এবারের বিশ্বকাপে চরম ব্যর্থ বাংলাদেশ। এ ব্যর্থতা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা, পর্যলোচনা। রাজ্যের কথাবার্তা চারদিকে। হেড কোচ, অধিনায়ক, ক্রিকেটার, কোচিং স্টাফ, টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচক প্যানেল আর বোর্ড- সবার দিকেই সমালোচনার তীর।
Advertisement
তবে এর মধ্যে বিসিবি, টিম ম্যানেজমেন্ট, হেড কোচ, কোচিং স্টাফ আর নির্বাচকদের নিয়েই কথাবার্তা বেশি। সাধারণ ক্রিকেট অনুরাগীদের বড় অংশ ওই জায়গাগুলোতে পরিবর্তনের দাবিতে সোচ্চার।
বেশিরভাগ ভক্ত ও সমর্থক হেড কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের ওপর ক্ষুব্ধ। তাদের কথা, হাথুরুসিংহে গত আট মাসের কোচিংয়ে দলকে ইতিবাচক কিছু উপহার দিতে পারেননি। তার দ্বিতীয়বার দায়িত্ব নেওয়ার পর দলের কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি বরং অবনতি ঘটেছে।
টিম ও ব্যক্তিগত পারফরমেন্সের গ্রাফ দিনকে দিন নিচে নামছে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন হাথুরু। সিনিয়রদের নানা ছলছুঁতো আর কৌশলে বাদ দিয়ে কমবয়সীদের দিয়ে দল সাজানোর চেষ্টায় ছিলেন এ লঙ্কান কোচ। যা ‘বুমেরাং’ হয়েছে।
Advertisement
পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি কমে বরং অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেড়েছে। সবমিলে একটা অস্থির ও অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে দলে। টাইগারভক্ত, সমর্থক ও অনুরাগীরা মনে করছেন, হাথুরুসিংহে বেশি দিন কাজ করলে উন্নতির চেয়ে অবনতিই ঘটবে। সিনিয়র-জুনিয়র রেষারেষি বাড়বে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দলও হবে ক্ষতিগ্রস্ত। তাই হাথুরুসিংহেকে বাদ দিয়ে নতুন হেড কোচ নিয়োগের দাবিই চারদিকে।
কিন্তু জানা গেছে, হাথুরুকে আপাতত সরানো হচ্ছে না। হেড কোচ হিসেবে অন্তত আরও এক থেকে দেড় বছর তিনি স্বপদে বহাল থাকছেন। কারণ তার সঙ্গে ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্ত চুক্তি করা আছে বিসিবির। সে চুক্তি ভেঙে তাকে বিদায় করতে গেলে চার-পাঁচ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হবে। তাই আপাতত হাথুরুর পদচ্যুতির কথা ভাবছে না বোর্ড।
হাথুরুসিংহেই শুধু নয়। বিসিবির পরিচালক ও শীর্ষ কর্তাদের মাথায় আপাতত কোচিং স্টাফে রদবদলের তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। কেউ থাকতে না চাইলে ভিন্ন কথা। যেমন, পেস বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড ও কম্পিউটার অ্যানালিস্ট শ্রীনিবাসন জানিয়ে দিয়েছেন, তারা আর চুক্তির মেয়াদ বাড়াবেন না। কিন্তু বিসিবি নিজ থেকে বর্তমান আট বিদেশি কোচের কাউকেই আপাতত বাদ দেওয়ার কথা বলেনি।
এদিকে ভেতরের খবর, কোচিং প্যানেলে রদবদলের চিন্তা না থাকলেও নির্বাচক কমিটি নিয়ে রীতিমতো সরব বিসিবি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিসিবির নীতিনির্ধারকদের মাথায় নির্বাচক কমিটিতে রদবদলের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।
Advertisement
কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, বোর্ডের আগামী সভায় টিম বাংলাদেশের বিশ্বকাপ পারফরমেন্স নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। তদন্তও হতে পারে। এর বাইরে বিসিবির বিশ্বকাপ পরবর্তী সভায় নির্বাচকদের পারফরমেন্সও পাখির চোখে পরখ করা হবে। জানা গেছে, বোর্ডের পরিচালক পর্ষদের একটা বড় অংশ নির্বাচক কমিটিতে পরিবর্তন চান।
যদিও আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্বাচকদের মেয়াদ আছে। কিন্তু তার আগেও কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। সেটা বোর্ডের পরবর্তী সভার ওপর নির্ভর করছে। জানা গেছে, পরিচালকদের বড় অংশ বিশেষ করে নীতিনির্ধারকদের একটা অংশ নির্বাচক কমিটিতে পরিবর্তনের পক্ষে।
প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর বদলে নতুন প্রধান নির্বাচক ও হাবিবুল বাশারের জায়গায় অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। তাদের কথার সারমর্ম হলো, এক যুগ ধরে নান্নু আর সুমন নির্বাচক। নতুন কাউকে দায়িত্ব দিয়ে দেখা যাক।
কিন্তু তারা এটাও স্বীকার করছেন যে, যোগ্য তেমন কাউকে পাওয়াও যাচ্ছে না। কারণ গত দেড় যুগে বিশেষ করে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর প্রধান নির্বাচক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। তাতে করে জাতীয় দলের সাবেক কোনো অধিনায়ক অথবা সাবেক নামি ও প্রতিষ্ঠিত পারফরমারদের মধ্য থেকেই প্রধান নির্বাচক বেছে নেওয়া হয়েছে।
জাতীয় দলের দুই সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ আর মিনহাজুল আবেদিন নান্নু সেই প্রক্রিয়াই চিফ সিলেক্টর হয়েছেন। জানা গেছে, এখন ফারুক আহমেদ বর্তমান বোর্ডের অধীনে আর কাজ করতে ইচ্ছুক নন। বিসিবিও তার ব্যাপারে তেমন উৎসাহী নয়।
এর বাইরে জাতীয় দলের তিন সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান, নাইমুর রহমান দুর্জয় ও খালেদ মাহমুদ সুজন বোর্ড পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর বাইরে জাতীয় দলের অপর তিন সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক হীরা, রকিবুল হাসান ও গাজী আশরাফ হোসেন লিপু বেশি সিনিয়র। তারা আগের মতো সময় করে নিয়মিত মাঠেও আসতে পারবেন কম।
আর গাজী আশরাফ লিপু এর আগে বোর্ড পরিচালক ও ক্রিকেট অপস প্রধান ছিলেন। তিনি প্রধান নির্বাচক পদে কাজ করতে রাজিও হবেন না। অন্যদিকে রকিবুল হাসান ম্যাচ রেফারিজ বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত। তিনিও ওই পদ ছেড়ে নতুন দায়িত্ব নিতে চাইবেন না।
বাকি দুজনারও প্রধান নির্বাচক হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনা খুব কম। বাকি থাকলেন খালেদ মাসুদ পাইলট, মাশরাফি বিন মর্তুজা আর মোহাম্মদ আশরাফুল। এর মধ্যে মাশরাফি জাতীয় সংসদ সদস্য। ক্রিকেটে নিবেদিতপ্রাণ হলেও বর্তমান অবস্থান বিচারে মাশরাফি প্রধান নির্বাচক হিসেবে কাজ করতে চাইবেন কি না, যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
ওদিকে ম্যাচ গড়াপেটার কালোদাগ আশরাফুলের গায়ে। তাকে প্রধান নির্বাচকের পদে বসাতে রাজি নন বোর্ডের বড় কর্তাদের বেশিরভাগ। খালেদ মাসুদ পাইলটের ব্যাপারে হাতেগোনা দু-একজন পরিচালকের উৎসাহ থাকলেও তার সম্ভাবনাও কম বলে জানা গেছে। কাজেই প্রধান নির্বাচক পদে নতুন কাউকে নিয়োগ দেয়ার আগে বোর্ডকে বেশ ভাবতে হচ্ছে।
কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্বশীল সূত্রের খবর, বোর্ডের বড় অংশ প্রায় মরিয়া যে, নির্বাচক পদে রদবদল করতেই হবে। প্রধান নির্বাচক নান্নু আর হাবিবুল বাশার একযুগ ধরে আছেন। তাদের বদলে নতুন মুখ চাই। ধারণা করা হচ্ছে, এ নিয়ে বিসিবির পরবর্তী সভায় রীতিমতো চায়ের কাপে ঝড় উঠতে পারে।
সে সভার ওপরই আসলে নির্ভর করছে নির্বাচক কমিটি প্রধান নান্নু ও তার দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা হাবিবুল বাশার সুমনের ভাগ্য। সে বোর্ড সভায় বেশি হৈ চৈ হলে হয়তো ৩১ ডিসেম্বরের আগেও এ দুজনকে অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে। তবে বোর্ডের আশপাশে জোর গুঞ্জন, নান্নু-সুমনকে নির্বাচক পদ থেকে সরিয়ে সমবেতনে বোর্ডের কোনো উচ্চপদে নিয়োগদানের সম্ভাবনা আছে।
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাবেক প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটারদের ভেতরে বেটার অপশন না পেয়ে বিকল্প খোঁজার চেষ্টায় বোর্ড। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধান নির্বাচক হিসেবে বাইরে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যত নামই উচ্চারিত হোক না কেন, এখনো সে অর্থে কারও দায়িত্ব প্রাপ্তি নিশ্চিত নয়।
সেটা ওই বোর্ড সভায় সবার মতামতের ওপরই নির্ভর করছে। তবে নির্বাচক প্রধান পদে প্রচলিত প্রক্রিয়ার বাইরে স্বনামধন্য কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিমের নামও উচ্চারিত হচ্ছে। তার নাম আলোচনায় উঠে আসার সম্ভাবনা প্রচুর। বোর্ডের কজন দায়িত্বশীল কর্তার মুখে ফাহিমের নাম শোনাও যাচ্ছে। তাই জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক না হয়েও মাঝের রীতি ভেঙে ফাহিম যদি প্রধান নির্বাচক হয়ে যান, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না!
এআরবি/এমএমআর/এমএস