দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়েছে, ভোট হবে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি। মনোনয়ন জমা দেওয়ার সর্বশেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী ট্রেনের বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনকালীন সময়কে যদি একটি ট্রেনের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে ট্রেন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছাড়ার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। নির্বাচনী ট্রেনে উঠতে হলে অবশ্যই ৩০ নভেম্বর মধ্যে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে হবে। তা না হলে নির্বাচনী ট্রেন মিস করবে। চলন্ত ট্রেন কারো অপেক্ষায় বসে থাকবে না, থাকার সুযোগও নেই।
Advertisement
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান। সেটি অনুযায়ী দেশ পরিচালিত হয়। সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে, নির্বাচন প্রকৃয়া কিভাবে সম্পন্ন হবে। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদের নির্বাচন সম্পর্কে বলা হয়েছে, মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; কিংবা অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হলেও সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। সে হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৯০ দিনের ক্ষণগণনা গত ১ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে গেছে। এবং ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন শেষ করার বাধ্যবাধকতা আছে। তা না হলে দেশ সাংবিধানিক সংকটে পড়বে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পথ হলো নির্বাচন। যেখানে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে।সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় ভোট করা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের হাতে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। এবিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যথার্থই স্পষ্ট করে বলেছেন, নির্বাচনের জন্য পরিস্থিতি অনুকূল হোক বা প্রতিকূল হোক-নির্বাচন করতেই হবে। পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে নির্বাচন হবে না-এ ধরনের কোনো ভূল ধারণা জনগণের মধ্যে যেন না থাকে, সেজন্য স্পষ্ট করে বলতে চাই-নির্ধারিত সময়ে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
দেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে, এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। যদি কোনো দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে সেটা সংশ্লিষ্ট দলের বিষয়। কিন্তু তা নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্তরায় নয়। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে, নির্ধারিত দিনের মধ্যে নিবন্ধিত ৪৪ টি দলের মধ্যে যেসব দল অংশগ্রহণ করবে তাদের নিয়েই নির্বাচন হবে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভিন্ন কিছু করার সুযোগ থাকবেনা।
Advertisement
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন।গণতান্ত্রিক বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী। তফসিল ঘোষণার পর সাধারণত নির্বাচন কমিশন নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী হন। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের অবশ্য কর্তব্য। আর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন যেকোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় যেকোনো দায়িত্ব পালনে নিয়োগ দিতে পারেন।
তফসিল ঘোষণার পর থেকে ফলাফল ঘোষণার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়া বিভাগীয় কমিশনার,মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার,জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও তাদের অধস্তন কর্মকর্তাকে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়া বদলি করা যাবে না। তবে কমিশন ইচ্ছে করলে যেকোনো কর্মকর্তাকে বদলি করতে পারবে। এসময়কালে কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারী নির্বাচন কমিশনের আদেশ-নির্দেশ পালনে বাধ্য থাকবে। এবং কেউ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চাকরিচ্যুতও করতে পারবে কমিশন।
তফসিল ঘোষণার পরই বর্তমান সরকার নির্বাচনকালীন সরকারে পরিণত হয়েছে। তারা শুধু রুটিন কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এসময় নির্বাচন আচরণবিধি অনুসারে সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা (প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার,ডেপুটি- স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদ) সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে কোনো অনুদান বরাদ্দ, ফলক উন্মোচন, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও ঘোষণা দিতে পারবেন না। এবং সরকারি কর্মসূচির সাথে নির্বাচনী কর্মসূচি চালাতে পারবেন না।
বাংলাদেশে আগে ১১ টি সংসদ নির্বাচন হয়েছে। যার মধ্যে স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানে অধীনে ১ টি ও স্বৈরশাসক এরশাদের অধীনে ২ টি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার অধীনে ৩ টি, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১ টি ও দলীয় সরকারের অধীনে ৪ টি নির্বাচন হয়েছে। এসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (প্রথম, সপ্তম, নবম, দশম, একাদশ) ৫ বার, বিএনপি (দ্বিতীয়,পঞ্চম,ষষ্ঠ, অষ্টম) ৪ বার ও জাতীয় পার্টি (তৃতীয়,চতুর্থ) ২ বার সরকার গঠন করে।
Advertisement
প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ, ভোট পড়েছিল ৫৪.৯ শতাংশ, মেয়াদ ছিল দুই বছর ছয় মাস। দ্বিতীয় সংসদ ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, ভোট পড়েছিল ৫১.৩ শতাংশ,মেয়াদ ছিল তিন বছর। তৃতীয় সংসদ ১৯৮৬ সালের ৭ মে, ভোট পড়েছিল ৬১.৪ শতাংশ, মেয়াদ ছিল, ১৭ মাস। চতুর্থ সংসদ ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ,ভোট পড়েছিল ৫২.৫ শতাংশ, মেয়াদ ছিল দুই বছর সাত মাস। পঞ্চম সংসদ ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ভোট পড়েছিল ৫৫.৪ শতাংশ, মেয়াদ ছিল চার বছর আট মাস। ষষ্ঠ সংসদ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, ভোট পড়েছিল ২৬.৫ শতাংশ, মেয়াদ ছিল ১১ দিন। সপ্তম সংসদ ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, ভোট পড়েছিল ৭৫.৪৯ শতাংশ,মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। অষ্টম সংসদ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর, ভোট পড়েছিল ৭৫ শতাংশ, মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর।
নবম সংসদ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর, ভোট পড়েছিল ৮৭ শতাংশ, মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। দশম সংসদ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি,ভোট পড়েছিল ৪০ শতাংশ, মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর ও একাদশ সংসদ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ভোট পড়েছিল ৮০ শতাংশ, মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। বিগত এগারটি নির্বাচন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একমাত্র শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারই প্রতিবার মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছে। বিএনপি একবার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলেও বাকি তিনবারই পারেনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন একটি মৃত ইস্যু। বিএনপিই ব্যবস্থাটিকে ধ্বংস করেছে। অসাংবিধানিক বলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ব্যবস্থাটি বাতিল করে দিয়েছে। বিএনপি জামায়াত জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল। নির্বাচন পন্ড করতে ব্যাপক সহিংসতা করা সত্ত্বেও নির্বাচনকে ঢেকাতে পারেনি এবং সে সরকার পূর্ণকালীন মেয়াদ সম্পন্ন করেছে। তারপর ২০১৮ সালে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে ড.কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি। ভোটে ব্যাপক ভরাডুবি হওয়ার পরে নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলেও নির্বাচিত সাংসদরা সংসদে যোগদান করে এবং সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট দ্বাদশ নির্বাচন পণ্ড করতে আগের মতোই জ্বালাও পোড়াও হত্যার রাজনীতি শুরু করেছে। তারা যতই সহিংসতা করার চেষ্টা করুক নির্বাচন বানচালের ক্ষমতা তাদের নেই। কারণ আন্দোলন করতে জনসমর্থন লাগে,যেটা বিএনপির নেই। কতিপয় দুর্বৃত্ত দ্বারা চোরাগোপ্তা হামলা করা, আর আন্দোলন এক কথা নয়। ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পন্থা হলো নির্বাচন। নির্বাচন ছাড়া তাদের বিকল্প নেই। তারা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলছে, সেটা তাদের আসল দাবি নয়। তাদের দাবি একটাই ক্ষমতায় যাওয়ার নিশ্চয়তা। এজন্যই তারা জনগণের উপর আস্থা না রেখে তাদের বিদেশি প্রভুদের পিছনে ছুটছে। তাতে কোনো ফল আসবে না, কারণ ক্ষমতার মালিক দেশের জনগণ।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।haldertapas80@gmail
এইচআর/এমএস