অধ্যাপক এম এম আকাশ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। চেয়ারম্যান, ব্যুরো অব ইকোনমিকস রিসার্চ। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। রাজনীতি, আসন্ন নির্বাচন, বিদেশি তৎপরতার প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
Advertisement
জাগো নিউজ: আগের পর্বে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চারটি বিদেশি শক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র। এবার ভারত কী ভূমিকা রাখতে পারে?
এম এম আকাশ: বাংলাদেশে ভারতের দুটি স্বার্থ। একটি হচ্ছে, বাংলাদেশ যেন চীনের দিকে না যায়। চীন ভারতের শত্রু। যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে ভারত অত চিন্তিত নয়। আরেকটি স্বার্থ হচ্ছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে যেন বাংলাদেশ ইন্ধন না দেয়। এই দুটি কারণে বিএনপির সঙ্গে ভারতের স্বার্থ মিলছে না।
আরও পড়ুন>> প্রথম পর্ব/ আওয়ামী লীগ–বিএনপি আলোচনায় না বসলে সংকট বাড়বে
Advertisement
জাগো নিউজ: বিএনপি কি আগের অবস্থানে আছে ভারত প্রসঙ্গে?
এম এম আকাশ: বিএনপি এখন ভারতকে বোঝাতে চাইছে যে তারা অতীতের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় দেবে না। আমার কাছে মনে হচ্ছে প্রত্যেকেই তাদের অবস্থান বদলাচ্ছে। সবাই বৈদেশিক শক্তি নিজের পক্ষে আনার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগও অবস্থান বদলাচ্ছে। কারণ শেখ হাসিনা আগে কখনই আমেরিকার বিরুদ্ধে এভাবে আক্রমণ করে কথা বলেননি।
বাংলাদেশে ভারতের দুটি স্বার্থ। একটি হচ্ছে, বাংলাদেশ যেন চীনের দিকে না যায়। চীন ভারতের শত্রু। যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে ভারত অত চিন্তিত নয়। আরেকটি স্বার্থ হচ্ছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে যেন বাংলাদেশ ইন্ধন না দেয়। এই দুটি কারণে বিএনপির সঙ্গে ভারতের স্বার্থ মিলছে না।
জাগো নিউজ: সেটা কি রাশিয়ার কারণে?
Advertisement
এম এম আকাশ: বাংলাদেশের নির্বাচনে রাশিয়া তেমন হস্তক্ষেপ করে না। চীন হাসিনাকে নির্বাচন নিয়ে ব্লাঙ্ক চেক দিয়েছে।
জাগো নিউজ: এই ব্লাঙ্ক চেক যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকানোর জন্য?
এম এম আকাশ: একদম। চীন চায় না যুক্তরাষ্ট্র এখানে আসুক।
জাগো নিউজ: তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এখানে কী করতে পারে?
এম এম আকাশ: ভারত না চাইলে যুক্তরাষ্ট্র এখানে কিছুই করতে পারবে না।
জাগো নিউজ: তার মানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কূটনীতিতে সফল?
এম এম আকাশ: অবশ্যই শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে সফল বলে মনে করি। সফল না হলে ক্ষমতায় থাকতেই পারতেন না। এটি অবশ্য নির্ভর করছে আমেরিকা-ইউরোপ তাকে কতটুকু নাজেহাল করে তার ওপর।
জাগো নিউজ: আর কী করার আছে?
এম এম আকাশ: গার্মেন্ট সেক্টরে স্যাংশনস দিতে পারে। কোটা তুলে দিতে পারে। চীনকে যেমন দেয়। ভারত যদি বাংলাদেশ থেকে সরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে তাহলে পশ্চিমারা যে কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারে।
আরও পড়ুন>> ‘একতরফা নির্বাচন হলে সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে’
জাগো নিউজ: ভারত তো আর যাবে না।
এম এম আকাশ: ভারত আওয়ামী লীগের বাইরে যাবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ যেন মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে তার জন্য চাপ দিতে পারে।
জাগো নিউজ: এই চাপ আওয়ামী লীগ কীভাবে নেবে?
এম এম আকাশ: গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পরাজয় ঘটবে এটি আমিও মনে করি। দশ বছরের অধিক সময় ক্ষমতায় থাকলে মানুষ বিপক্ষে চলে যায়। দ্রব্যমূল্য, মূল্যস্ফীতি, পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ সরকারের জন্য বিশেষ বার্তা বলে মনে করি।
গার্মেন্ট সেক্টরে স্যাংশনস দিতে পারে। কোটা তুলে দিতে পারে। চীনকে যেমন দেয়। ভারত যদি বাংলাদেশ থেকে সরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একত্মতা ঘোষণা করে তাহলে পশ্চিমারা যে কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারে।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশের এসব ইস্যু ভারতের কাছে গুরুত্ব পায়?
এম এম আকাশ: এসব কারণে গণবিস্ফোরণ ঘটলে ভারতের জন্য বুমেরাং হতে পারে। এটি ভারত অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করছে। আওয়ামী লীগের বিকল্প এখানে এরশাদ থেকেছে। এবার ১/১১ এর মতো ঘটনা ঘটলে কে আসবে তা বলা মুশকিল। যদি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হয় এবং পশ্চিমারা যদি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয় তাহলে সংকট স্থায়ী রূপ নেবে। তখন নতুন যে শক্তি আসবে তারা ভারতপন্থি নাও হতে পারে।
জাগো নিউজ: এমন পরিস্থিতি দেখছেন?
এম এম আকাশ: হ্যাঁ। দুই পক্ষ আপস না করলে নতুন শক্তি আসবেই। বাংলাদেশ তো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বিদেশি ঋণ নেওয়া আছে। চাপ আছে। গার্মেন্ট ব্যবসা আছে। হরতাল-অবরোধ হচ্ছে। দেশ তো ভালো নেই।
জাগো নিউজ: হরতাল-অবরোধ আগেও করেছে বিএনপি জোট। ফল পায়নি।এম এম আকাশ: তখন তো সাধারণ মানুষ নামেনি।জাগো নিউজ: সাধারণ মানুষ নামবে কেন? কার জন্য নামবে?এম এম আকাশ: আমার স্যার আনিসুজ্জামান একটি উদাহরণ দেন। একটি নেকড়ে গলায় খামছে ধরছে। দূরে আরেকটি বাঘ বসে আছে। নেকড়েকে সরিয়ে দিলে বাঘ এসে খাবে। তখন আমি কী করবো? আমাকে উপস্থিত বিপদ থেকেই রক্ষা করতে হবে। পরের বিপদ পরে দেখা যাবে। কিন্তু মানুষ এখন পর্যন্ত বাঘের ভয় করছে। পরিস্থিতি আরও অবনতি হলে তখন আর বাঘের ভয় করবে না।
আরও পড়ুন>> ছাড় না দিলে সমাধান হবে কীভাবে?
আওয়ামী লীগ যদি সুশাসন কায়েম করতে পারে, বৈষম্য দূর করতে পারে, প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে, লুটপাট কমাতে পারে তাহলে ১০ শতাংশ ভোট পড়লেও অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে না। সাধারণ মানুষ ভালো থাকলে সরকারের ওপর চাপ কমে। শ্রীলঙ্কায় যা ঘটলো। বিএনপিকে বাইরে রেখে সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ তো জিতবেই।
জাগো নিউজ: এমন জেতায় কতদূর যেতে পারবে?
এম এম আকাশ: এটি নির্ভর করবে বিদেশি শক্তি মেনে নেয় কি না? যদি ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র বলে আওয়ামী লীগ তো ভোট নিয়ে কোনো দুর্নীতি করেনি তাহলে আগের মতোই বৈধতা পেতে পারে। তবে এর জন্যও সম্মানজনক ভোটের হার হতে হবে।
শেখ হাসিনা একশ আসন ছেড়েও দিতে পারেন। যেমন ২০১৮ সালে ৮০টি আসন ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল বলে শুনেছিলাম। ড. কামালকে নেতা মেনে বিএনপিও ওই নির্বাচনে অংশ নিলো। যদিও আওয়ামী লীগ তার ওয়াদা রক্ষা করতে পারেনি। হাসিনার অনুসারীরাই তার নির্দেশ মানেননি।
আওয়ামী লীগের সে সমস্যা এখন নেই। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ছাড়া একটি নির্বাচনের আয়োজন করবে। কিন্তু মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হচ্ছে কত শতাংশ ভোট পড়ে। তখন বিদেশিদের অবস্থান পরিষ্কার হবে।
জাগো নিউজ: তার মানে বিদেশিদের ওপরই সব নির্ভর করছে?
এম এম আকাশ: অনেকটা তাই। তবে ভোটার হার গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ হয়তো টিকে থাকবে। কিন্তু নৈতিক বৈধতা পাবে না।
জাগো নিউজ: এই ‘টিকে থাকা’ কতদিন?
এম এম আকাশ: অর্থনীতির বকেয়া কাজগুলো যদি টিকঠাক করতে পারে, যদি অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে পারে তাহলে টিকে থাকতে পারবে। আর যদি এ সংকট দূর করতে না পারে তাহলে বিদেশিরা সমর্থন দিলেও টিকে থাকতে পারবে না।
জাগো নিউজ: এবার শেখ হাসিনার সরকার টিকে গেলে বিএনপির জন্য কী পরিণতি অপেক্ষা করছে?
এম এম আকাশ: বিএনপির পরিণতির জন্য আরেকটু সময় অপেক্ষা করতে হবে। বিএনপিও নানা উইংসে ভর করে রাজনীতি করে। তারাও শক্তিশালী।
জাগো নিউজ: বলা হয়, আওয়ামী লীগ যতবার সংকটে পড়েছে, সিপিবি ততবার পাশে দাঁড়িয়ে সুরক্ষা দিয়েছে। এর বিপরীতে আপনি কী বলবেন?
এম এম আকাশ: ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে আমাদের মিত্রশক্তি ভেবেছি। আমরা বঙ্গবন্ধু সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পরে আওয়ামী লীগের শ্রেণি চরিত্র বদলে যাওয়ার কারণে আমরা কোনো আনুষ্ঠানিক গণঐক্যজোট করিনি।
জিয়াউর রহমানকে আমরা সীমিত অর্থে জাতীয়তাবাদী বলতাম। ফরহাদ ভাই ও মানিক ভাইয়ের আমলে আমরা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলাম। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আমরা সবাই সবাইকে রক্ষা করেছি।
আমাদের আত্মসমালোচনা হচ্ছে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আমরা বিপ্লবী সময় বলেছিলাম। এটি বাড়তি বলেছিলাম। তখন যদি আমরা ন্যাপকে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে চেষ্টা করতাম তাহলে জাসদের জন্ম হতো না এবং ’৭৫-এর প্রতি বিপ্লব থেকে হয়তো কিছুটা রক্ষা পেতাম। সেই বিতর্ক থেকে আমরা শিক্ষাও নিয়েছি।
আমাদের আরেকটা ভুল ছিল এরশাদ আমলে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা। এটি ঠিক হয়নি। যে ছয়জন নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারা শেষ পর্যন্ত আমাদের দলে থাকেননি। তারা আওয়ামী লীগে চলে যান।
’৯০-এর পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, স্বতন্ত্রভাবে আন্দোলন এবং নির্বাচন করে যাবো। সিপিবি মনে করে আওয়ামী লীগ-বিএনপি একই চরিত্রের। ক্ষমতা আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপির কাছে গেলেও নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না। আমরা পৃথক বিকল্প শক্তির কথা বলছি। এর মধ্যে বামপন্থিদের কেউ মনে করছে বিএনপি ভালো, কেউ মনে করছে আওয়ামী লীগ ভালো। বামপন্থিদের অনেকেই দুই জোটে ভর করছে। সিপিবি খাঁটি বাম ধারায় বিকল্প শক্তির অপেক্ষায়।
এএসএস/এএসএ/জেআইএম