# এডিস মশা বাংলাদেশে স্থায়ী হয়ে গেছে: কবিরুল বাশার# এখন বছরজুড়েই মশার আতঙ্ক, নিরুপায় ঢাকাবাসী# সিটি করপোরেশন মশা নিধনে ব্যর্থ, অভিযোগ নাগরিকদের
Advertisement
চলতি বছর ঢাকা শহরে এডিস মশার উপদ্রব অতীতের যে কোনো বছরের সব রেকর্ড ভেঙেছে। ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। তবে কীটতত্ত্ববিদদের দাবি, প্রকৃতপক্ষে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সরকারের হিসাবের দ্বিগুণের বেশি হবে। এছাড়া এখনো প্রতিদিন হাজারো মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে।
ডেঙ্গু হানার মধ্যেই রাজধানীতে বাড়ছে কিউলেক্স মশার উপদ্রব, যা নগরবাসীর মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। কিন্তু এ মশা নিধনে তেমন কোনো ভূমিকা চোখে পড়ছে না ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি)।
ডেঙ্গুরোগী বাড়ছেই, নতুন আতঙ্কের নাম কিউলেক্স মশা
Advertisement
আরও পড়ুন: ডেঙ্গুর রেশ না কাটতেই এবার কিউলেক্স মশার উপদ্রব
নাগরিকদের অভিযোগ, নাগরিক সেবায় সিটি করপোরেশনের যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে, তার মধ্যে মশা নিধন অন্যতম। কিন্তু এ কাজটিই ঠিকভাবে করছে না ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি। ফলে বছরজুড়ে এডিস ও কিউলেক্স মশার বিস্তার ঘটছে। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
মশা নিধন কার্যক্রম ঠিকভাবে করছে না ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি। ফলে বছরজুড়ে এডিস ও কিউলেক্স মশার বিস্তার ঘটছে। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা
তবে দুই সিটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, মশা নিধনে বছরজুড়েই কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারা। কিন্তু তারপরও মশা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। আগে শুধু বর্ষা মৌসুমে এডিস মশা জন্মাতো। এখন দেখা যায়, সারা বছরই মানুষের ডেঙ্গু হচ্ছে। আবার শুষ্ক মৌসুমের এডিস মশা বর্ষায় জন্মাচ্ছে। তারপরও এসব বিষয় মাথায় রেখে মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।
Advertisement
এখন বছরজুড়েই মশার উপদ্রব, অতিষ্ঠ নগরবাসী
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য মতে, গত ১১ নভেম্বর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৫১২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৩৩৮ জন। এভাবে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন মোট দুই লাখ ৯০ হাজার ৮৪ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা এক লাখ তিন হাজার ২২৭ জন, আর ঢাকার বাইরের এক লাখ ৮৬ হাজার ৮৫৭ জন।
আরও পড়ুন: বছরজুড়ে মশা মারলেও কমেনি উপদ্রব, নিরুপায় দুই সিটি
২০২২ সালে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এর আগে ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন।
ড্রোন ব্যবহার করেও নিধন করা যায়নি ঢাকার মশা
মশা নিধনে ডিএনসিসির যত উদ্যোগরাজধানীর ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ড। ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের বাজেটে নগরীতে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং এ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি কিনতে ১২২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় করা হয়েছিল ৬৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ টাকা দিয়ে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
মশা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। আগে শুধু বর্ষা মৌসুমে এডিস মশা জন্মাতো। এখন দেখা যায়, সারা বছরই মানুষের ডেঙ্গু হচ্ছে। আবার শুষ্ক মৌসুমের এডিস মশা বর্ষায় জন্মাচ্ছে
এর মধ্যে ডেঙ্গু নিধনে জনসচেতনতা তৈরিতে ডিএনসিসির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) ও জাতীয় স্কাউট দল। মূলত, তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম ও জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছে। এছাড়া যেসব ভবনে এডিসের লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, তাদের জরিমানা করছে ডিএনসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া মসজিদের ইমাম, স্কুল-মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়েও জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে সংস্থাটি।
বাড়ছে মশার প্রজনন, ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য
গত ২৩ জুলাই মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে গবেষণার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে ডিএনসিসি। সমঝোতার আওতায় ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কীটনাশকের কার্যকারিতা এবং মশার ঘনত্ব ও প্রজাতি বিশ্ববিদ্যালয়টির ল্যাবে পরীক্ষা করা হবে। আর পরীক্ষার মাধ্যমেই মশা নিধনে কীটনাশক প্রয়োগ ও যে কোনো ডিভাইসের ব্যবহার করে মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ে জনসচেতনতামূলক অধ্যায় যুক্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব করেছে ডিএনসিসি। এর মধ্যে স্কুল-কলেজে মশা নিধনে সচেতনতায় এক লাখ কার্টুন বই ফ্রি বিতরণ করেছে সংস্থাটি।
আরও পড়ুন: পাঠ্যপুস্তকে মশা নিয়ে অধ্যায় চায় ডিএনসিসি, মন্ত্রণালয়ে চিঠি
তবে এত কর্মসূচি বা উদ্যোগের পরও ঢাকা শহরে মশার প্রাদুর্ভাব কমছে না বলে অভিযোগ নাগরিকদের। উত্তরা চার নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা মাজহার আলী জাগো নিউজকে বলেন, আগে শুষ্ক মৌসুমে মশার আতঙ্ক ছিল। এখন সারা বছরই এডিস ও কিউলেক্স মশার আতঙ্কে থাকতে হয়। বর্ষা শেষ হতেই মশার উপদ্রব বাড়ছে। বিশেষত, সন্ধ্যায় দরজা-জানালা বন্ধ রাখলেও মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হতে হয়।
জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, মশা নিধন নিয়ে ডিএনসিসির আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু এত বড় কার্যক্রম নাগরিকদের সচেতনতা ছাড়া সফল করা সম্ভব নয়। তাই নিয়মিত লার্ভিসাইডিং ও এডিসের প্রজননস্থল ধ্বংসের পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান, ডিএনসিসির আওতাধীন এলাকার মসজিদ ও মাদরাসার এক হাজার ইমাম-খতিব, স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় সভা, ছাদবাগানে এডিসের লার্ভা শনাক্তে ড্রোনের ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া মশক নিয়ন্ত্রণে মশার প্রজাতি ও আচরণ নির্ণয় করে সঠিক, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে গবেষণা চলছে।
এডিস ও কিউলেক্স মশার চরিত্র বদলে গেছে। ফলে ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশে স্থায়ী। অর্থাৎ সারা বছরই এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু হবে। এটি আর শূন্যতে নামানো যাবে না। তবে চলতি (নভেম্বর) মাসের শেষ দিকে ডেঙ্গুর প্রবণতা কমবে
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জাগো নিউজকে বলেন, এডিস ও কিউলেক্স মশার চরিত্র বদলে গেছে। ফলে ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশে স্থায়ী। অর্থাৎ সারা বছরই এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু হবে। এটি আর শূন্যতে নামানো যাবে না। তবে চলতি (নভেম্বর) মাসের শেষ দিকে ডেঙ্গুর প্রবণতা কমবে।
আরও পড়ুন: মশার উৎস খুঁজতে ড্রোন অভিযান উত্তর সিটির
তিনি বলেন, এখন বর্ষা মৌসুম শেষ হয়েছে। বিভিন্ন ডোবা-নালা, ড্রেন, ঝিল বা খালে পানি কমে যাচ্ছে। সেখানে নোংরা পানিতে কিউলেক্স জন্মাচ্ছে। ফলে এখন থেকে আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত কিউলেক্স মশা বাড়তে থাকবে। মার্চে মশার উপদ্রব সবচেয়ে বেশি বাড়বে। এজন্য সিটি করপোরেশনকে আগে থেকেই মশা নিধনে গুরুত্ব দিতে হবে।
ডিএনসিসির মতো ডিএসসিসিও বছরজুড়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নানা কর্মসূচি পালন করেছে। ডিএসসিসির ৭৫টি ওয়ার্ডে নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানোসহ জনসচেতনামূলক কার্যক্রম চলছে। এখন এডিস মশা নিয়েও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। তবে ডিএনসিসির তুলনায় তাদের কর্মসূচি বা কার্যক্রম কম বলে জানিয়েছেন নাগরিকরা।
ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, মশা নিয়ন্ত্রণে ডিএসসিসির ৭৫টি ওয়ার্ডে সারা বছরই নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। এরই অংশ হিসেবে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও জরিমানা করা হচ্ছে। তবে ডিএসসিসির তালিকা অনুযায়ী এখন জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, মুগদাসহ ঢাকার আশপাশের এলাকায় মশার উপদ্রব বেশি।
জুরাইন এলাকায় জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নাগরিক আন্দোলনে যুক্ত মিজানুর রহমান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকার মধ্যে জুরাইন ও আশপাশের এলাকা সবচেয়ে অবহেলিত। এখানে খাল, নালা, ডোবায় সারা বছরই পানি জমে থাকে। এসব পানিতে এডিস, কিউলেক্স মশা জন্মায়। বর্ষা মৌসুম শেষ হলেও এখনো জুরাইনের বহু মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু রোগীর বাসায় গিয়ে মশা নিধন করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি
তিনি বলেন, জুরাইনে মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। এখানে সিটি করপোরেশনের লোকজন তেমন কাজ করে না। মশার উপদ্রবে এ এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ।
তবে নাগরিকদের অভিযোগ অস্বীকার করে ডিএসসিসি এলাকায় সবসময় মশা নিধনে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এডিস ও কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ডিএসসিসি। সে অনুযায়ী কার্যক্রম চলছে। তবে এখন যেসব এলাকায় ডেঙ্গুরোগী বেশি সেখানে জনবল বাড়ানো হয়েছে।
এমএমএ/এমকেআর/এমএস