সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়েই আবুল হোসেন খান গোয়াল ঘরে যান। এটা তার নিত্যকার অভ্যাস। ধবলী আর লালী দুটো গাই তার। ওদের মা লাল বানু কিছুদিন আগেই গত হয়েছে। খুব চেষ্টা করেছেন আবুল হোসেন যাতে ওকে বাঁচানো যায়। বড় লক্ষ্মীমন্ত গাই তার। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। আবুল হোসেন গোয়াল ঘরে গিয়ে খুব অবাক হয়ে যান—সেকান্দার আজ গরুকে নাড়া কেটে দেয়নি! কিছুক্ষণ পরে ভাত হলেই ভাতের মাড়, ভুষি, খৈল একসাথে করে দেওয়ার কথা। হোসেন সাহেব মনে মনে ভাবছেন—কী অইল আইজগো ছ্যামড়ার! ও তো কাম-কাইজে ফাটকি দেয় না। হোসেন সাহেব গোয়াল ঘর থেকেই হাঁক দেন—সেকান্দার, সে-কা-ন্দা-র! কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। ঘরে এসে তিনি স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, জহিরের মা সেকান্দার কই? সাহানা তখন খুব ব্যস্ত। দশটার ভেতর তাকে রান্না শেষ করে স্কুলে যেতে হবে। সাত ছেলে-মেয়ে নিজেদের মতো খাবার নিয়ে খেয়ে চলে যাবে। সাহানা বলেন, আছে কোনোহানে দ্যাহেন। আমি কইতে পারি না। কিন্তু নাহ সেকান্দারকে কোথাও পাওয়া গেল না। আবুল হোসেন ধরে নিলেন পালিয়েছে ব্যাটা।
Advertisement
স্বামী-স্ত্রী দুজনই স্কুলে মাস্টারি করেন। একজন হাইস্কুলে, একজন প্রাইমারি স্কুলে। সাত ছেলে-মেয়ে। পাঁচ ছেলে, দুই মেয়ে। আছে দুটো গাই, পাঁচটা হাঁস আর দশটা মুরগি। কাজের মানুষ মিনারা বিয়ে হয়ে চলে গিয়েছিল। যখন আবার শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে আসে; তখন কাজ নিয়েছে সাহানার সেজ জায়ের ঘরে। স্বামী-স্ত্রী আর বড় মেয়েটার অমানসিক পরিশ্রম করতে হয় সংসারে। ঠিক তখন একদিন গোধূলি লগ্নে সাহানা যখন বাড়ির দক্ষিণ ধারে খড়ের গাদার কাছে দাঁড়িয়ে গাই দুটোকে দেওয়ার জন্য খড় বের করছিল; তখনই একটা মাঝারি উচ্চতার কালো বর্ণের ছেলে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, আম্মা মোরে কামে রাকপেন? সাহানা বলেন, থাকপি। তোর নাম কী? অই পক্ষের উত্তর আসে, জে, মোর নাম সেকান্দার। সেই সন্ধ্যা থেকে তিন মাস সেকান্দার হয়ে উঠেছিল এই পরিবারের রোদ্দুর আর জল। যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল আবুল হোসেন আর সাহানা দম্পতি। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ঘরে-বাইরে সমানতালে কাজ করে গেছে সেকান্দার। গরুকে ঠিকমতো খাবার দেওয়া, গোসল করানো, ঘরে শাহানার কাজে সাহায্য করা। তরকারি কাটা, মাছ কাটা, ক্ষেতে ধান কাটা হেন কোনো কাজ নেই সেকান্দার পারে না। সেই সেকান্দার কোথাও নেই, নেই তো নেই! আবুল হোসেন আর সাহানা দম্পতির একটাই আফসোস—ও যাইবেইগগা যাউক, কইয়া গ্যালে না ক্যা! গ্যালে কই!
০২রান্না করা থাকে। সাত ছেলে-মেয়ে নিজেদের মতো খাবার নিয়ে খায়। হাড়িতে নয় টুকরো মাছ থাকে। পরিবারের একেবারে ছোট সদস্যটিও জানে, সে এক পিসের বেশি খেতে পারবে না। কারণ অন্যজন খাবে। বড় মেয়ে নাহিদা স্কুল থেকে এসে আগে হাঁস-মুরগিকে খাবার দেয়। মাকে রান্নার কাজে সাহায্য করে। আবুল হোসেন মাঝে মাঝে মধ্যবর্তী সময়ে স্কুল থেকে এসে গরুকে খাবার দিয়ে যায়। আবুল হোসেন এবং সাহানা দুজনের স্কুলই বাড়ি সংলগ্ন। এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিন। হঠাৎ একদিন ছোট ছেলে অরুণ এসে বলে, আম্মো, আম্মো সেকান্দাইররা উই জোঙ্গলের মইদ্দে পলাইয়া রইছে! সাহানা জিজ্ঞেস করে, তুই দ্যাকছো? কোন জোঙ্গলে? অরুণ বলে, হ আম্মো মুই দেকছি। অই দহিনদার বাড়ির জোঙ্গলের অহানে। এরপর দেখা গেল সেকান্দার আরেকটু এগিয়ে এসেছে। বাড়ির উঠানের ঝোপের ভেতর বসে আছে।
আবুল হোসেন ডাক দেয়। জিজ্ঞেস করে তুই কই গেছিলি? আর কোম্মে আছিলি? সেকান্দারের সরল উত্তর, শায়র গেলহাম। অই আব্বা-আম্মার কতা মনে পড়ছেলে। হেইলইগগা গেছি। আবুল হোসেন জিজ্ঞেস করে, তুই আবার থাকপি? সেকান্দার বলে, হ আব্বা, মুই থাকমু। আবুল হোসেন আবার জিজ্ঞেস করে, তুই আবার পলাইয়া যাবি? সেকান্দার বলে, না আব্বা, মুই আর যামু না। সাহানা বলে, তুই কি শায়র অনেকদিন আলহি? সেকান্দার বলে, হ আম্মা, হ্যাগো ধারে মুই ছোডকাল অইতে আলহাম। সাহানা জিজ্ঞেস করে, তুই হেহাইনদা আইছ ক্যা হেলে? এবার সেকান্দার নিরুত্তর! সাহানা বলে, আবার যদি হ্যাগো তোর দ্যাকতে মনে লয় বা যাইতে মনে লয় হেলে তুই কইয়া যাবি বাবা। ঠিক আছে? পলাইয়া যাইস না। সেকান্দার বলে, না আম্মা মুই আর পলাইয়া যামু না।
Advertisement
০৩নব্বইয়ের দশকের এক সন্ধ্যার কথা বলছি। আবুল হোসেন আর সাহানা দম্পতি মাটির চুলায় রান্না করছে। আবুল হোসেন সেদিন দুইশ টাকায় এক হালি ইলিশ এনেছে, সাথে এনেছে মানকচু। সাহানা ইলিশ আর মানকচু মাখা মাখা ঝোলে রান্না করছে। সাথে মশুর ডাল পাতলা করে রান্না। ছেলেমেয়ে সবাই লেখাপড়া করতে বসেছে—পাউরুটিতে মাখনের প্রলেপ দিয়ে খেয়ে। সাহানা সেকান্দারকে পাঠিয়ে দেয়। বলে, যাইয়া দ্যাক তো তোর ভাইয়া আর আফারা কী করে? সেকান্দার গেলে সাহানা স্বামীকে জিজ্ঞেস করে, মাছ আনলেন টাহা পাইলেন কই? আবুল হোসেন বলে, টাহা এহন নাই, হেইলইগগা কী আমার পোলাপানে মাছ খাইবে না? টাহা যেসময় অইবে, হেইসময় দিমু। এহন পোলাপানরে খাওয়াইয়া লই। সেকান্দার চিৎকার করে বলে, আম্মা সেজ ভাইয়ায় দেইককা দেইককা ল্যাহে আর ছোড আফায় ঘুমায়। সাহানার সেজ ছেলে ফরহাদ বলে, আম্মো মুই অঙ্ক করিই। সাহানা বলে, দেইক্কা লেহে, লেহুক। তুই ছোড আফারে মশারি খাডাইয়া দে। রান্ধা অইলে আমি ঘুমে গোনে উডাইয়া খাওয়াইয়া দিমু হানে।
সাহানা সেকান্দারকে বলে দিয়েছে আমার পাঁচ পোলা, তুই আমার আরেক পোলা। আমার যা আছে ছয়ভাগ অইবে। তোর যা লাগে আমিই তো দিই। তোরে বেতন দেলে তুই কী করবি? তোর তো বাপ-মা কেও নাই! মনে করবি আমরাই তোর বাপ-মা। সেকান্দার বলে, আচ্ছা আম্মা। আম্মা মোর মনে লয় মুই বাড়িঘর বিরচাইতে যাই। সাহানা জিজ্ঞেস করে, কোতায় খুঁজবি? তোর কিছু মনে আছে? তোর শায়রের আব্বা-আম্মায় কিছু জানে? সেকান্দার বলে, না আম্মা হেরা জানে না। সাহানা বলে, আচ্ছা তুই আর ইট্টু বড় অ। হেরপর যাইস। কিন্তু যাবি কই? সেকান্দার বলে, মোর দাদির কতা মনে পড়ে। মুই ভান্ডাইররা যামু বাড়ি খোঁজতে।
একদিন বেলা এগারোটার দিকে অরুণ এসে বলে, আফা, আফা একটা কতা হোনেন। সাহানার বড় মেয়ে নাহিদা জিজ্ঞেস করে, কী কতা? অরুণ হাসতে হাসতে বলে, মোশাররফ হুজুররে সেকান্দাইররা পুকইরের উই দক্ষিণ পাশের আম গাছের লগে বাইন্দা থুইছে। নাহিদা জিজ্ঞেস করে, ক্যা? হুজুরে কী করছে? ল যাইয়া দেহি। নাহিদা গিয়ে দেখে, মোশাররফ হুজুর নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা। হুজুর হাসছে আর সেকান্দার হুজুরের চারপাশে নাচছে আর বলছে, হুজুর মানুষ মইররা গ্যালে লম্বা দুখানা ঠ্যাং, হালার ব্যাং, এত লাফাস ক্যান? নাহিদা জিজ্ঞেস করে, অ কি সেকান্দাইররা! হুজুররে বানছো ক্যা? হুজুর কী করছে? হুজুর সবাইরে কোরান শরীফ শিখায়। কত ভালো মানুষ! সেকান্দার বলে, আফা আইজগো ছাড়মু না। হুজুররে কইছি আবাহনী সাপোর্ট করতে। হেয় মহামেডান করছে। এহন ঠগছে। নাহিদা ধমক দেয়, সেকান্দার ছাড় কইলাম! তোর কিন্তু অনেক পাপ অইবে! হুজুর হাসে আর বলে, নাহিদা তুমি চিন্তা কইরো না। ছাড়বে আনে। ঘণ্টাখানেক পর ছেড়ে দেয় হুজুরকে।
নাহিদার প্রায়ই ডিসেন্ট্রি হয়, কিছু খেতে পারে না। সেকান্দার বাজার থেকে লুকিয়ে পরোটা এনে দেয়। সাহানার সাত ছেলে-মেয়ে সাতটা ছোট পাটি বিছিয়ে ভাত খেতে বসে। সেকান্দার বসে পিঁড়িতে। খেতে বসে সবাই সবজি ভাত বিড়ালকে দিয়ে দেয়। সেকান্দার যেন সাহানাকে বলে না দেয়। তাই সবাই প্লেট থেকে মাছ ঘুস দেয় সেকান্দারকে। যেদিন বিড়াল আসে না আশেপাশে। সবাই সেকান্দারকে বলে, তুই ভাত আর সবজি নে সেকান্দার। সেকান্দার বলে, না মুই খামু না ভাত। নাহিদা জিজ্ঞেস করে, মাছ খাবি? সেকান্দার বলে, হুউ। নাহিদা বলে, ক্যা তুই সবজি খাবি না, মাছ খাবি ক্যা? এভাবেই খুনসুটিতে বেড়ে ওঠে সাহানার ছেলেমেয়েরা আর সেকান্দার। তারপরও সে পালিয়ে সায়র গিয়েছে কয়েকবার। সবাই ধরে নিয়েছে ও এভাবে যাবে আর আসবে।
Advertisement
০৪বাড়ির উঠানে একটি খেজুর গাছের সাথে বেঁধে রেখেছে সেকান্দারকে। বেঁধেছে স্বয়ং আবুল হোসেন। কারণ সেকান্দার আবার পালিয়েছিল। আবুল হোসেন এর আগে বলে দিয়েছিল, তুই পলাইয়া গ্যালে আর আবি না। কিন্তু সেকান্দার তো সে কথা শোনার বান্দা না। দুপুর বারোটার সময় সাহানা বলে, ছ্যামড়ারে ছাইড়া দেন। এই রউদের মইদ্দে ছ্যামড়া কতখুন খাড়াইয়া থাকপে? আবুল হোসেন স্ত্রীকে বলে, তোমার আল্লাদেই ও নষ্ট অইছে! অর শাস্তি দরকার নাইলে ও ভালো অইবে না। সাহানা গিয়ে খুলে দেয় সেকান্দারকে।
ধীরে ধীরে সেকান্দার সাহানা আর আবুল হোসেনের সব আত্মীয়-স্বজনের ভালোবাসার পাত্র হয়ে ওঠে। সবাই সেকান্দারকে খুব স্নেহ করে, ভালোবাসে। কিন্তু পাড়া-পড়শি কারো কারো চোখে আবুল হোসেনের এই সুখ বড়ই বিরক্তিকর হয়ে উঠল! তারা সেকান্দারকে বলল, মাস্টারে তোরে আর কত গায়ে খাডাইবে? তোরে তো বেতন দেয় না। তোর ভবিষ্যৎ কী! সেকান্দার বলে, আম্মায় তো কইছে—মোরে জাগাজমিন দেবে। অইসব শুভাকাঙ্ক্ষীরা সেকান্দারকে বলে, তুইও যেমন বলদ! কইছে ওম্মেই তোরে জমিন লেইক্কা দেছে! আর দেবে? তুই বেতন চা।
সেকান্দার সাহানাকে বলে, আম্মা মুই ব্যাপসা করমু। কাঁচামালের ব্যাপসা। মোরে টাহা দ্যান। সাহানা বলল, আচ্ছা করবি অসুবিধা কী? খুব সকালে উইটটা তুই গোয়াল ঘর পরিষ্কার কইররা, গরুরে খাওন দিয়া যাবি গা। আবার দুহাইররা কালে আইয়া কাম-কাইজ কইররা খাইয়া-দাইয়া ইট্টু ঘুমাবি।
চার হাজার টাকা দেওয়া হলো সেকান্দারকে। চার হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে সেকান্দার নামল কাঁচামালের ব্যবসায়। প্রথম দিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে গোয়াল ঘরের কাজ শেষ করে সেকান্দার গেল সদরঘাট বাজার। বেলা দুইটার সময় বেচাকেনা শেষ করে ফিরল। ফিরে সাহানার কথা মোতাবেক কাজ-কর্ম করল, খাওয়া-দাওয়া করল। সন্ধ্যায় সাহানা বলল, কই সেকান্দার তুই কেনাবেচার ইসাব দে। সেকান্দার বলে, হ আম্মা দিমু। আম্মা জানেন আইজগো আডে (হাট) কী দেকছি? সাহানা জিজ্ঞেস করে, কী? অমনি খুব সিরিয়াস হয়ে উত্তর দেয়, সাদা, সাদা কী জানি দেখছি বিলাইইর মতো! ব্যাডা নাজানি মাতারি! অমনি নাহিদা হাসতে হাসতে বলে, সেকান্দাইররা তুই একটা কিইন্না আনতি! সেকান্দার বলে, অইদদা আমনে কী করবেন আফা? যা হোক, সাহানা হিসেব নিয়ে দেখে, সেকান্দার যে দামে কিনেছে সবজি; হয় সেই দাম নইলে কম দামে বিক্রি করে এসেছে। ছয়শ টাকার সবজি আর কাঁচা মরিচ কিনে মোট বিক্রি করেছে চারশ পঞ্চাশ টাকা। প্রথম দিন লস দেড়শ টাকা।
দ্বিতীয় দিন সাহানা বলল, তোরে যে খাতা দিমু তুই তো লেকতে-পড়তে পারস না। নাইলে খাতায় লেইক্কা আনতি কত দামে কিনছিস আর কত দামে বেচলি। হোন সেকান্দার যে দামে কিনবি; হের চাইতে দুই টাকা অইলেও বেশি দামে বেচপি। সেকান্দার বলল, ঠিক আছে আম্মা, মোর আর ভুল অইবে না। দ্বিতীয় দিন সেকান্দারকে পাঁচশ টাকা দেওয়া হলো। সেকান্দার এনে দিলো তিনশ টাকা।
ব্যবসার এক সপ্তাহের মাথায় আবুল হোসেন স্ত্রীকে বলল, মেট্টিক পাস মাইয়া মানুষ ডাইরিয়ার চাইতেও ভয়ংকর! দুনিয়ার হগলডিরেই নিজের পায় খাড়া করাইবে! বালডাও বোজে না, ভাব দেহায় ইন্দিরা গান্দী। চার হাজার টাকা থেকে পনেরোশ টাকা টিকল। এভাবে শেষ হলো সেকান্দারের ব্যবসা পর্ব।
০৫ততদিনে সাহানার বড় ছেলে আরাফাত কলেজ উঠে গেছে। সেকান্দর বলল, আম্মা মুই ভান্ডাইররা যামু বাড়িঘর খোঁজদে। সাহানা সম্মতি দিলো। দুই হাজার টাকা, বাড়ির ঠিকানা কাগজে লিখে, সাথে কিছু শুকনো খাবার দিয়ে সেকান্দারকে ছেড়ে দেওয়া হলো ভান্ডারিয়ার উদ্দেশ্যে। তিনদিন পর এক ভরসন্ধ্যায় সেকান্দার শুকনো মুখে বলল, আম্মা কেও কিছু কইতে পারে না। এরপর সাহানা মনস্থির করল, সেকান্দারকে মাসিক বেতন দেবে। বেতন স্থির হলো আটশ টাকা। সেকান্দারও বেজায় খুশি।
০৬ আবুল হোসেনের চাচাতো ভাই আরশাদ আলী। চাচা মতি খানের চার নাম্বার স্ত্রীর ঘরের ছেলে। সকলে ডাকে আশিদদা। আরশাদ আলী হেন কোনো অপকর্ম নাই, যা করে না। ছোট ছোট মেয়েদের বুকে হাত দেওয়া, লজ্জাস্থানে আঙুল প্রবেশ করানো, বিড়ি খাওয়া ইত্যাকার যাবতীয় বাজে কাজের ওস্তাদ। ইদানীং সেকান্দারকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় আরশাদ আলীর সাথে গাল-গল্পে মেতে উঠতে। হঠাৎ একদিন সেকান্দার বলল, আম্মা মুই রাজমিস্ত্রির জোগানদারের কাম করমু। আশিদদা কাক্কুর লগে কামে যামু। সাহানা বলে, তোর আব্বার লগে কতা কইয়া লই।
সারাদিনের সব ঝক্কি-ঝামেলা শেষ করে রাতে ঘুমাতে গিয়ে সাহানা স্বামীর কানে কথা তোলে। আবুল হোসেন তখন কেবলই সাহানার ব্লাউজের বোতাম খুলছে। সেকান্দার চলে যাবে শুনেই বলে, তোমার পাল্লক পোলারে ব্যবসায়ী বানাইলা না! বেডি মাইনসে বেশি বোজলে এমন অয়! অরে আর তুমি ঘরে রাকতে পারবা না। অর প্যাডে বাইরের পানি পড়ছে। ও দুনিয়া দেইক্কা হালাইছে। আর আশিদদা হালার পো হালায় আমার সর্বনাশটা কল্লে! জাউররার জন্মের জাউরা।
০৭ গরুর সাথে আবুল হোসেনের সুদীর্ঘ সম্পর্ক। আবুল হোসেন এবং সাহানা দুজনই ভাবে গরু, হাঁস-মুরগি ছাড়া গৃহস্থের ঘর কেমনে অয়! কিন্তু সেকান্দার চলে যাওয়ার পর আবুল হোসেন বড় গরু দুটো বিক্রি করে ছোট একটি দেশি কালো গরু কেনে। এরই মধ্যে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। বড় তিন ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছে।
একদিন ভরদুপুরে সাদা লুঙ্গি আর ঘিয়া রঙের শার্ট পরে এক আগন্তুক আসে। সেই স্বাস্থ্য নেই। শুকিয়ে গেছ অনেক। সাহানার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলে, কেমন আছেন আম্মা? মুই সেকান্দার। নাহিদা ছিল গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি। নাহিদাকে দেখে বলে, বড় আফা কেমন আছেন? সাহানা দ্রুত ভাত বেড়ে দেয়। কথায় কথায় জানা যায়, সেকান্দার সেই অবধি দুটো বিয়ে করেছে। দুই ঘরে তিন বাচ্চা হয়েছে। এক বউয়ের কথা আরেক বউ জানে না। শায়েস্তাবাদ কাজ করার সময় শায়েস্তাবাদ বিয়ে করেছে আর ভোলা কাজ করার সময় ভোলা বিয়ে করেছে।
০৮আরশাদ আলীর সাথে সেকান্দারের একবার দেখা হয়েছে মেহেন্দীগঞ্জে। তখন শুনেছে আরও একটি বিয়ে করেছে। সবশেষে একবার সাহানার সাথে ভরসন্ধ্যায় দেখা করে গেছে সেকান্দার। সেই অবধি তিনটি বিয়ে করেছে মহামতি সেকান্দার। আবুল হোসেন আর সাহানা দম্পতির সব ছেলেমেয়ে ঢাকায় বড় বড় কর্মকর্তা। আমৃত্যু সাহানা আফসোস করে গেছে, আহারে! কই গ্যালে সেকান্দাইররা। আবুল হোসেন স্ত্রীকে দায়ী করেছে আজীবন।
আবুল হোসেনের গ্রামের বাড়িতে পরে আছে বিশাল ঘর, ঘরে আসবাবপত্র কিছু কম নেই। আবুল হোসেনের ছেলেমেয়েরা ভাবে, আহারে সেকান্দারকে যদি পাইতাম! তাইলে ও বাড়ি থাকতো! জমিজমা চাষাবাদ করতো। সেই সময়ে ক্যামেরা এত সহজলভ্য ছিল না। বড় ছেলে সরকারের যুগ্ম-সচিব। ভাবে, যদি একটা ছবি থাকত! সব পত্রিকায় নিখোঁজ সংবাদ ছাপাতাম।
এই প্রযুক্তির যুগে, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ আর টুইটারের যুগে যখন সবাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আসন্ন নির্বাচন, দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি নিয়ে হতবিহ্বল। সেই সময় সাহানার সাত ছেলে-মেয়ের হৃদয়ে সেকান্দার এক গভীর ক্ষত হয়ে বিরাজ করে। সে একটি আলপিন হয়ে বিঁধে আছে তাদের হৃদয়ে। যা কেবলই সুতীব্র, প্রবাহমান বেদনার জোগানদার হয়ে বিরাজ করছে।
এসইউ/এমএস