মতামত

তাঁকে তাঁর মত থাকতে দিন

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন-ক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে নির্বাচন নিয়ে জল্পনা-কল্পনার তত বেশি বাঁধভাঙ্গা জোয়ার বইছে। প্রত্যেকের কাছেই নির্বাচন নিয়ে একেকটা ফর্মুলা আছে। নির্বাচন ডিসেম্বর না জানুয়ারিতে সেই আলোচনা শেষ হলেও জরুরি অবস্থা আসছে কি আসছে না থেকে শুরু করে অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে শুরু করে নির্বাচনকালীন সরকার এ সবই আছে আলোচনার টেবিলে।

Advertisement

গণতান্ত্রিক সমাজে গণতন্ত্র নিয়ে এমন আলোচনা একেবারেই প্রত্যাশিত। এটাই বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্পিরিট। তবে যা প্রত্যাশিত নয়, তা হলো দেশের গরিষ্ঠ জনগণের গরিষ্ঠসংখ্যক ভোটে নির্বাচিত গরিষ্ঠসংখ্যক মাননীয় সংসদ সদস্য জনগণের পক্ষে জাতীয় সংসদের পবিত্র আঙ্গিনায় বসে যে সংবিধানাটি প্রণয়ন করেছেন, যা জনগণের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রণীত পবিত্রতম দলিল, গণতন্ত্র আর জনগণের দোহাই দিয়ে যখন লঘিষ্ঠসংখ্যক দুর্বৃত্ত সেই সংবিধানের বাইরে যেয়ে গণতন্ত্র আর জনগণের পক্ষে ছাফাই গাওয়ার চেষ্টা করে।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মাঠে এবং মাঠের বাইরে যে রাজনীতি, তাতে এমনি অপ্রত্যাশিত উপাদান যেমন আছে তেমনি আছে বিস্ময়কর কিছু বিষয়বস্তুও। যেমন পৃথিবীতে যারা গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী তাদের কাছেই অবারিত প্রশ্রয় পাচ্ছে সেই সব অপরাধীচক্র যারা আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দুঃস্বপ্নে বিভোর। এসব বিষয় নিয়ে পত্রিকার পাতায়তো বটেই, ইলেকট্রনিক আর সোশ্যাল মিডিয়াতেও বলাবলি আর লেখালেখি চলছে ঢের। কাজেই সে নিয়ে আবারো লেখা কপচানোর কোনো যৌক্তিকতায়ই থাকতে পারে না।

বিস্ময়াবিভূত এই আমার এই লেখার প্রেক্ষাপটটা তাই একেবারেই ভিন্ন। আমি বিস্মিত হই যখন শুনি, এমনকি শাসকদলের কিছু নেতাও নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলেন। আমার বিস্ময়ের কারণটাও খুবই স্পষ্ট। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতই নির্বাচনকালীন সরকারও আমাদের সংবিধানবহির্ভূত একটি শাসন কাঠামো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশ পরিচালনার স্বার্থে যে কোনো সময় যে কোনো সংখ্যক মন্ত্রীর সমন্বয়ে তার মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন। এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক অধিকার।

Advertisement

অতীতেও আজকের প্রধানমন্ত্রী এমনটি করেছেন এবং চাইলে ভবিষ্যতেও করতেই পারেন। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেই সাংবিধানিক অধিকারটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নয়। অর্থাৎ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর একটি খর্বকায় মন্ত্রিসভা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে এমন কথা আমাদের সংবিধানের কোথাও কোনো পাতাতেই লেখা নেই।

বিষয়টা কিছুটা হয়তো আদার বেপারীর সুপার ট্যাংকারের খবর নেয়ার মত শোনাতে পারে, তারপরও নির্বাচনকালীন সরকার সম্বন্ধে নিজস্ব একটি মতামত লেখাটির এই পর্যায়ে জুড়ে দেয়ার প্রলোভনটা কোনো মতেই সংবরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। হাজার হোক আমিতো সেই দেশের নাগরিক যারা সাকিব আল হাসান থেকে শুরু করে জো বাইডেন, কোনো কিছু নিয়েই আলোচনা করার এবং তারচেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ নিজস্ব মন্তব্য জুড়ে দেয়ার সামান্যতম সুযোগও হাতের আঙ্গুলের ফাঁক গলে ফসকাতে দেন না।

এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২০১৩-এর তুলনায় ক্রমশঃই দুর্বলতর হয়ে পড়তে থাকা আগুন সন্ত্রাসীরা এখনও তাদের সাধ্যের সবটুকু ঢেলে আগুন সন্ত্রাসে ব্যস্ত। পাছে যদি নির্বাচনটা পিছিয়ে দেয়া যায়! অন্যদিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটটাও চরম বৈরী। সদ্যই মানবজাতি কাটিয়ে উঠেছে সর্বশেষ প্যান্ডেমিকটি। তার পরপরই একের পর এক ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের’ মত এসে যোগ হয়েছে প্রথমে রুশ-ইউক্রেন এবং অতঃপর ইসরাইল বনাম হামাস যুদ্ধ।

 

পকেটে আরো বেশ কয়েক কোটি ভরে ফেলার সামান্যতম সুযোগটিও অপচয়ে আগ্রহী নন এমন ব্যবসায়ীর সংখ্যা এ দেশে অগণিত। এদের দৌরাত্ম্য এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চাল থেকে শুরু করে ফলমূল, এ সমস্ত কিছু উৎপাদনে পৃথিবীতে টপ টেনে থাকা বাংলাদেশকে এখন চাল-ডাল, তেল-আলুতো বটেই এমনকি ডিমও আমদানী করে খেতে হচ্ছে।

Advertisement

 

‘গরিবের সুন্দরী বৌ’ বাংলাদেশের দিকে একদিকে যেমন কুনজর সক্ষম প্রতিবেশীর, তেমনি দুরের সচ্ছলদের কুদৃষ্টিও যে আমাদের উপর তা দেশের মানুষকে জানাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও রাখঢাক করেননি। আর দেশেতো শুধু আগুন সন্ত্রাসীরাই নেই, আছে তো সুযোগ সন্ধানীরাও। পকেটে আরো বেশ কয়েক কোটি ভরে ফেলার সামান্যতম সুযোগটিও অপচয়ে আগ্রহী নন এমন ব্যবসায়ীর সংখ্যা এ দেশে অগণিত। এদের দৌরাত্ম্য এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চাল থেকে শুরু করে ফলমূল, এ সমস্ত কিছু উৎপাদনে পৃথিবীতে টপ টেনে থাকা বাংলাদেশকে এখন চাল-ডাল, তেল-আলুতো বটেই, এমনকি ডিমও আমদানী করে খেতে হচ্ছে।

এই যখন পরিস্থিতি এবং সর্বোপরি হুন্ডির থাবায় ক্রমশ্যই কৃশকায় হয়ে পড়তে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ যখন নির্বাচনের পরপরই উন্নয়ন সহযোগীর হার্ড টার্ম লোনের কিস্তি পরিশোধের ধাক্কা সামলাতে পারবে কি পারবে না, তাই নিয়ে প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবীদদের কুঞ্চিত ভ্রু তখন আমারতো মনে হয় এখন বরং উল্টোটাই প্রয়োজন, অর্থ্যাৎ মন্ত্রিসভার আকৃতি না কমিয়ে প্রয়োজন বরং বাড়ানো।

আমি এও জানি যে কার্যতঃ তেমনটি হবার নয়, কারণ আমাদের অতি পারঙ্গম প্রধানমন্ত্রী শেষমেষ সবকিছু ঠিকঠাক মতই সামলে উঠবেন। তারপরও তাই বলে নির্বাচনকালীন কৃশকায় সরকারের আলোচনা সামনে এনে আমরা হয়তো তার জন্য আরেকটু বিরক্তির উদ্রেক না করলেও পারি। দিননা ‘তাঁকে তাঁর মত থাকতে’, এটি তো এখন প্রমাণিত যে তাতেই এদেশের গরিষ্ঠের মঙ্গল।

লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এইচআর/জিকেএস