মতামত

যে পথ শান্তি আর সম্প্রীতির

 

বিশ্বজুড়ে মানুষ আজ এক আতঙ্কের মাঝে দিনাতিপাত করছে। যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই আছে। বিশ্বমানবতা আজ মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন। বিশেষ করে ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বিশ্বের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে পড়েছে। মানবতার এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের প্রত্যেকের বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানবতাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে পারি।

Advertisement

আজ মানুষের জীবনের নেই কোনো নিশ্চয়তা। শান্তি যে পথে সে পথে না চলে মানুষ চলছে উল্টোপথে। বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত রাসুল করিম (সা.) যে যামানায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে যুগের অবস্থা কেমন ছিল সেই প্রেক্ষাপটকে সামনে রাখলেই কেবল মানুষ তার (সা.) জীবনের ঘটনাবলীর তাৎপর্য সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি করতে পারবে। যে সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে সময়ের সমস্ত লোক সামান্য কিছু সংখ্যকবাদে মোশরেক বা অংশীবাদী ছিল। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে আরব ছিল একটি পরস্পর বিরোধী গুণাবলী বিশিষ্ট জাতি। তাদের মধ্যে বহু মারাত্মক পাপের প্রচলন ছিল। মদের প্রতি সাংঘাতিক ভাবে আসক্ত ছিল আরবরা। মদের নেশায় বেহুঁশ হওয়া কিংবা মাতলামী করা তাদের নিকটে কোনো দোষণীয় ব্যাপারই ছিল না বরং তা প্রশংসার ব্যাপার ছিল।

কোনো অভিজাত ব্যক্তির আভিজাত্যের চিত্রসমূহের মধ্যে এই চিত্র থাকারও প্রয়োজন ছিল যে, তিনি তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীদেরকে জোর করে মদ খাওয়াবেন। ধনী ব্যক্তিদের জন্য জরুরি ছিল, দিনে পাঁচবার মদের আসর বসানো এবং এই ধরনের আসর ছিল তাদের জাতীয় ক্রীড়া।

জুয়া খেলাকে তারা বদান্যতা ও গৌরবের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। যুদ্ধের সময় তারা জুয়ার মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা সংগ্রহ করতো। সেই যুগে নারীদের কোনো অধিকার ছিল না। কোনো কোনো জাতির মধ্যে পিতা কর্তৃক আপন কন্যাকে হত্যা করাটা সম্মানের বিষয় ছিল। সেই যুগে দাস প্রথা একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল। তারা আশ-পাশের গোত্রের লোকজন ধরে এনে গোলাম বানিয়ে রাখতো। গোলামদের কোনো হক বা অধিকার ছিল না। প্রত্যেক মালিক তার গোলামের সাথে যেমন খুশি ব্যবহার করতো। এতে কোনো প্রকার বাধ্যবাধকতা ছিল না। এমনকি হত্যা করলেও কেউ কোনো অভিযোগের সম্মুখীন হতো না। দাসীদের সাথে যৌনাচার মালিকদের জন্য বৈধ বলে স্বীকার করা হতো। দাসীদের সন্তানরাও গোলামরূপে গণ্য হতো। নিজের ঔরসজাত সন্তানের মা হলেও দাসী দাসীই থাকতো।

Advertisement

উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে জন্মগ্রহণ করেন মানবতার সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। বাল্যকাল থেকেই তার প্রকৃতিতে মানবের কল্যাণ করার বৈশিষ্ট পরিলক্ষিত হতো। মানুষের লড়াই ঝগড়ার মধ্যে তিনি কখনও নিজেকে জড়াতেন না। বরং লড়াই ও কলহ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টাই করতেন।

প্রথম কুরআনি ওহী যখন অবতীর্ণ হয়েছিল মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপরে তখন তিনি হজরত খাদিজার (রা.) কাছে এলেন। তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। তিনি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। হজরত খাদিজা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে’? তিনি পুরো ঘটনার বর্ণনা দিলেন এবং বললেন, ‘আমার মত দুর্বল মানুষ এত বড় বোঝা কেমন করে বইবে?’

হজরত খাদিজা (রা.) বললেন, ‘খোদার কসম!’ এই বাণী আল্লাহতায়ালা আপনার ওপর এজন্য নাজিল করেন নি যে, তিনি আপনাকে অযোগ্য ও অকৃতকার্য প্রমাণিত করবেন এবং আপনার সঙ্গ ছেড়ে দিবেন। খোদা কি কখনও এমন করতে পারেন? আপনি তো সেই ব্যক্তি যিনি আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে উত্তম আচরণ করেন, গরীব ও অসহায় ব্যক্তিদেরকে সাহায্য করেন, তাদের বোঝা নিজে বহন করেন। যে চরিত্রগুণ এদেশ থেকে উঠে গেছে তা সবই আপনার মাধ্যমে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আপনি অতিথির সেবাকারী, দুঃখী মানুষের সহায়তাকারী। এই রকম মানুষকে কি আল্লাহতায়ালা কখনও পরীক্ষার মধ্যে ফেলে রাখতে পারেন?

শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষা দেখুন, একবার এক জিহাদের ময়দানে উসামা বিন যায়েদ (রা.)-এর সঙ্গে এক ব্যক্তির লড়াই হচ্ছিল। উসামা বিন যায়েদ লোকটিকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন এবং হত্যা করতে উদ্যত হন। এমন সময় অবিশ্বাসী লোকটি সম্পূর্ণ কলেমা নয় বরং এর প্রথমাংশ পাঠ করে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়। তথাপি উসামা তাকে হত্যা করেন।

Advertisement

ঘটনাটি হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর কাছে রিপোর্ট করা হলে তিনি (সা.) উসামাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, সে ইসলাম গ্রহণ করার পরেও তুমি তাকে কেন হত্যা করলে? উত্তরে উসামা বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! সে তো প্রাণের ভয়ে ইসলাম কবুল করেছিল? হজরত রাসুল করিম (সা.) তখন বলেছিলেন ‘তুমি কি তার হৃদয় ফেড়ে দেখেছিলে, সে সত্য সত্যই ইসলাম গ্রহণ করেছিল, না প্রাণের ভয়ে এ কথা উচ্চারণ করেছিল?

রাসুলে পাক (সা.) অতঃপর বলতে লাগলেন, কাল হাশরের ময়দানে আল্লাহর সামনে তুমি কি করে তোমার কাজকে সঠিক সাব্যস্ত করবে? হজরত রাসুল করিম (সা.) বলেন, যখন কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে তখন তুমি কি করবে? রাসুল করিম (সা.)-এর এরূপ ভয়ানক অসন্তুষ্টি দেখে উসামা ভীষণ ঘাবড়ে যান আর হজরত রাসুলে পাক (সা.) তখনও ঐ কথাই বার বার বলছিলেন যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ যখন তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে, তখন তুমি কি করবে? উসামা পরে বলেছিলেন, ‘হায়! আমি যদি এই ঘটনার পরে ইসলাম গ্রহণ করতাম’।

এই ঘটনা এবং আরও নানা ঘটনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, বলপূর্বক মুসলমান বানানো ইসলামি ‘জিহাদে’র উদ্দেশ্য কখনই ছিল না এবং সে যুগে বলপূর্বক কাউকে মুসলমান করাও হয়নি, কোনো যুদ্ধ বন্দীকেও না। ইসলাম কখনও তরবারির দ্বারা প্রসার লাভ করেনি, ইসলাম প্রসার লাভ করেছে হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর উন্নত আদর্শ, মানব প্রেম, তবলিগ ও ক্ষমার অনুপম দৃষ্টান্তের মাধ্যমে।

হাদিসে উল্লেখ রয়েছে-হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আওফা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘হজরত রাসুল করিম (সা.) কখনও বিধবা ও অভাবী লোকদের সাহচর্যকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতেন না আর তাদেরকে এড়িয়েও চলতেন না। বরং তিনি তাদের অভাব মোচন করে দিতেন’ (মসনাদ দারেমি)।

হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘হজরত রাসুল করিম (সা.) কখনও কাউকেও প্রহার করেননি- না কোনো মহিলাকে, না কোনো খাদেমকে, যদিও তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছেন। যদি তিনি কখনও কারও দ্বারা কষ্ট পেতেন তবুও তিনি তার প্রতিশোধ নিতেন না। কিন্তু যখন আল্লাহর বর্ণিত পবিত্র স্থানসমূহকে অপবিত্র করা হত তখন তিনি আল্লাহতায়ালার জন্য এর প্রতিশোধ নিতেন’ (মুসলিম)।

হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল করিম (সা.) গোলামদের সাথে আহার করতেন এবং গম ভাঙ্গানোর সময় গোলামরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি তাদের সাহায্য করতেন। বাজার হতে জিনিসপত্র ঘরে বহন করে নিয়ে যাওয়াকে তিনি হেয় মনে করতেন না। ধনী দরিদ্রের সঙ্গে একই ভাবে মুসাফাহা (করমর্দন) করতেন। সর্বপ্রথম সালাম করতেন। তিনি কোন নিমন্ত্রণকে অবজ্ঞা করতেন না যদিও বা সেই নিমন্ত্রণ শুধু খেজুরের হতো। তিনি দুঃখীদের পরিত্রাণ দান করতেন। তিনি কোমল চরিত্রের (হৃদয়ের) অধিকারী ও দয়ালু ছিলেন। তার আচার-ব্যবহার উত্তম ছিল” (মিশকাত)।

আল্লাহতায়ালা মহানবির (সা.) মাধ্যমে ন্যায়ের তুলাদণ্ড তুলে ধরেন এবং ইনসাফ ও রহমতের শাসন কায়েম করেন যার ফলে তিনি (সা.) ঘোষণা করলেন- কারো ওপরে আর জুলুম হবে না। ধর্মের ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ থাকবে না, জবরদস্তি থাকবে না। নারী ও ক্রীতদাসের প্রতি যে জুলুম করা হচ্ছে, তা শেষ করা হবে এবং শয়তানের হুকুমতের স্থলে এক আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হবে। ঠিক এমনই হলো, জুলুম অত্যাচারের রাজত্বের পর দলে দলে লোকেরা রাসুল করিম (সা.)এর আদর্শ দেখে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন।

মুসলমানরা একের পর এক বিজয় হতে লাগলো। মদিনার পৌত্তলিকরাও ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে মুসলমানদের অন্ধকার রজনী কেটে গেল, উদিত হলো নতুন সূর্যের, মক্কা মুসলমানদের অধীনে চলে আসলো। অল্পদিনের মধ্যেই সারা আরবে ইসলামি পতাকা পত পত করে উড়তে থাকলো।

এতো অল্প সময়ে মধ্যে ইসলামের বিজয়ের পিছনে কোন শক্তি কাজ করেছিল? এর মূল শক্তি হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর মানব প্রেম, উন্নত আদর্শ, ক্ষমার অনুপম দৃষ্টান্ত ও দোয়ার কল্যাণে ইসলামের বিজয় ও অন্ধকার যুগকে আলোকিত করেছিল। মহানবির আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। মহানবির অনুপম শিক্ষা ও আদর্শই শান্তি ও সম্প্রীতির একমাত্র পথ।

আল্লাকপাক বিশ্ববাসীকে মহানবির অনুপম আদর্শ অনুসরণ করে জীবন পরিচালনার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক।

এইচআর/এমএস