ভর করেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না দলটির। দাবি আদায়ে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার ব্যর্থতার মধ্যে সফলভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথেই এগিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি রাজপথে যতটুকু কর্মসূচি পালন করতে সক্ষম হয়েছে তার পাল্টা কর্মসূচিতেও এগিয়ে ছিল ক্ষমতাসীনরা।

Advertisement

ঈদের পর, পূজার পর, তফসিল ঘোষণার পর আন্দোলনসহ নানা আলটিমেটাম দিয়ে রীতিমতো হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছে বিএনপি। নানান সুযোগ ও ইস্যু থাকা সত্ত্বেও জনস্বার্থ ঘিরে গণআন্দোলন করতেও ব্যর্থ হয়েছে দলটি। নিজ দল ও নেতাদের স্বার্থকেন্দ্রিক আন্দোলনে ব্যস্ত বিএনপির নেতারা বক্তব্য বিবৃতিতে যতটা ‘বাঘ’, মাঠের আন্দোলনে ততটাই ‘বিড়ালের’ ভূমিকা প্রদর্শন করেছে। সরকার ও আওয়ামী লীগের শক্তি এবং কৌশল মোকাবিলায় ধোপে টেকেনি বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। এখন পর্যন্ত নিজেরা নির্বাচনে না আসাই তাদের একমাত্র ‘সফলতা’। কিন্তু এটা তাদের ক্ষমতার স্বপ্ন থেকে আরও ছিটকে দেবে।

তাদের উদ্দেশ্য ছিল পুলিশকে টাচ করবে, পুলিশ তাদের গুলি করবে। এটাই নেতাদের নির্দেশ ছিল। সেই নির্দেশ অনুযায়ী তাদের কর্মীরা পুলিশ হত্যা করেছে। কিন্তু পুলিশের যেটা করার ছিল; গুলি করা। পুলিশ কিন্তু গুলি করেনি। এখানেই তারা (বিএনপি) পরাজিত হয়ে গেছে আসলে।–মির্জা আজম

আরও পড়ুন>> ‘বিএনপির সঙ্গে ভারতের স্বার্থ মিলছে না’

Advertisement

অথচ করোনার ধাক্কা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে স্যাংশনস-পাল্টা স্যাংশনস, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য, ভোট নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ-স্যাংশনস এসবও কিছুটা কৌশলে সামলে নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। বিএনপি ও তার মিত্রদের আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করেছে। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানি এড়িয়ে এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির আশঙ্কা কাঁধে নিয়েই টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পথে দৌড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ।

যদিও দুই পক্ষই বলছে, দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা, দায়িত্ববোধ আর অধিকার রক্ষার জন্য তাদের কর্মসূচি। তাই নির্বাচন ঠেকাতে চলবে বিএনপির আন্দোলন আর সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় নির্বাচন করবে আওয়ামী লীগ।

আরও পড়ুন>> বিএনপিকে মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন, দুই বিবেচনায় গুরুত্ব

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক জাগো নিউজকে বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে গভীর ষড়যন্ত্র করছে বিএনপি-জামায়াত অপশক্তি। তাদের ষড়যন্ত্র নতুন নয়। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকেই তারা এ ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তারা বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র করছে। এর মধ্যে অবরোধ নামক প্রোগ্রাম দেওয়া হচ্ছে। অবরোধ তো হচ্ছে না। দেশের জনগণকে অবরুদ্ধ করা হচ্ছে। জনগণকে অবরুদ্ধ করে আসলে কেউ কোনোদিন রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিল করতে পারেনি। এখনো এদের অবরোধ জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে।’

Advertisement

নেতারা কাজ করছেন। তারা আত্মহুতি দেবে নাকি? সরকারের কৌশল যেমন পরিবর্তন হয় আমাদের আন্দোলনের কৌশলও পরিবর্তন হয়।- ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন

তিনি বলেন, ‘এদের আন্দোলন-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা তো কম। বিএনপি মাহুত ছাড়া হাতি। তাদের যে কে পরিচালনা করছে বা কীভাবে পরিচালনা হচ্ছে, আমরা সবাই জানি। বিএনপি আজ এমন একটি দলে পরিণত হয়েছে যে, সাপকে বিশ্বাস করা যায়, বিএনপিকে বিশ্বাস করা যায় না। ২৮ অক্টোবর তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবে বলেও বিশৃঙ্খলা করলো। সাংবাদিকদের ওপর হামলা করলো। পুলিশ পিটিয়ে মারলো। প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা চালালো। এখনো তারা জ্বালাও-পোড়াও চালিয়ে যাচ্ছে। শতাধিক গাড়ি তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। কার গাড়ি জ্বালালো, কীসের জন্য? এ প্রশ্ন তো বিএনপির কাছে আমরা করতেই পারি। এই গাড়ি জ্বালিয়ে কী ফায়দা?’

‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকার পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে, একই সঙ্গে তাদের সব নেতাকে গ্রেফতার করেছে?’ বিএনপির অভিযোগ স্মরণ করে দিলে আওয়ামী লীগের সিনিয়র এ নেতা বলেন, ‘গ্রেফতারের বিষয়টি যেমন দেখছেন। তার আগে যদি দেখেন, বিএনপি কিন্তু সারাদেশে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করেছে। সেটা সরকারের সহযোগিতা নিয়েই করেছে। তারপর আসেন ২৮ অক্টোবর। এদিন তারা ও আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার শর্তেই অনুমতি পেয়েছি। কিন্তু তারা লঙ্কাকাণ্ড করলো। আমরা ঠিকই শান্তি সমাবেশ করেছি। তারা কিন্তু বিশৃঙ্খলা করেছে। গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আমাদের পাহারা নির্বাচন পর্যন্ত চলবে।’

কী ছিল ম্যাজিক কণ্টকাকীর্ণ এই পথ পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে? জবাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জাগো নিউজকে বলেন, ‘টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতার কালে শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, দারিদ্র্য বিমোচনে অসামান্য সফলতা অর্জিত হয়েছে। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে। বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্রনেতা শেখ হাসিনা পরম সফলতা প্রদর্শন করেছেন।’

আরও পড়ুন>> ‘পুরোনো ফরম্যাট’ ধরেই এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ!

‘বর্তমান অস্থির বিশ্বে আমাদের নেতা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানচিত্রের সীমানা অতিক্রম করে আজ বিশ্বের নির্যাতিত মুসলমানদের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ফলে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে শেখ হাসিনা আজ এক আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার পরও শেখ হাসিনা ম্যাজিকের কারণেই বিরোধী দলগুলো আহুত আন্দোলনে জনগণ, এমনকি তাদের সমর্থকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারছে না। জনবিচ্ছিন্ন আন্দোলন কখনো সফল হয় না।’

বিএনপি কৌশলে পরাজিত দাবি করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, ‘বিএনপি যে টানা অবরোধ কর্মসূচিতে যাবে এবং তাদের পুরোনো কায়দায় জ্বালাও-পোড়াও শুরু করবে, সেটা আমরা জানতাম। সে কারণেই ২৮ অক্টোবর যাতে তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের সহিংসতায় লিপ্ত না হয় আওয়ামী লীগ, সেজন্য আমরা সতর্ক ছিলাম। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পুলিশকে টাচ করবে, পুলিশ তাদের গুলি করবে। এটাই নেতাদের নির্দেশ ছিল। সেই নির্দেশ অনুযায়ী তাদের কর্মীরা পুলিশ হত্যা করেছে। কিন্তু পুলিশের যেটা করার ছিল; গুলি করা। পুলিশ কিন্তু গুলি করেনি। এখানেই তারা (বিএনপি) পরাজিত হয়ে গেছে আসলে।’

তিনি বলেন, ‘তাদের অবরোধ কর্মসূচি যেটা দিয়ে যাচ্ছে, এটা কিন্তু ভোতা অস্ত্র। এতে কাজ হয়নি। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দল হিসেবে বিএনপির কার্যক্রম হয়ে গেছে নিষিদ্ধ সংগঠনের মতো, সর্বহারা পার্টির মতো। তারা নিজেরা দাবি করে, এক কোটি কর্মী আছে তাদের, তাদের হাজার হাজার নেতা। কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এখন আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে আইএসআইয়ের মতো। তারা ভিডিও বার্তা দেয়, ভিডিওতে কর্মসূচি দেয়। সারাদিন দেখা যায় না, সন্ধ্যার পর কয়েকটা গাড়িতে আগুন দেয়। এটা তাদের রুটিন ওয়ার্ক হয়ে গেছে।’

মির্জা আজমের দাবি, এটা (আন্দোলন) দিয়ে তারা নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না। সরকারেরও পতন ঘটাতে পারবে না। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে। সবশেষ আমাদের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় নেত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, আমাদের কর্মীরা যেভাবে রাজপথ পাহারা দিচ্ছে, এটা নির্বাচন পর্যন্ত রাখতে হবে। তারা (কর্মী) যেন উজ্জ্বীবিত থাকে, এজন্য আমাদের বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমকে জেলায় জেলায় গিয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠক করে নির্দেশনা দিতে বলেছেন।’

এদিকে, রাজপথের আন্দোলন ছেড়ে অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিও কলে কর্মসূচি ঘোষণা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নেতারা কাজ করছেন। তারা আত্মহুতি দেবে নাকি? সরকারের কৌশল যেমন পরিবর্তন হয় আমাদের আন্দোলনের কৌশলও পরিবর্তন হয়।’

তিনি বলেন, ‘জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ে আমাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ। তবে সরকার যদি এগিয়ে যায়, অ্যাগ্রেসিভলি। জনগণের আন্দোলন আরও শক্তিশালী হবে। আরও কঠোর আন্দোলন হবে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, সংসদে যেমন জাতীয় পার্টি দুই মেয়াদের ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল, রাজপথের বিরোধী দল দাবি করা বিএনপিও হাকডাকে বাঘের গর্জন দিয়ে বাস্তবে বিড়ালের ভূমিকা প্রদর্শন করেছে। জনগণের পক্ষে সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করার সক্ষমতা বা শক্তি প্রদর্শন করতে পারেনি। সরকার ও আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়েছে তারা। এভাবে চলতে থাকলে রাজনীতির এই খেলায় যেই জিতুক, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ।

এসইউজে/এএসএ/জেআইএম