ইমরুল ইউসুফ
Advertisement
শিশুটি ছবি আঁকছে। সামনে ছড়ানো-ছিটানো রং-বেরঙের পেনসিল। ইজেল, বুরুশ বা তুলি। সাদা কাগজ ধীরে ধীরে রঙিন হয়ে উঠছে। রংধনুর মতো। প্রজাপতির মতো। বেলুনের মতো। এমন সময় একটি কাঁঠাল পাতা উড়ে উড়ে আঁকতে থাকা ছবির ওপর পড়ল। শিশুটি পাতাটি সরাতে গিয়েও সরালো না। ভাবলো—থাক। পাতাটাকে ছবির অংশ করে নিলো শিশুটি। পাতার চারপাশে রং লাগালো। মনে মনে বললো, বাহ বেশ তো লাগছে! এমন সময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিলো একটি রাজহাঁস। হাঁসটি ডানা ঝাপটালো। কয়েকটি পালক উড়তে লাগলো তুলোর মতো। একটি পালক বাতাসে ভাসতে ভাসতে এসে পড়লো ওই ছবির ওপর। ঠিক কাঁঠাল পাতার পাশে। ভেজা জলরঙে আটকে গেল পালকটি। অদ্ভুত তো! শিশুটির মনে বিস্ময়। সেইসঙ্গে আনন্দ। এমন ছবি সে আঁকতে চায়নি। কিন্তু কেমন করে যেন নতুন একটি ছবি হয়ে যাচ্ছে। শিশুটি পালকটিও সরালো না। ছবির মধ্যে একটি হাঁস আঁকলো। গাছ অঁকলো। আঁকলো ফুল, পাখি, প্রজাপতি।
শিশুটি তার মাকে ডাকলো। বললো, ‘মা আমার ছবিটি দেখো। সুন্দর না?’ এমন অদ্ভুত ছবি দেখে মা তো অবাক! বললেন, ‘একি করেছো মা? এ ছবি তুমি জমা দিতে পারবে? এটা একটা প্রতিযোগিতা। এখানে তো যা-তা করে ছবি আঁকা যায় না।’ মেয়েটি বললো, ‘ঠিক করেছি মা। আমি এখন ছবিটি পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে দেবো। দেখবে আমার ছবিটি ওই রাজহাঁসের মতো পানিতে ভাসতে থাকবে।’ মা কিছু বললেন না। মেয়ের এ চাওয়ায় বাধা দিলেন না। মনে মনে বললেন, এ কাজ করে মেয়ে যদি আনন্দ পায় তাহলে তা-ই করুক। মা আর মেয়ে মিলে ছবিটি পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে দিলো।
রাজহাঁসের মতো ছবিটি ভাসছে। নৌকার মতো ছবিটি ভাসছে। আর শিশুটি ভাসছে আনন্দে। হাতে তালি দিতে দিতে লাফাচ্ছে। এই আনন্দ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পাওয়ার চেয়ে ঢের বেশি। শিশুদের ছোট ছোট এমন চাওয়াগুলো পূরণ করতে পারাও তাদের অধিকারের সঙ্গে শামিল হওয়া। তাদের ভাবনার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আনন্দের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। প্রতিভা বিকাশের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। শিশুমনের সব দরজা জানালা খুলে দেওয়া। আমরা খুব সহজেই এগুলো করতে পারি। কিন্তু ফুলের মতো সুন্দরতম শিশু রাইদাহ গালিবার ক্ষেত্রে কি আমরা সেটা পেরেছি? পারিনি, মোটেও পারিনি। বরং পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করা হয়েছে। দেশের বেসরকারি নামকরা একটি হাসপাতালের এক চিকিৎসকের অবহেলায় আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি পবিত্রতম শিশু রাইদাহ গালিবা কুইনকে। যদিও রাইদাহ সোনামানিক হয়ে আমাদের হৃদয়ে ‘চিরজীবিত’ শিশু হয়ে বেঁচে আছে। থাকবে অনন্তকাল।
Advertisement
আরও পড়ুন: বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর কবিতা কেন ভালো লাগে?
রাইদাহ ছোটবেলা থেকেই খুব সৃষ্টিশীল। কথায় কথায় সে ছড়া কাটতো। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতো। একসময় গল্পগুলো মা লিখে রাখতেন। একটু বড় হয়ে রাইদাহ নিজেই লিখতো মজার মজার গল্প। সেসব গল্প ছাপা হতো দেশসেরা শিশুপত্রিকা ‘ধানশালিকের দেশ’, ‘শিশু’ প্রভৃতি পত্রিকায়। জাতীয় দৈনিকগুলোতেও ছাপা হতো রাইদাহর গল্প। কিন্তু রাইদাহ এখন আর গল্প লেখে না। তাকে নিয়েই আমরা লিখি কত্তো কত্তো গল্প। অনেকেই সে গল্প পড়ে। অনেকেই তার গল্প শোনে। কেবল রাইদাহর পড়া হয় না। রাইদাহর শোনা হয় না।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সেরা শিক্ষার্থী ছিল রাইদাহ। পড়তো পঞ্চম শ্রেণিতে। ভাবাই যায় না—রাইদাহ নেই! মাত্র বারো বছরের জীবন পাখির ডানায় ভর করে উড়ে গেলো আকাশে। মা কবি ও গল্পকার কানিজ পারিজাত প্রাণপ্রিয় কন্যাকে সব সময় খুঁজে বেড়ান সীমাহীন নীলিমায়। বাবা মিজানুর রহমান কন্যাকে সারাক্ষণ খুঁজে বেড়ান—হেথা নয়, হোথা নয়, অন্যকোনো খানে। প্রিয় কন্যার তুলতুলে গালে আদর দেওয়া যায় না। ছোঁয়া যায় না কুঁচবরণ চুল। প্রিয় ছোট ভাই আবরার তার বোনকে খোঁজে ঘর-বাড়িতে, মাঠে-ঘাটে, খাটে। খাটের তোষক, বালিশ, বিছানার চাদরে। কোলবালিশকে বোন ভেবে সস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। চোখের স্বচ্ছ জলে রাইদাহর মায়াময় মুখ। পটলচেরা চোখ। রাইদাহ আছে, আছে—সবখানে। ছায়া হয়ে, মায়া হয়ে। সবার একান্ত আপনজন হয়ে।
২০২২ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ। রাইদাহ গালিবার হঠাৎ জ্বর এলো। মা নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে। ধরা পড়লো ডেঙ্গু। তাকে ভর্তি করানো হলো হাসপাতালে। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা হলো না। মায়ের অভিযোগ—তার কন্যাকে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। ফ্লুইড অব্যবস্থাপনার কারণে রাইদাহ গত বছরের ৩০ নভেম্বর চিরতরে হেমন্তের মেঘ হয়ে হারিয়ে যায় আকাশে।
Advertisement
আরও পড়ুন: সাহিত্যে নোবেলজয়ী কে এই জন ফসে?
রাইদাহ গালিবা গল্প লিখতে ভালোবাসতো। মজার মজার সব গল্প। সেই গল্পগুলো পরে বই আকারে প্রকাশও হয়েছে। বইগুলো হলো—‘এক যে ছিল মুচি’, ‘পিটুর জাদু জুতা’, ‘ইমা ও দৈত্য’ এবং ‘ভয়ংকর গাছ’। রাইদাহ ‘ভয়ংকর গাছ’ গল্পের ভয়ংকর সেই গাছ হতে চায়নি। সে সবুজ গাছ হতে চেয়েছিল। গাছের শীতল ছায়া হতে চেয়েছিল। হতে চেয়েছিল সবুজ মাঠ। নীল আকাশ। ঝরনার স্বচ্ছ জল। ‘ভয়ংকর গাছ’ গল্পের চরিত্র—কাঠুরে ‘মনু’র সঙ্গে হয়তো যেতে চেয়েছিল নীল পাহাড়ে। পাহাড়ের সেই ডাইনির কাছে। যে ডাইনির কাছে পানি আছে। ওই পানি ছিটিয়ে দিলে অভিশপ্ত গাছ আবার মানুষ হয়ে যাবে। মানুষগুলো সুখে-শান্তিতে সমাজে বসবাস করবে। কিন্তু চিকিৎসকরূপী ডাইনি রাইদার সে স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি। অতল গহ্বরে হারিয়ে যায় রাইদাহর সব স্বপ্ন। হৃদয়ে জমে থাকা সব গল্প সমুদ্রের ফেনিল ঢেউয়ে বিলীন হয়ে যায়।
শিশুরা ইচ্ছেমতো নেচে-গেয়ে, খেয়ে-দেয়ে, আনন্দ-হইহুল্লোড় করে খেলাধুলা করবে। শিক্ষা গ্রহণ করবে। পুষ্টিকর খাবার খাবে। হাসপাতালে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পাবে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে। ঘরে নিরাপদে ঘুমাবে। মা-বাবার আদর-ভালোবাসায় মন ও মননে বেড়ে উঠবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ সব সময় শিশুদের অধিকার লঙ্ঘন করে। রাইদাহর মতো নিষ্পাপ, নিরাপরাধ শিশুদের হত্যা করে। আমরা রাইদার মতো মেধাবী আর সৃষ্টিশীল কোনো শিশুকে অকালে হারাতে চাই না। আমরা চাই সব শিশুর নিরাপদ এবং সুরক্ষিত জীবন। শিশুদের প্রতিটি দিন হোক আনন্দময়। শিশুরা প্রতিদিন আনন্দে হাসুক। আনন্দে ভাসুক। সূর্য হয়ে আলো দিক। গাছ হয়ে ছায়া দিক। মাটি হয়ে লালন করুক। আকাশ হয়ে আগলে রাখুক। পাহাড় হয়ে সুরক্ষা করুক। রাইদাহ গালিবার মতো কোনো শিশু যেন ভুল চিকিৎসায় চিরতরে হারিয়ে না যায়। কারণ রাইদাহর মতো শিশুরাই হয় ছায়াময় বৃক্ষ। মাটির মতো খাঁটি। আলোর মতো উজ্জ্বল। পাহাড়ের মতো অটল। আকাশের মতো উদার। বৃষ্টির মতো সোনায় মোড়া মেঘ হরিণী।
লেখক: উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
এসইউ/এমএস